রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক মানস

হাসনাত আসিফ কুশল

মে ৮, ২০২৪, ০১:৫৬ পিএম

রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক মানস

গান্ধীজির সান্নিধ্যে রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যেমন আলোচনা আছে, তার সাহিত্য নির্ভর আলোচনা আমাদের কানে আসে, তেমনই তাকে নিয়ে আছে বেশ সমালোচনাও। যারা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে সমালোচনা করেন, তারা ভারতবর্ষ ও বাঙালি সংস্কৃতির অকৃত্রিম শত্রু বলে আমি মনে করি। কেননা রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যকে যা দিয়ে গেছেন তা এখনও পর্যন্ত কোনো সাহিত্যিক দিয়ে যেতে পারেননি। ১৯১৩ সালে এশীয়দের মধ্যে সাহিত্যে প্রথম নোবেল পেয়ে বাংলা সাহিত্যকে বিশ্ব দরবারে উঁচু দরবারে নিয়ে যান এই রবীন্দ্রনাথই। ইতিহাসে আর কোনো সাহিত্যিক বাংলা সাহিত্যকে এভাবে সম্মানিত করতে পারেননি। একই সঙ্গে রবীন্দ্রনাথকে ভারতবর্ষের হেগেল হিসেবেও ধরা হয়। তার রাজনৈতিক পরিচয় তুলে ধরতে গেলে প্রসঙ্গটি সামনে আসে।

‘গোরা’ উপন্যাসে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ গোরা চরিত্রের মধ্য দিয়ে তদানীন্তন কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখিয়েছেন

হেগেল ছিলেন জার্মান দার্শনিক। ১৭৭০ সালের ২৭ আগস্ট জন্ম নেওয়া এই দার্শনিকই জার্মান দর্শন ও ভাববাদের গুরুত্বপূর্ণ একজন। তাকে মার্কসবাদের গুরুত্বপূর্ণ অগ্রদূত হিসেবেও তুলে ধরা হয়ে থাকে। এখন প্রশ্ন হলো, হেগেলের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথকে মেলালাম কেন? প্রকৃত অর্থে রবীন্দ্রনাথ হলেন একাধারে সাহিত্যিক, কবি, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তবে বস্তুবাদীরা রবীন্দ্রনাথকে দার্শনিক বলতে নারাজ। এ প্রসঙ্গে আমাদের সময় ডট কমে ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রাজনৈতিক পরিচয় কী’ নিবন্ধে আহসান হাবীব উল্লেখ করেছেন: ‘রবীন্দ্রনাথকে দার্শনিকভাবে প্রত্যাখান করে বস্তুবাদী চিন্তার লোকেরা। এরা বাম রাজনীতি করা লোক। বেশিরভাগই এরা উগ্র বাম। ভারতবর্ষে বামদলের কর্মকাণ্ড অনুসরণ করলে দেখা যায় যে দলটি সর্বভারতীয় বাম দল বলে পরিচিতি পেয়েছে, তারা আসলে পেটিবুর্জোয়া সমাজতন্ত্রী।’

আরও পড়ুন: রবীন্দ্রনাথের খাদ্য দর্শন

অথচ ১৮৯০ সালে ‘মানসী’ কাব্যগ্রন্থের বেশ কয়েকটি কবিতায় কবি রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক রাজনৈতিক ও সামাজিক ভাবনার সুস্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। এছাড়া ১৯২৫ সালে এক প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ স্বদেশি আন্দোলনকে ‘চরকা-সংস্কৃতি’ বলে বিদ্রুপ করেন তিনি। কঠোর ভাষায় তার বিরোধিতা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কবির চোখে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ছিল- ‘আমাদের সামাজিক সমস্যাগুলোর রাজনৈতিক উপসর্গ’ (জাগো বাংলা)।

গান্ধীজির সঙ্গে অম্ল-মধুর সম্পর্ক ছিল রবীন্দ্রনাথের

প্রকৃত অর্থে রবীন্দ্রনাথ ভারতবর্ষের জনসাধারণের স্বনির্ভরতা ও বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নতির ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। ভারতবাসীকে অন্ধ বিপ্লবের পন্থা ছেড়ে বাস্তব উপায়ে প্রগতিশীল পন্থা গ্রহণেরও আহ্বান জানিয়েছিলেন তিনি (জাগো বাংলা)।
***
রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক ভাবনার প্রতিফলন ঘটেছে তার ‘তাসের দেশ’ গীতিনাট্যে। যেটা তিনি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে উৎসর্গ করেছিলেন। এই নাটকে একটা গান ছিল: ‘তুমি কষে ধরো হাল,/ আমি তুলে বাঁধি পাল’। এটাও রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক ভাবনারই বহিঃপ্রকাশ। রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন ভারতীয় জনসাধারণের মুক্তি, আত্মোন্নতি। সেই কারণেই ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদস্বরূপ তিনি লিখেলেন, ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ গানটি। এই গান লেখার সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয়রা সচেতন হয়ে ওঠে এবং ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে জেগে ওঠে। যার ফলে ১৯১১ সালে আকস্মিকভাবে বঙ্গভঙ্গ রদ করা হয়।

