ফেব্রুয়ারি ২, ২০২৫, ০১:১৬ পিএম
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির মহাসচিব। অন্তর্বর্তী সরকার, সংস্কার, নির্বাচন বিতর্কসহ সমসাময়িক পরিস্থিতি নিয়ে সম্প্রতি সাক্ষাতকার দিয়েছেন সমকালে।
জাতীয় সরকার
সাক্ষাতকারে প্রশ্ন করা হয়, নির্বাচনে জয়ী হলে বিএনপি জাতীয় সরকার গঠন করবে– এমনটি বলা হয়েছে। কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের পরে জাতীয় সরকারের একটি আলোচনা ছিল। কেউ কেউ অভিযোগ তুলে বলছেন, বিএনপি চায়নি বলেই জাতীয় সরকার হয়নি। নির্বাচনের আগেই জাতীয় সরকার গঠিত হলে নির্বাচন পিছিয়ে যেতে পারে– এমন ধারণা থেকে বিএনপি তখন জাতীয় সরকারে সম্মত হয়নি। এ বিষয়ে আপনার মতামত কী?
এর উত্তরে মির্জা ফখরুল বলেন, “প্রথম কথা হচ্ছে– এটা পুরোনো আলাপ। আর এটা পুরোপুরি সত্যও নয়। আমরা বরাবরই যেটা মনে করে এসেছি, সেই সময়ে জাতীয় সরকার হলে তাহলে আরেকটি নির্বাচন হতো না। তাহলে হয়তো আরেকটি পাল্টা ক্যু (অভ্যুত্থান) হয়ে যেত। কারণ বাংলাদেশের মানুষ এখনই একটি বিষয় নিয়ে একমত হতে পারেন না। তখন জাতীয় সরকার হলে তো প্রতিদিনই একেকটি বিষয় নিয়ে বিতর্ক তৈরি হতো। আমরা যেটা চাইছি, একটি নির্বাচিত জাতীয় সরকার।”
অন্তর্বর্তী সরকারের সফলতা
অন্তর্বর্তী সরকারের ছয় মাসে এই সরকারের সফলতা হিসেবে তিনি বেশ কিছু সংস্কার কমিশন গঠন করার কথা বলেছেন। এর মধ্যে কয়েকটি কমিশন তাদের রিপোর্ট জমা দিয়েছে। এই ছাত্র-জনতার যে অভ্যুত্থান হয়ে গেল, এটাকে যতটুকু সম্ভব মর্যাদা দিয়ে তারা কাজ করছেন, একেও তিনি সাফল্য বলে উল্লেখ করেছেন। আর্থিক ক্ষেত্রেও বেশ কিছু সাফল্য এরই মধ্যে এসেছে বলে তিনি মন্তব্য করেছেন। তার মতে, একটা নিয়মের মধ্য দিয়েই আর্থিক খাতটি এখন চলছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যর্থতা
তবে তাদের ব্যর্থতা আছে কয়েকটি জায়গায় উল্লেখ করে তিনি বলেন, “প্রথমত, এই সরকারের যে মিশন, সেটি তারা জনসাধারণের মাঝে হাজির করতে পারেনি। অর্থাৎ তারা কী করতে চায়, এটা এখনও পরিষ্কার নয়। মানুষের যে আকাঙ্ক্ষা, মানুষ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে নিজেদের প্রত্যাশা পূরণে এগিয়ে যেতে পারবে এই লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশনের যে কাজ, রোডম্যাপ ঘোষণা করা– এটা তারা এখনও করতে পারেনি।
“দ্বিতীয়ত, আমার কাছে যেটা মনে হচ্ছে– প্রশাসনিক ক্ষেত্রে তাদের ব্যর্থতা সবচেয়ে বেশি। শেখ হাসিনার আমলে সচিবালয়ে যারা ছিল, তারা এখনও অনেকেই আগের অবস্থানে বহাল আছে। এটা আমার কাছে তাদের একটা ব্যর্থতা মনে হয়েছে। ফ্যাসিস্টের যারা দোসর, তারা এখনও বহাল তবিয়তে আছে।
“তৃতীয়ত, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম জনসাধারণের নাগালে রাখার জন্য কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ তারা নিতে পারেনি। এ জন্য মানুষ অনেক দুর্ভোগের মধ্যে আছে।”
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি
সাক্ষাতকারে বিএনপি মহাসচিব আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়েও কথা বলেছেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, “বিগত ফ্যাসিস্ট আমলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, বিশেষ করে পুলিশ বাহিনীতে যে অনিয়ম তৈরি হয়েছিল, তার ফলে ৫ আগস্টের পর এটি সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়েছিল। তবুও এই সরকার চেষ্টা করছে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে। এটি খুবই কষ্টসাধ্য একটি বিষয়। বাহিনীর নিচের দিকে যারা রয়েছেন, তারা সেভাবে কাজ করতে পারছেন না, কারণ তাদের মধ্যে আগের অনিয়মের ফলে সৃষ্টি হওয়া ভীতি কাজ করছে। আবার পুলিশের মধ্যে যারা আওয়ামী লীগের দোসর ছিল, যারা সরাসরি হত্যার সঙ্গে জড়িত, হত্যার নির্দেশদাতা তাদের অনেককেই এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়নি। পুলিশ বাহিনীর কাজ হচ্ছে দ্রুত অপরাধীদের চিহ্নিত করা, অপসারণ করা এবং অবশ্যই যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ায় বিচারের মুখোমুখি করা।”
