ডিসেম্বর ২৬, ২০২৩, ১২:৩৯ এএম
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সকল প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে নির্বাচন কমিশন। ২৯টি রাজনৈতিক দল অংশ নিলেও দেশের অন্যতম বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি অংশগ্রহণ করবে না বলে জানায়। ফলে বর্তমান পরিস্থিতিতে নির্বাচন কমিশনের করণীয় কী আর নির্বাচন আদৌ গ্রহণযোগ্য হবে কি না সে বিষয়ে বিস্তারিত আলাপ হয় সাবেক নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজের সাথে। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দ্য রিপোর্ট ডট লাইভের প্রতিবেদক অভিশ্রুতি শাস্ত্রী।
প্রশ্ন : বিএনপি নির্বাচনে না আসায় নির্বাচন কমিশনের কোনো ভুল আছে?
শাহনেওয়াজ : দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপিকে আনার চেষ্টা করেছিলাম। বিএনপি মোটামুটি একই কারণে অর্থাৎ বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে আসবে না সেজন্য আসেনি। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিলেও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিবে না বলে জানায়। বর্তমানে সংবিধানের যে নিয়ম আছে,সরকার পদত্যাগ করার কোনো আইন সেখানে নেই। বিএনপি ও আওয়ামী লীগে নিঃসন্দেহে দেশের দুটি বড় রাজনৈতিক দল। এখন দুই দল দুই মেরুতে আছে। তাদের মধ্যে কোনো আলাপ-আলোচনা হয়নি। বিদেশ থেকেও চেষ্টা করা হয়েছে কিন্তু কোনো ফল পাওয়া যায়নি। এখন যে অবস্থায় আছে বিএনপিকে ছাড়াই নির্বাচন হবে।
প্রশ্ন : বিএনপির জন্য পুনঃতফসিল করার কথাটা কতটা যৌক্তিক?
শাহনেওয়াজ : বিএনপিকে আনার জন্য নির্বাচন কমিশনও বলেছেন তারা পুনঃতফসিল করবে। তাতেও সাড়া মেলেনি। এখন ধরে নিতে হবে যে ২৯টা যে দল আছে তাদের নিয়েই নির্বাচন হবে। ৪৪ দলের বাকি কেউ থাকবে না। তবে বাকি সবাই থাকলে নির্বাচনের আলাদা একটা উৎসবমুখর পরিবেশ থাকতো। সেটা আর হলো না বরং হরতাল এবং অবরোধ ঘটিয়ে বিভিন্ন জানমালের ক্ষতি করছে বিএনপি এবং সমমনা দল।
প্রশ্ন : দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিএনপি না আসায় আক্ষেপের কথা বলেছিলেন?
শাহনেওয়াজ : নির্বাচনে ৪৪টা দল নিবন্ধিত হয়েছিল। নিবন্ধিত হয় নির্বাচন করার জন্য। নিবন্ধিত দলগুলোর মধ্যে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি নিঃসন্দেহে বড় দুটি দল। তাদের অবস্থান ও কাছাকাছি যদি দুই দলের ভোটার সংখ্যা গণনা হয় তবে ওটাও কাছাকাছি আসবে।
নির্বাচনে বড় দুই দলের এক দল না থাকলে নির্বাচন তো সুন্দর হয় না। এই আক্ষেপ তো থাকবেই। সব দল আসলে একটা সুন্দর নির্বাচন হবে। জনগণও তাদের পছন্দমতো প্রতিনিধি বেছে ভোট দিতে পারতো। এখন দেখা যাবে অনেক ভোটার নির্বাচনে ভোট দিবেন না। বিএনপির অনেক নেতা আছে যারা আছে তারা কিন্তু এমপি হতে পারতো। তারা বাদ পড়ে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ কিন্তু এখন পুরোদমে কাজ করে যাচ্ছে। তাদের সব নেতাকর্মী কিন্তু এমপি মন্ত্রী হিসেবে আছেন।
