‘বিশ্বাসঘাতকতার শিকার আফগানিস্তানের সেনাবাহিনী’

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

আগস্ট ২৬, ২০২১, ০৮:১৬ পিএম

‘বিশ্বাসঘাতকতার শিকার আফগানিস্তানের সেনাবাহিনী’

আফগানিস্তান সেনাবাহিনীর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল সামি সাদাত বলেছেন তারা বিশ্বাসঘাতকতার শিকার। আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট, রাজনীতিবিদ এবং মার্কিন নীতিনির্ধারকরা আফগানিস্তানের সেনাবাহিনীর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। বুধবার (২৫ আগস্ট) নিউইয়র্ক টাইমসে এক নিবন্ধে তিনি এসব কথা লিখেন।

নিচে সামি সাদাতের সাক্ষাতকারের বঙ্গানুবাদ তুলে ধরা হলো:  

গত সাড়ে তিনমাস ধরে রাতদিন যুদ্ধ করেছি তালেবানকে রুখতে। বিপুল ক্ষয়ক্ষতি আর রক্তপাতের পর হঠাৎ একদিন প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি আমাকে কাবুলে ডাকলেন আফগানিস্তানের স্পেশাল ফোর্সকে নেতৃত্ব দিতে। অথচ, ততক্ষনে তালেবান কাবুল দখল করে ফেলেছে। আমি ক্লান্ত, হতাশ এবং রাগান্বিত।

গত সপ্তাহে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, ‘আফগান সৈন্যরা যদি নিজে থেকে নিজেদের প্রয়োজনে যুদ্ধ করতে না পারে তাহলে তো মার্কিন সেনারা তাদের হয়ে সেই ‍যুদ্ধ করতে গিয়ে মরতে পারে না। মরা উচিতও নয়’।

তিনি আরো লিখেন, আমাদের আফগান বাহিনীর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ আছে, সেগুলো সব মিথ্যা বা ভুল না। আফগান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতি, আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রিতা ইত্যাদি নানা অভিযোগ আছে কিন্ত এসব আমাদের তালেবানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ অনাগ্রহী হওয়ার কারণ নয়। আমাদের যুদ্ধে আগ্রহ হারানোর কারণ আমাদের সাথে আমাদের মিত্র আমেরিকার সম্পর্ক দিনকে দিন খারাপ হয়েছে, তারা আমাদের ছেড়ে দিয়েছে এমন একটি বাজে অনুভূতি আফগান বাহিনীর মধ্যে বেড়ে উঠেছে। এমনকি মার্কিন প্রেসিডেন্টের একাধিক বক্তব্যে আমাদের ত্যাগ করার এবং আমাদের প্রতি অনাস্থার অনুভূতি ব্যক্ত হয়েছে। আমাদের যুদ্ধ থামিয়ে দেওয়ার কারণ আমাদের মিত্র আমেরিকাই ইতোমধ্যে যুদ্ধ থামিয়ে দিয়েছে।  

আফগান বাহিনীর ভেঙ্গে পড়ার আসল কারণ না জেনেই মার্কিন প্রেসিডেন্টসহ আমাদের পশ্চিমা মিত্ররা অহেতুক দোষারোপ করছেন। কাবুল এবং ওয়াশিংটনের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দই আমাদের রাশ টেনে ধরে আমাদের কাজ করতে বাঁধা দিয়েছে। এতদিন ধরে মার্কিন বাহিনী আমাদের সাজ-সরঞ্জাম ও অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে  সহায়তা করছিলো তা হঠাৎ করে বন্ধ দেওয়ায় আমরা পঙ্গু হয়ে পড়েছি। এমনকি আফগান-মার্কিন রাজনৈতিক নেতারাও আমাদের উপযুক্ত দিক নির্দেশনা দিতে ব্যর্থ হয়েছে।

একজন একজন কমান্ডার হিসেবে ১৫ হাজার সেনার ২১৫ মাইওয়ান্দ কর্পসকে তালেবানের বিরুদ্ধে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে আমি শত শত সৈনিক এবং অফিসার হারানোর কারণেই আমি রাগান্বিত, বিরক্ত এবং বিব্রত। আফগানিস্তানের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে তালেবানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আমরা আফগান বাহিনীর গৌরব বৃদ্ধি করতে চেয়েছি। অহেতুক মরতে চাইনি। এবং আমাদের যোদ্ধারা বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেই মরেছে। আমাদের পরাজয়ের একমাত্র কারণ হলো আফগান-মার্কিন রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতা।