মির্জা ফখরুল দাবি করেন, তারা এখনও এই সরকারকে সহযোগিতা করছেন, এবং ভবিষ্যতেও সহযোগিতা করতে চান। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, “এই সরকার ব্যর্থ হওয়া মানে গণঅভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়ে যাওয়া।”
‘নির্বাচন বনাম সংস্কার ও নতুন রাজনৈতিক দল
‘নির্বাচন বনাম সংস্কার– বিতর্ক কেন সামনে এসেছে বলে মনে করেন?’ এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আমার কাছে যেটা মনে হয়েছে এটা একটা অহেতুক বিতর্ক। কারণ, এটার কোনো প্রয়োজন নেই। আমরা তো বলেছি– সংস্কার এবং নির্বাচনের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। আমাদের দল ২০১৬ সালে প্রথম রাষ্ট্র সংস্কারের রূপরেখা দিয়েছিল। এর পর ২০২২ সালে ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। ক্ষমতার ভারসাম্য, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট সেগুলোই এখন আলোচিত হচ্ছে। এখন সংস্কার এবং নির্বাচন নিয়ে যে বিতর্কটা– সেটা নিয়ে যদি বলি, নির্বাচনের জন্য যেটা দরকার, সেই নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে। পাশাপাশি সংস্কার যেটা দরকার সেটাও এগিয়ে যেতে পারে। তাই নির্বাচন এবং সংস্কার নিয়ে যে বিতর্ক অযথাই তৈরি করা হয়েছে।”
সাক্ষাতকারে তিনি পরিস্কারভাবে বলেছেন, চলতি বছরে, অর্থাৎ ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন চায় বিএনপি।
আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি
‘গণঅভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি শোনা যাচ্ছে বিভিন্ন মহলে। বিএনপি কেন আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে চাইছে না?’ এমন প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল বলেন, “বিএনপি আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে সম্মত হচ্ছে না বা নিষিদ্ধ চায় না– কথাটি সত্য নয়। আমরা বলছি, জনগণ সিদ্ধান্ত নেবেন। বিএনপি চাইল আর আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হয়ে গেল, এটা তো ঠিক নয়। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হবে কিনা, এই সিদ্ধান্ত জনগণকে নিতে হবে। গোটা রাষ্ট্র মিলে এই সিদ্ধান্তটি নিতে হবে। পার্লামেন্টে বসে সিদ্ধান্ত নিলে সেটা সবচেয়ে ভালো হয়। আমরা বলেছি, একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে আরেকটি রাজনৈতিক দলকে আমরা নিষিদ্ধ করতে পারি না। যেমন– জামায়াতে ইসলামীকে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করেছিল। তখন আমরা এর প্রতিবাদ করেছিলাম। তাই আমরা যেটা বলেছি, একটি রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করতে হলে পার্লামেন্টে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে জনগণের হাত দিয়ে সম্মিলিতভাবে তা করা উচিত।”
নতুন রাজনৈতিক দলের বিষয়ে তিনি “যে কোনো গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তিকে” তারা স্বাগত জানায় বলে উল্লেখ করেন।
‘বিপ্লব’ নাকি ‘গণঅভ্যুত্থান’
‘বিপ্লব’ নাকি ‘গণঅভ্যুত্থান’ এই বিতর্ক প্রসঙ্গে মির্জা ফখরুল বলেন, “এটা অবশ্যই একটা ‘গণঅভ্যুত্থান’ হয়েছে। ‘বিপ্লব’ নয়। ‘বিল্পব’ হলে তার একটি বিপ্লবী বাহিনী থাকবে। কর্মসূচি থাকবে। এখানে তার কিছুই নেই। এখানে যেটা হয়েছে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়েছে। একটা গণবিস্ফোরণ হয়েছে। গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিস্ট শক্তি ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে।”
