অগ্নিনির্বাপক সরঞ্জাম: গুরুত্ব বাড়লেও কেনার সামর্থ্য হারাচ্ছে মানুষ

নিজস্ব প্রতিবেদক

মার্চ ৭, ২০২৪, ০৮:১৯ পিএম

অগ্নিনির্বাপক সরঞ্জাম: গুরুত্ব বাড়লেও কেনার সামর্থ্য হারাচ্ছে মানুষ

প্রতীকী ছবি

আলোচিত কয়েকটি দুর্ঘটনার পর থেকে বাজারে অগ্নি নির্বাপন উপকরণ কেনার হিড়িক পড়েছে। অগ্নিনির্বাপন যন্ত্র সামগ্রী কেনাবেচার সবচেয়ে বড় মার্কেট রাজধানীর পুরান ঢাকার নবাবপুর।

বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর থেকে বাসা-বাড়ি ও  বিভিন্ন রেস্তোরাঁর সংশ্লিষ্ট অনেকেই মধ্যেই দেখা দিয়েছে সচেতনতা।

পোশাক কারখানা, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি অফিসের জন্য অগ্নিনির্বাপক উপকরণ কিনতে ভিড় বেড়েছে। তবে বাজার ঘুরে দেখা যায়, অগ্নিনির্বাপনের প্রতিটি পণ্যের দামই চড়া।

বেড়েছে সব সরঞ্জামের দাম: রাজধানীর নবাবপুরের এফ কে করপোরেশন, রেইনবো, সেভ অ্যান্ড সেফটিসহ কয়েকটি দোকান ঘুরে দেখা গেছে, বাজারে যেসব অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র বিক্রি হয়, তার একটা বড় অংশ আমদানি করা হয় চীন থেকে। অগ্নিনির্বাপণে সর্বত্র ব্যবহৃত হয় অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র বা ফায়ার এক্সটিংগুইশার, ফায়ার অ্যালার্ম, স্মোক ডিটেক্টর বা হিট ডিটেক্টর। এসব উপকরণ আগুন নেভানোর কাজে ব্যবহার করা হয়।

বর্তমানে বাজারে একটি ফায়ার এক্সটিংগুইশার যন্ত্রের সর্বনিম্ন মূল্য ১৫৫০ টাকা। যা এর আগে বিক্রি হতো ৯০০-১০০০ টাকায়। এছাড়াও বর্তমানে বাজারে হোসপাইপ (১০০ ফুট) বিক্রি হচ্ছে ৪৩০০-১৮০০০ টাকা পর্যন্ত। যেখানে আগে একটি গংবেল (৫ কেজি) বিক্রি হয় ৭০০-৮০০ টাকায় সেটি বিক্রি হচ্ছে ১০৫০-১১৫০ টাকা পর্যন্ত। ফায়ার সাইরেন ১২৫০ টাকা টাকা, ফায়ার বাকেট ৩৫০ আগে যার মূল্য ছিল মাত্র ২০০ টাকা টাকা, অপরিবর্তিত রয়েছে ফায়ার হুক ও গাম বুটের দাম। এর দাম ২০০ টাকা এবং গামবুট ৫০০-৬০০ টাকা।

পুরান ঢাকার নবাবপুর ঘুরে এসব উপকরণের মূল্য সম্পর্কে জানা গেছে। রাজধানীর বিভিন্ন দোকানে বিক্রি হলেও ক্রেতার ভিড় এই মার্কেটকে কেন্দ্র করেই।

ইলেকট্রনিক্স সেফটি অ্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি নিয়াজ আলী চিশতি বলেন, ‘গেল বছরের তুলনায় দাম বেড়েছে ৩০-৪০ শতাংশ আবার কিছু পণ্যের দাম রয়েছে অপরিবর্তিত। এদিকে ফায়ার সার্ভিসের তথ্য দেওয়া বলছে, বছর বছর দুর্ঘটনার সংখ্যা বাড়ছেই। বাড়ছে আর্থিক ক্ষয়ক্ষতিও।’

অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রগুলোকে সাধারণত ৪ ভাগে ভাগ করা হয়েছে-

  • ওয়াটার টাইপ
  • ফোম টাইপ
  • সিওটু (CO2) টাইপ
  • ডিসিপি টাইপ ড্রাই কেমিকেল পাউডার