দুই সপ্তাহ আগে আমরা যখন লস্কর গাহ শহরকে তালেবানের দখলের হাত থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছিলাম তখন হঠাৎ করে প্রেসিডেন্ট (সাবেক) আশরাফ গনি আমাকে আফগানিস্তানের স্পেশাল ফোর্সের কমান্ডার হিসেবে নিযুক্ত করেন। আমি তৎক্ষণাৎ আমার সৈন্যদের ছেড়ে ১৫ আগস্ট কাবুলে এসে পৌছালে প্রেসিডেন্ট গনি আমাকে কাবুলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা দায়িত্ব প্রদান করেন এবং পরিস্থিতি না জেনেই যুদ্ধ করার প্রস্তুতি নিতে থাকি। এরপর কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই প্রেসিডেন্ট আফগানিস্তান ত্যাগ করেন। ততক্ষণে তালেবান কাবুলের আরো কাছে চলে এসেছে।  

প্রেসিডেন্ট গনি তড়িঘড়ি পলায়ন না করলে আজকের পরিস্থিতি তৈরি হতো না। তিনি থেকে গেলে তালেবানের কাছে সুষ্ঠুভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করা যেত এবং হয়তো আমরা কাবুল দখলে রাখতে সমর্থ হতাম। এমনকি দেশ ছাড়ার যে হুড়োহুড়ি তাও দারুণভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যেত।

যদিও গত ১৬ আগস্ট মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেছেন, আফগান বাহিনী কোন প্রকার যুদ্ধ ছাড়াই হাল ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা হলো আমাদের সেনারা বীরের মতো বিরামহীন যুদ্ধ করেছে। হত ২০ বছরের আমাদের ৬০ হাজার সেনা মারা গিয়েছে যা আমাদের  মোট সেনা সদস্যের ৫ ভাগের একভাগ। এ থেকেই প্রমাণিত হয় আমাদের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ ভিত্তিহীন।

তবুও কেন আফগান সেনাবহিনী ভেঙ্গে পড়লো? তারও জবাব তিনি দিয়েছেন নিজের লেখায়।

প্রথমত, ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তালেবানের সাথে যে চুক্তি করেছিলেন তাই আমাদের ডুবিয়েছে। এই চুক্তির মাধ্যমে এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ গুটিয়ে নেয়া হয়। দ্বিতীয়ত, আমাদের সামরিক ও অন্যনা যেসব জরুরী বিষয়াদি দরকার সেগুলেরা সরবরাহ থেমে যাওয়া। যা আমাদের অপূরণীয় ক্ষতি করেছে। তৃতীয়ত, গনির সরকারের তড়িঘড়ি পলায়ন। যা আমাদের একেবারে শূন্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে।

ট্রাম্প-তালেবান চুক্তিই আজকের এর জন্য দায়ী। এর ফলে, রাতারাতি আফগান ও মার্কিন সেনাদের সম্পর্ক বদলে যায়। আফগান সেনারা দূর্বল এবং বিপরীতে তালেবান শক্তিশালী হয়ে উঠে। তালেবান বুঝে যায়, তাদের বিজয় এখন কেবল সময়ের ব্যাপরা। কেবল আমেরিকানদের চলে যাওয়ার অপেক্ষা। ট্রাম্প-তালেবান চুক্তির আগে তালেবান আফগান বাহিনীর বিপক্ষে উল্লেখযোগ্য কোন জয় পায়নি। অথচ চুক্তির পর অযথাই আমাদের সৈন্যরা মারা গিয়েছে। তারপরও আমরা তালেবানদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ চালিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু বাইডেন যখন বললেন যে, তিনি ট্রাম্পের পরিকল্পনাই অনুসরণ করবেন তখুনি মূলত সব শেষ হয়ে গেল।

আফগান বাহিনী আমেরিকার সেনাবিাহিনীর কৌশল এবং অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করে প্রশিক্ষিত হয়েছিলো। ফলে সেনা অপসারণের কার্যক্রম শুরুর পর থেকে আফগান বাহিনী মার্কিন বিমান সহায়তা এবং পর্যাপ্ত গোলাবারুদের সরবরাহ থেকে বঞ্চিত হওয়ায় তালেবানরা এগিয়ে যায়।

আমরা এরিয়াল লেজার ওয়েপন সক্ষমতা থেকে বঞ্চিত হবার পর থেকেই তালেবানরা স্নাইপার ও বিস্ফোরকের সাহায্যে আক্রমণ করতে আরম্ভ করে। ফলে তারা আমাদের বিপক্ষে জয়ী হতে থাকে।

শেষ দিন অবধি আমরা একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। আমাদের পরাজয়ের কারণ আমরা আমাদের রাজনীতি এবং আমাদের প্রেসিডেন্টের বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়েছি।

এটি কেবল আফগানদের যুদ্ধ নয়। এটি একটি আর্ন্তজাতিক যুদ্ধ। তাই কেবল আফগান সেনাদের পক্ষে এই যুদ্ধ এগিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। এটি যদিও আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় সামরিক পরাজয় কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটি রাজনৈতিক পরজয়েরই প্রলম্বিত অংশ।

 

সূত্র: দ্য নিউইয়র্ক টাইমস

 

Link copied!