ছাত্রদের সঙ্গে বিএনপির কোনো বিরোধ নেই উল্লেখ করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ নিয়ে আমাদের কোনো বিরোধ নেই। আমরা বিরোধিতা করেছিলাম সেকেন্ড রিপাবলিকের বিষয়ে। ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ নিয়ে আমরা কাজ করছি। সেটা নিয়ে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আমরা আলোচনা করছি।
একাত্তর বনাম চব্বিশ
একাত্তর ও চব্বিশকে দুঃখজনকভাবে মুখোমুখি দাঁড় করানো হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন মির্জা ফখরুল। তিনি বলেন, “একাত্তরে যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে মেনে নিতে পারেনি, তাদের মধ্যে এই চেষ্টাটা থাকতে পারে। সেটা আমি জানি না। কিন্তু আমি মনে করি, ১৯৭১ ও ২০২৪ এক নয়। একাত্তর ছিল একটি দেশ পাওয়ার লড়াই। লাখো মানুষের জীবন, কোটি মানুষের শরণার্থী হওয়ার সংগ্রাম ও ত্যাগের মধ্য দিয়ে আমরা বাংলাদেশ পেয়েছি, স্বাধীনতা অর্জন করেছি। আর চব্বিশ হচ্ছে একটি ফ্যাসিস্ট সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াই।”
ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকের বিষয়টিকে তিনি একটা চলমান প্রক্রিয়া হিসেবে উল্লেখ করেছেন। বিএনপি একটা ন্যাশনাল ইউনিটির কথা বলছে বলেই তারা আলাপ-আলোচনা করছে বলে জানান তিনি।
‘তৌহিদী জনতা’
সম্প্রতি দেশের কয়েকটি জায়গায় ‘তৌহিদী জনতা’র ব্যানারে কিছু ঘটনা ঘটেছে। নারীদের ফুটবল খেলার মাঠে হামলা, অভিনেত্রীদের শোরুম উদ্বোধন করার কাজে বাধা দেওয়া হয়েছে। এটাকে কীভাবে দেখছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে বিএনপি মহাসচিব বলেন, “প্রথমত, এটা হচ্ছে ধর্মান্ধতা। দ্বিতীয়ত, এক ধরনের ষড়যন্ত্র। বাংলাদেশে মৌলবাদের উত্থান হচ্ছে, ইসলামী জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিচ্ছে– এধরনের প্রচারকে প্রমাণ করার জন্য এসব করা হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ ধর্মভীরু, ধর্মান্ধ নয়। আমরা স্পষ্টভাষায় বলতে চাই, বাংলাদেশে কোনো ধরনের ধর্মান্ধতাকে আমরা প্রশ্রয় দেব না। এসব যারা করছেন, তারা বাংলাদেশের পক্ষের শক্তি নয়।”
‘চাঁদাবাজি-দখলবাজি’র অভিযোগ
বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ‘চাঁদাবাজি-দখলবাজি’ এসব অভিযোগের প্রেক্ষিতে তিনি বলেন, “দখল-চাঁদাবাজির ঘটনা যাতে না ঘটে আমাদের পার্টির পক্ষ থেকে সেসব বিষয়ে কঠোরভাবে বলা আছে। পাশাপশি কিছু আছে অতিরঞ্জন। আবার প্রচারমাধ্যমে এখনও যেভাবে ফ্যাসিবাদের ভূত বসে আছে, তা সবাই জানেন। এ ছাড়া মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে দেওয়ার মতো ঘটনাও অহরহ ঘটছে। তবে যেটা শেষ কথা, আমরা নির্বাচনটি চাইছি দেশকে শান্তিপূর্ণ অবস্থায় নিয়ে যেতে। জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে।”
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের মূল্যায়ন করতে গিয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, “বাংলাদেশের তিন দিকে ভারত। ৫৪টি অভিন্ন নদী ভারত থেকে বাংলাদেশে এসেছে। এগুলো তো বড় ধরনের বিষয়। সীমান্তে উত্তেজনা হচ্ছে, গোলাগুলি হচ্ছে, মানুষ মারা যাচ্ছে। এটাকে একেবারে শূন্যে নামিয়ে আনা, সীমান্ত হত্যা একেবারেই বন্ধ করা, পানির ন্যায্য হিস্যা পাওয়া, ব্যবসা-বাণিজ্যে অংশগ্রহণমূলক সহযোগিতা– এসবের বাস্তব ভিত্তি দেখতে হবে। পারস্পরিক মর্যাদা ও সম্মানের ভিত্তিতে সবকিছু হতে হবে।”
সূত্র: সমকাল।