বলতে গেলে আওয়ামী লীগ এককভাবে বড় দল হিসেবে নির্বাচনী কাজকর্ম করছে। অন্যান্য দল- জাতীয় পার্টি বা যারা আছেন তাদের অবস্থান এতটাও শক্ত নয় যে তারা এককভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নির্বাচন করতে পারবে বলে আপাতদৃষ্টিতে আমার মনে হচ্ছে না। অন্যান্য দল তো ছোটখাটো দল তাদের দুই একজন নেতা আছেন।
তাই আক্ষেপটা হলো প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীনতার আক্ষেপ, আক্ষেপ হলো সব ভোটার তাদের ভোট না দিতে পারার আক্ষেপ, আক্ষেপ হলো এই নির্বাচনকে আমরা উৎসবমুখর পরিবেশে দেখতে পেতাম সেইটা হচ্ছে না, বিরাট অংশ নির্বাচনে আসছে না। কাজেই আইনসঙ্গত নির্বাচন হবে অবশ্যই। আইনের কোনো ধারা বাদ যাবে না। কিন্তু ইনক্লুসিভ যে ইলেকশন সেটা হলো না, সেই আক্ষেপ তো থেকেই যায়।
প্রশ্ন : বিএনপি না আসায় নির্বাচন কমিশনের কোন দায় আছে কি?
শাহনেওয়াজ : দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও যে বিএনপির নির্বাচনে না আসার পুনরাবৃত্তি হলো- এইখানে আসলে নির্বাচন কমিশনের কিছু করার নেই। নির্বাচন কমিশন আসলে একটা নিরপেক্ষ নির্বাচন করবে যেন নির্বাচনের সময় কোনো ঝামেলা না হয়। আর নির্বাচন কমিশন আসলে কিছু করতেও পারে না। রাজনৈতিক এই ইস্যুতে নির্বাচন কমিশনের কিছু করার ক্ষমতা নেই। নির্বাচন কমিশন বললেই কেউ রাজি হয়ে যাবে এমন কিছু আসলে হয় না। কোনো কথা বললে ক্ষমতাসীন দল রাজি হবে না, কোনো কথা বললে বিএনপি রাজি হবে না। তাহলে দেখা যাচ্ছে কোথাও কেউ নির্বাচন বয়কটও করবে না আবার কেউ নির্বাচনে আসবেও না। এখন আমার মনে হয় নির্বাচন কমিশনের সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যা কিছু করা উচিত সেইভাবেই এগিয়ে যাচ্ছেন তারা।
প্রশ্ন: প্রার্থীদের শোকজ দেয়াটা কি আইওয়াশ?
শাহনেওয়াজ : এটা কোনো আই ওয়াশ না। এ ধরনের ধারণা একেবারেই ঠিক নয়। নির্বাচনী শোকজ বিভিন্ন কারণে হতে পারে। প্রার্থীকে তখনই শোকজ করে যখন নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন হয় কোনো কারণে। আচরণবিধি নিয়ম লঙ্ঘন হলে শোকজ হতে পারে, ফাইন হতে পারে, কিন্তু নির্বাচনী আচরণবিধির ধারা অনুযায়ী কোনো মারাত্মক আচরণ করলে নির্বাচন কমিশন প্রার্থিতা বাতিল করে দিতে পারে। সাবেকীয় নির্বাচনী ধারায় কেউ নিয়ম লঙ্ঘন করলে পঞ্চাশ হাজার টাকা জরিমানা সহ ছয় মাসের জেলও দেওয়া হতো। তবে যে বা যারা এই ধরনের নিয়ম লঙ্ঘন করতেন তাদের প্রথমদিকে একটা সুযোগ দেওয়া হয় আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য। এই অবস্থায় অনেকেই উপস্থিত হয়ে নিজের ভুল স্বীকার করে পরবর্তীতে আর কখনো করবে না এই ধরনের প্রতিজ্ঞা করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের অপরাধ ছোট হলে মাফ করে দেওয়া যায়। এটা হার্ড অ্যান্ড ফাস্ট রোল নয় যে শোকজ করেই শাস্তি দিতে হবে, তাহলে তো বোঝাই গেলো শাস্তি হবে।