ফায়ার এক্সটিংগুইশার কোনটি মূল্য কত: নবাবপুরের বেশ কিছু দোকান ঘুরে দেখা যায়, তাইফুন এবিসিই ১কেজি শুকনো পাউডার অগ্নিনির্বাপক যার মূল্য ৭৫০ টাকা। তাইফুন এবিসিই দুই কেজি শুকনো পাউডার এর মূল্য নেয়া হচ্ছে  ৬০০০ টাকা। তাইফুন এইবিসিই ৫০ কেজি শুকনো পাউডার এক্সটিংগুইশার এর মূল্য ১৮০০০ টাকা। তাইফুন এবিসিই ৩ কেজি শুকনো পাউডার এর মূল্য ১৪০০ টাকা। তাইফুন সি ০২-২কেজি গ্যাস ফায়ার এক্সটিংগুইশারের মূল্য ২৭০০ টাকা। তাইফুন এইবিসিই ৫ কেজি শুকনো পাউডার এক্সটিংগুইশার ১৬০০ টাকা। তাইফুন সি ০২ অগ্নি নির্বাপক ৫ কেজি ৪১০০ টাকা। তাইফুন এবিসিই ৬ কেজি শুকনো পাউডার এক্সটিংগুইশার ২,২০০টাকা। তাইফুন এবিসিই ৩০ কেজি শুকনো পাউডার এক্সটিংগুইশার ৫০০০ টাকা। তাইফুন সি ০২ গ্যাস অগ্নি নির্বাপক ৬ কেজি ৪৯০০ টাকা। এএফও অটো অগ্নিনির্বাপক বল-৬৫০-৭৫০ টাকা হলেও এটি এই মুহূর্তে মার্কেটে পাওয়া  যাচ্ছেনা বললেই চলে। কিছু দোকানে পাওয়া গেলেও দাম হাকা হচ্ছে দ্বিগুণ। ফায়ার স্টপ মিনি ফায়ার এক্সটিংগুইশার ৫০০ এমএল স্প্রে বোতলের মূল্য ৩৬০ টাকা। ৬ কেজি অটো অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র (সিলিং এ ব্যাবহার করা হয়) দাম ২৫০০ টাকা।

কীভাবে ব্যবহার করতে হয়: আগুন লাগলে প্রাথমিক অবস্থায় এই ফায়ার এক্সটিংগুইসার প্রয়োগ করতে হয়। এটি একটি মজবুত মেটাল সিলিন্ডার, যার ভেতর পানি বা অদাহ্য অন্য কোনো পদার্থ যেমন- তরল কার্বন ডাই-অক্সাইড, উচ্চ চাপে সংরক্ষিত থাকে। যখন লিভার চেপে সিলিন্ডারের ভাল্ব খোলা হয়, তখন ভেতরে রক্ষিত তরল অ্যারোসলের মতো সজোরে বাইরে বেরিয়ে আসে। যন্ত্র ব্যবহার করার সময় সেফটি পিনটি টান দিয়ে খুলে নিতে হয়।এর হ্যান্ডেল ডান হাতে ধরে বাম হাত দিয়ে টান দিয়ে সেফটি পিন খুলে ফেলতে হবে। এরপর বাম হাতে হোস পাইপ আগুনের দিকে তাক করে ডান হাত দিয়ে চাপতে হয় বাটন বা লিভার।

অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র পরিচালনার সাধারণ ধাপগুলো-

  • প্রথমে সেফটি পিনটি টানতে হবে - 
  • নিরাপদ দূরত্বে থেকে (অন্তত ছয় ফুট দুরে) নজলটি আগুনের মূলে তাক করতে হবে।
  • হাত দিয়ে নজলটি চাপতে হবে।
  • অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রটি আগুনের দিকে তাক করে একপাশ থেকে আরেক পাশে নাড়াতে হবে।

ব্যবহারে সর্তকতা-

  • বাতাসের অনুকুলে ব্যবহার করা।
  • যথাসম্ভব আগুনের কাছাকাছি অবস্থান থেকে ব্যবহার করা।
  • সরাসরি মানুষের শরীরে ব্যবহার না করা।
  • ড্রাই কেমিক্যাল পাউডার ব্যবহারের সময় সাবধানতা অবলম্বন করা যাতে শ্বাস প্রশ্বাসের সহিত শরীরে প্রবেশ করতে না পারে।
  • সিওটু ফায়ার এক্সটিংগুইসার ব্যবহারের সময় ব্যবহারের সময় সর্তকাতার সঙ্গে এর ডিসচার্জ হর্ন ধরা। অসর্তকতার কারণে কুল বার্ন হতে পারে।