ব্যক্তিগত জীবনে রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত না থাকলেও ভারতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে মাঝেমধ্যে যোগদান করতেন এবং সুচিন্তিত মতামত দিতেন। রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত না হলেও তিনি মনে করতেন, ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামে ভারতীয়দের ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। নয়তো ব্রিটিশদের আজীবন গোলামিই করে যেতে হবে। গান্ধীজির সঙ্গেও ছিল তার সুসম্পর্ক। একবার মহাত্মা গান্ধীকে লিখেছিলেন খোলা চিঠি- ‘আপনার শিক্ষা বিধাতার সাহায্য নিয়ে অহিংসার পথে লড়াইয়ের শিক্ষা। কিন্তু এমন লড়াই শুধু নায়কদের জন্য সম্ভবপর, সাধারণের জন্য নয়। সাধারণ মানুষ মুহূর্তের উন্মাদনায় উদ্দীপ্ত হয় বারবার। তাই অন্যায়ভাবে সে উদ্যম প্রতিহত হলে অপমানজনক সন্ত্রাস আর হিংসা সহজেই সেই লড়াইয়ের পথ হয়ে উঠতে পারে।’

আরও পড়ুন: রবীন্দ্রনাথের বড় পরিবার: ঠাকুর বাড়ি কথা

এগুলো রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক ভাবনার প্রতিফলন হিসেবে চিহ্নিত। এছাড়া ‘গোরা’ উপন্যাসে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ গোরা চরিত্রের মধ্য দিয়ে তদানীন্তন কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখিয়েছেন। এগুলো সামাজিক ভাবনা হলেও সুদূরপ্রসারী অর্থে এক ধরনের রাজনৈতিক ভাবনারই বহিঃপ্রকাশ। অনেকে গোরাকে ডিরোজিওর সঙ্গেও তুলনা করেন। ব্রিটিশ ভারতবর্ষে যিনি ছিলেন ইয়ংবেঙ্গলের স্রষ্টা। তখনকার দিনে ব্রাহ্মণরা ছুতমার্গ অনুসরণ করতেন। আর ডিরোজিও ও তার শিষ্যরা ব্রাহ্মণদের এসব কর্মপন্থাকে কটাক্ষ করতেন। রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ উপন্যাসে এসবই উঠে এসেছে। সেদিক থেকে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ একেবারেই ভিন্ন মেরুর উপন্যাস। এতে হিন্দু জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখানো হয়েছে যেমন, তেমনই রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছেন ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের স্বপ্ন।

ইতিহাসে আর কোনো সাহিত্যিক বাংলা সাহিত্যকে এভাবে সম্মানিত করতে পারেননি। একই সঙ্গে রবীন্দ্রনাথকে ভারতবর্ষের হেগেল হিসেবেও ধরা হয়। তার রাজনৈতিক পরিচয় তুলে ধরতে গেলে প্রসঙ্গটি সামনে আসে

রবীন্দ্রনাথের কলমে বারবার অসাম্প্রদায়িক ভারতের স্বপ্ন উঠে এসেছে। ১৮৬১ সালে জন্ম নেওয়া এই সাহিত্যিক রাজনৈতিক ভাবনায়ও ছিলেন সিদ্ধহস্ত। ঠিক এ কারণেই গান্ধীজির সঙ্গে ছিল তার অম্ল-মধুর সম্পর্ক। তাদের দুজনের দর্শনে ‘আকাশ-পাতাল ফারাক থাকলেও’ তারা একে অপরকে শ্রদ্ধা করতেন।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক চেতনার প্রতিফলন ঘটে ১৯১৯ সালে নাইট উপাধি ত্যাগের মধ্য দিয়ে। পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের পর বড়লাট লর্ড চেমসফোর্ডকে এক চিঠিতে বলেন, ‘আমার এই প্রতিবাদ আমার আতঙ্কিত দেশবাসীর মৌনযন্ত্রণার অভিব্যক্তি’ (জাগো বাংলা, পত্রদূত)। রবীন্দ্রনাথ উগ্র জাতীয়তাবাদী ছিলেন না, কিন্তু ঠাকুর বাড়ির দরজা ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র বিপ্লবীদের জন্যও খোলা ছিল। তারা নিয়মিত রবীন্দ্রনাথের কাছে আসতেন। মতবিনিময় করতেন। সব মিলিয়ে এ কথাই বলা যায়, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো হিন্দু জাতীয়তাবাদী ছিলেন না রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ছিলেন আদর্শ স্বদেশপ্রেমী, ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সমর্থক। অন্ধ দেশপ্রেম ছিল তার স্বভাববিরুদ্ধ। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বঙ্কিমের রাজনৈতিক ভাবনার পার্থক্য না হয় আগামী দিনের জন্য তোলা থাক।

লেখক: সাংবাদিক ও ইতিহাস বিশ্লেষক

Link copied!