আর নির্বাচন যেহেতু জনগণের ভোটে হবে, সেটাকে গুরুত্ব দেওয়ার জন্য শোকজ করা। প্রার্থীকে মূল বিষয়টা বোঝানো, নির্বাচনের নিয়মগুলো মেনে চলে যে তাদের নির্বাচন করতে হবে এটাই মূলত শোকজের অর্থ। শোকজ করলেই যে কাউকে শাস্তি দিতে হবে এমনটা নয় আবার ছেড়ে দিবে এমনও নয়।
অনেক সময় দেখা যায় বিভিন্ন অর্থদণ্ড করা হয় তবে জেল পর্যায়ে যাওয়ার নমুনা নেই। এটা এক ধরনের সতর্কবার্তা বলতে পারেন। আসল উদ্দেশ্য হলো নির্বাচনকে সুষ্ঠু করা।
প্রশ্ন : বিশ্লেষকদের মতে ছকবাঁধা পথে হাঁটছে এবারের নির্বাচন। এ মন্তব্যে কি একমত?
শাহনেওয়াজ : আমি মনে করি এবারের নির্বাচনে যে নিয়ম আছে এটা যথেষ্ট সুন্দর নিয়ম। বিশেষ কোনো বিধান বা বিশেষ কোনো সিস্টেম আছে বলে মনে করি না। সব দলকেই যে নিয়ম-কানুন আছে এই নিয়মগুলো মানলেই এবং যারা আছেন এই নিয়ম মানলেই সুন্দর একটা নির্বাচন হবে। আর কোনো উন্নতি দরকার আছে বলে আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় না। নির্বাচিত হওয়ার জন্য বা প্রার্থী হওয়ার জন্য যে গুণাবলী থাকা দরকার সেগুলো মেনে চললেই হবে। প্রার্থী হোক বা ভোটার সবাইকে নিজ নিজ দায়িত্ব মেনে চলতে হবে। নির্বাচনের সময় নির্বাচনী আইন মেনে চলতে হবে তাহলেই হবে।
প্রশ্ন : তাহলে তো নির্বাচন একই গঁৎবাধা অনুযায়ী হচ্ছে?
শাহনেওয়াজ : নির্বাচন তো একই নিয়মে হবে । আওয়ামী লীগ সরকার পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্বাচন করে এইটা পুরোটাই অর্থহীন কথা। নির্বাচনী আইন আছে, প্রত্যেকটা সরকার নির্বাচনী আইন অনুসারে পাঁচ বছর থাকবে। এবং পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর নব্বই দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে হবে। তাই এইখানে আসলে পরিকল্পনা বা গঁৎবাধা নির্বাচনের কিছু নেই ।
বিশ্লেষকরা যা বলছেন তার কোনো ভিত্তি আছে বলে আমি দেখছি না। আমাদের দেশে নির্বাচনী আইন আছে যে নির্বাচনী ব্যবস্থা আছে সব কিছু সুন্দর আছে। নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়েও কিন্তু কেউ কোনো সরাসরি দোষ তুলে দিতে পারবে না। একটা বিষয় হলো বর্তমান সরকার থাকবে কি থাকবে না। এটার একটা সংবিধান আছে সংবিধান তখনই পরিবর্তন হয় যখন কোনো সরকার ওই সময়ে ক্ষমতাসীন থাকে। সংবিধানের নিয়ম অনুযায়ী সরকার আছে। যেসব দল সংবিধানের নিয়ম অনুযায়ী কাজ করছে না তাদের ভুলের কারণেই অন্যদল দেখা যাচ্ছে ভোট বেশি পেয়ে যায়। তখন দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন আইন প্রণয়ণ করা হয়।
প্রশ্ন : পোস্টাল ব্যালট ভোট নিয়ে কি কমিশন প্রস্তুতি নিয়েছিল?