বিভিন্ন ধরনের আগুনের জন্য বিভিন্ন রকমের অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র রয়েছে। ভুল রকমের অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র ব্যবহারের ফলে আগুন আরও বাড়তে পারে তাই সঠিক ধরনের অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র ব্যবহার করা উচিত।
দোকানিদের তথ্য বলছে, শতকরা হিসেবে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে হিট ডিটেক্টরের দাম। তুলনামূলক হারে বেড়েছে ফায়ার বলের দাম যা পূর্বে ছিল ৪৫০ টাকা, সেটি এখন বিক্রি হচ্ছে ৭০০ করে। ১০০০-১২০০ টাকার ফায়ার বল এখন ১৫০০-১৬০০ টাকা।’

রাজধানীর নবাবপুরের অলেম্পিয়া ফায়ার সলিউশন নামে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র বিক্রি করা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার মো. মিরান হোসেন বলেন, আমাদের ব্যবসা মূলত আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এর ফলে বাজারে দাম বৃদ্ধি-হ্রাসের ওপরে আন্তর্জাতিক বাজারের বড় একটি প্রভাব থাকে। তবে খুব বেশি বিপদে বা সরকারি চাপে না পড়লে মানুষ সহজে এই পণ্য ক্রয় করতে আসেন না। সম্প্রতি দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় তাদের মধ্যেও একধরনের অনীহা দেখা যাচ্ছে।

কার্বনডাই অক্সাইড, ফায়ার এক্সটিঙ্গুইশার, ফোম এক্সটিঙ্গুইশার, ডি এক্সটিঙ্গুইশার, ফায়ার বল, অগ্নিনির্বাপক উপকরণ ছাড়াও, ভাল্ব, নজেল, ফায়ার এলার্ম, হিট ডিটেক্টর সহ বেশ কিছু পন্যের দাম বেড়েছে। অনেক অগ্নিনির্বাপক পণ্যসামগ্রীই এখন পাওয়া যাচ্ছে না দুই একটা দোকানে পাওয়া গেলেও কিনতে হচ্ছে চড়া দামে।

ওয়ারী এলাকার বাসিন্দা আলো চৌধুরী বলেন, ‘প্রতিনিয়ত চারিদিকে যে হারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে এতে আমরা আতঙ্কিত নিজের এবং পরিবারের সুরক্ষার জন্য হলেও অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র বাসায় রাখার প্রয়োজন মনে করছি। কিন্তু বাজারের যেই পরিস্থিতি এতে করে কেনাটাই দুঃসাধ্য হয়ে যাচ্ছে।’

ফায়ার সার্ভিসের চালানো একটি সমীক্ষা বলছে, রাজধানীর ৯০ শতাংশ ভবন অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে। এর মধ্যে অতি ঝুঁকিপূর্ণ প্রায় ২৩ শতাংশ ভবন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব প্রতিটি ঘটনার পেছনে সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়ের গাফিলতি রয়েছে।

২০২৩ সালে সারা দেশে মোট ২৭ হাজার ৬২৪টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। সে হিসাবে প্রতিদিন গড়ে ৭৭টি আগুনের ঘটনা ঘটেছে। অগ্নিকাণ্ডে সারা দেশে মোট ২৮১ জন আহত এবং ১০২ জন নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া, আগুন নির্বাপণের সময় ৪৮ জন বিভাগীয় কর্মী আহত এবং অগ্নি নির্বাপণে যাওয়ার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় এক জন কর্মী নিহত হন।

নিমতলী, চূড়িহাট্টা, এফআর টাওয়ার, আরমানিটোলা, নিউমার্কেট, মগবাজার বিস্ফোরণ, গুলিস্তান ট্র্যাজেডিসহ একের পর এক ঘটনা ঘটেছে রাজধানীতে। সর্বশেষ এই তালিকায় যুক্ত হয়েছে রাজধানীর বেইলি রোড ট্র্যাজেডি।

Link copied!