একজন খবরবাউল মোনাজাতউদ্দিন

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

ডিসেম্বর ৩০, ২০২১, ০১:৫৩ এএম

একজন খবরবাউল মোনাজাতউদ্দিন

কৈশোরে যখন পত্রিকার নতুন পাঠক হয়ে উঠছি সবে, সেইকালেই সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিন নামটা বহুবার শোনা হয়ে গেল। তার নামের আগে ‘চারণ সাংবাদিক’ শব্দবন্ধটা আরও কৌতূহল জাগালো আমাদের কিশোরমনে। তখন হয়তো বুঝিনি চারণ সাংবাদিকের মানে কী, পরে বুঝেছি; এই শব্দবন্ধটির গভীরতা অতলান্তিকের মতন। এই অভিধা মোনাজাতউদ্দিনের সাথেই যায়। যেমনটা কবি হিসেবে চারণ শব্দটি যায় মুকুন্দ দাসের সাথে। সদ্যপ্রয়াত কথা সাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক যেমন বলেছিলেন, "পথে পথে হেঁটেই মোনাজাতউদ্দিন কোটি কোটি মানুষের এক গোয়ের্নিকা রচনা করে গেছেন।"

monajat
খবরের সন্ধ্যানে কোনো এক দূর পল্লীতে মোনাজাতউদ্দিন। ছবি: সংগৃহীত

আমাদের দেশের মিডিয়া কর্তা এবং নগরের সাংবাদিকরা ‘মফস্বল সাংবাদিকতা’ কথাটা শুনলে কেউবা প্রকাশ্যে, কেউবা গোপনে তাচ্ছিল্য করেন। মফস্বল সাংবাদিক ও সাংবাদিকতার প্রতি এই উন্নাসিক মানসিকতা বহুকাল ধরে চলে আসছে। এখনও আছে। তবে সেই চিন্তায় বড় রকমের বদল ঘটিয়েছিলেন সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিন নামের এক মফস্বল সাংবাদিক। সততা, সৎ সাহস এবং বেদম পরিশ্রম— এই তিনের মিশেলে তিনি তৈরি করেছিলেন এক অনন্য উদাহরন। সাংবাদিকতায় সবচেয়ে বেশি যে গুণটি দরকার, সেই প্যাশনকে তিনি ধারণ করেছিলেন মনেপ্রাণে। সাংবাদিকতা তার পেশার চেয়ে বরং নেশায় পরিণত হয়েছিল। সংবাদের খোঁজে তিনি বিবাগী হয়ে ‘দেশান্তরী’ হয়ে পথে নেমেছিলেন। নিজের ‘দেশ’ রংপুর ছেড়ে খবরের সন্ধ্যানে নানা জনপদে দিনের পর দিন চষে বেড়িয়েছেন তিনি। এই খবরবাউলের কলমে ‘বাতাবি নেবুর ফলন বৃদ্ধির’ চেয়ে নিস্ফলা জমিনে কৃষকের কষ্টগাঁথা, ন্যায্যমূল্য না-পাওয়ার হাহাকার এসবই উঠে আসতো বেশি ক’রে। সমাজ-জীবনের দগদগে ঘা, প্রশাসনের ঘাপলা, সুবিধাভোগীর দাপট, নিরন্ন মানুষের বাঁচবার লড়াই— এসবই ছিল রিপোর্টের বিষয়।

সংবাদপত্র যে সমাজের দর্পণ, সেই দর্পণে সঠিক দৃশ্য ধরার কাজে নিরন্তর কাজ করে গেছেন তিনি। এসব সংবাদের কোনোটি পড়ে পাঠক হয়ত প্রথমে লজ্জায় বা মনোবেদনায় মাথা নিচু করেছেন, কিন্তু পরক্ষণেই নিজ শিরদাঁড়াটা টানটান করে প্রতিবাদ-বিক্ষোভে হাত মুস্টিবদ্ধ করেছেন। এখানেই একজন সাংবাদিকের সাফল্য। পেশার প্রতি এমন নিবেদিতপ্রাণ সাংবাদিক এ যুগে বিরল।