শাহনেওয়াজ : পোস্টাল ব্যালট ভোট নিয়ে কোনো ধরনের তথ্য পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ বলেন, এটা কোনো কথা হতে পারে না। ব্যালটের বিভিন্ন নিয়ম আছে। যারা নির্বাচনী কাজে ঐদিন ব্যস্ত থাকে অথবা যারা দেশের বাইরে আছেন অথবা এমন এক জায়গায় আছেন যেখানে থেকে ভোট নেওয়ার ব্যবস্থা নেই তাদের জন্য মূলত পোস্টাল ব্যালট। পোস্টাল ব্যালট করার জন্য পনেরোদিন আগে নোটিশ পাঠানো হতো। রিটার্নিং অফিসারকে খামসহ পোস্টাল ব্যালট পাঠানো হয়। পরবর্তী সময়ে ফর্ম পূরণ করে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তবে নির্বাচন কমিশনে থেকে কেউ যদি বলে সে পোস্টাল ব্যালট সম্পর্কে জানে না তাহলে এটা তা কাজের অসঙ্গতি।
প্রশ্ন : প্রবাসীদের ভোটে উৎসাহী করতে পারেনি ইসি?
শাহনেওয়াজ : কেউ যদি বিদেশ থাকে আর দেশে যখন ভোট হয় এটা আপনা-আপনি ভাবে ভোটারের মাথায় থাকে কিভাবে সে ভোট দেবে এটার জন্য আলাদা কোনো নোটিশের দরকার নেই। আমাদের নির্বাচনি যে ম্যানুয়াল তৈরি হয় তাতে পোস্টাল ব্যালটের আইন আছে। কেউ যদি পোস্টাল ব্যালট ভোট সম্পর্কে না জানে এইটা তার অজ্ঞতা। নিজের অজ্ঞতা কখনোই অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানকে দেওয়ার মানে নেই।
প্রশ্ন : স্বতন্ত্র প্রার্থীদের এক শতাংশ ভোটারের স্বাক্ষর কি প্রয়োজন?
শাহনেওয়াজ : এক শতাংশ ভোটে ভোটারের নাম স্বাক্ষরসহ থাকতে হবে। সেগুলো অনেক সময় তাড়াহুড়ো করার কারণে নাম লিখে কিন্তু স্বাক্ষর নেই, অন্যকারো স্বাক্ষর নিয়ে নেয়। এক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি হয় । আবার এমনও হয় এক শতাংশ ভোটারের স্বাক্ষর নিয়েছেন কিন্তু স্বাক্ষরকারীরা অপর পক্ষের ভয়ে স্বাক্ষর দিতে অস্বীকৃতি জানায়। এগুলো আমরা খুব শক্তভাবেই হ্যান্ডেল করেছি কিন্তু এইবার যা দেখেছি নির্বাচন আপিলে এইসব ছোট খাট ভুল থাকলেও সিইসি হাবিবুল আওয়াল কিন্তু তা আপিল মঞ্জুর করে দিচ্ছে। কাজেই এইগুলো খুব দোষত্রুটি বলে আমি দেখছি না। রিটার্নিং অফিসার যারা আছেন দুই একটা ভুলের কারণে প্রার্থিতা বাতিল করেছিলেন নির্বাচন কমিশন কিন্তু অধিকাংশ প্রার্থীদের আপিল মঞ্জুর করেছেন।
প্রশ্ন : বিচারপতি খায়রুল হকের রায়ের কারণে কি এই অবস্থার সৃষ্টি?
শাহনেওয়াজ : এ বিষয়ে কথা বলার এখতিয়ার আমার নেই, এগুলো নিয়ে রাজনৈতিক দল কথা বলবে। আরও যারা জ্ঞানী ব্যক্তি আছেন তারা বলবে।