রুশ লেখক মায়াকোভস্কিকে একবার একদল লেখাপড়া না-জানা শ্রমিক জিজ্ঞেস করেছিল, তিনি যে শ্রমিকদের পক্ষে লেখেন, তার প্রমাণটা কী? মুখে কোনো জবাব না দিয়ে মায়াকোভস্কি তার ফর্সা হাত দুটোর কব্জি থেকে শার্টের বোতাম খুলে গুটিয়ে তাদের দেখিয়েছিলেন তার কড়া-পড়া কালো হয়ে যাওয়া নিজের কুনুই দুটো। তিনি বলেছিলেন, তোমরা যেমন শ্রমিক। আমিও তেমনই একজন শ্রমিক, বিদ্যা-শ্রমিক। মায়াকোভস্কির মতো মোনাজাতও বলেছিলেন: ‘আমি শ্রমিক, লিখে খাই। কর্তৃপক্ষ কিছু টাকার বিনিময়ে আমার শ্রম কেনেন। আমি এটা বুঝি। তবুও ‘সিনসিয়ার’ হবার চেষ্টা করি। (পথ থেকে পথে: ১৯৯১: পৃষ্ঠা ১১১)। এই যে সিনসিয়ার বা আন্তরিক হবার দায়বদ্ধতা— এটিই সাংবাদিকতার প্রাণ। এই দায়বদ্ধতা মোনাজাতের ছিল ষোলোআনা। এ ক্ষেত্রে এক বিবেচনায় মায়াকোভস্কির চেয়ে বরং মোনাজাতই এগিয়ে থাকবেন; আর সেটি হল: মোনাজাতের দায়বদ্ধতার বুনিয়াদ মায়াকোভস্কির মতো পুঁথিগত বিদ্যা থেকে উৎসারিত নয়, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার জারণে তিলে তিলে অর্জিত গুণ। মোনাজাত সেল্ফ-মেড, একান্তই স্বনির্মিত। এই স্বনির্মিত দায়বদ্ধতার রসায়নে মোনাজাত প্রান্তিক ও কেন্দ্রীয় সাংবাদিকতাকে জারিত করে ফেলেছিলেন।

যে খবর জনমনে আগ্রহের সৃষ্টি করে, পাঠকের কৌতূহলী মন সে সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে চায়। উৎসুক হয়ে ওঠে সেই খবরের নেপথ্য কাহিনী বা সেসব তথ্য যার কারণে ঘটনাটির সূত্রপাত। আর এসব তথ্য বা সংবাদই নেপথ্য সংবাদ, শেকড় সংবাদ বা অনুসন্ধানী প্রতিবেদন। মোনাজাত সেই ‘নেপথ্য সংবাদ’ আর ‘শেকড় সংবাদের’ জন্যই দিনমান নিরন্তর খেটে গেছেন। ‘নেপথ্য সংবাদ’ শব্দটিকে তিনি পাঠকের কাছে করে তুলেছিলেন জনপ্রিয় ও অনিবার্য। এখানেই ক্ষান্ত দেননি, এ বিষয়ে তিনি বেশকিছু বইও লিখেছেন যার একটির নাম ‘সংবাদ নেপথ্য’।

Monajaat thereport

‘সংবাদ’-এর বার্তা সম্পাদক প্রখ্যাত কলামিস্ট সন্তোষ গুপ্ত যথার্থই লিখেছেন, “মোনাজাতউদ্দিনের সংবাদ সংগ্রহের স্টাইল ও নিষ্ঠা একে অপরের সাথে জড়িয়ে গিয়েছিল; কোথাও ভঙ্গী দিয়ে চোখ ভোলানোর আয়োজন ছিল না। অনুসন্ধানী প্রতিবেদন, ফলোআপ প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি অনন্যতার স্বাক্ষর রেখেছেন। গ্রাম বাংলার জনজীবনের একটা নিখুঁত তথ্যনির্ভর এবং একই সঙ্গে সংবেদনশীল দৃষ্টিকোন থেকে দেখা ও চিত্ররূপময় বর্ণনা এবং চিত্র তিনি দেশবাসীকে উপহার দিয়েছেন খবরের মাধ্যমে। তাঁকে ‘চারণ সাংবাদিক’ অ্যাখ্যাদান যথার্থ। এই একটি অভিধাতেই তাঁর সাংবাদিকতার বৈশিষ্ট্য ও অনন্যতা ধরা পড়ে।”

এ দেশে অঞ্চলভেদে কোনো-কোনো সাংবাদিক মফস্বলের গণ্ডি ডিঙিয়ে নিজেকে জাতীয় পর্যায়ে তুলে ধরতে পেরেছেন। সংখ্যাটা হাতেগানা। দৈনিক সংবাদের উত্তরাঞ্চলীয় প্রতিনিধি মোনাজাতউদ্দিন ছিলেন এদের মধ্যে অগ্রণী। ৫০ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবনে বিশ বছর একটানা ‘সংবাদ’-এ কাজ করার পর তিনি দৈনিক জনকন্ঠে সিনিয়র রিপোর্টার হিসেবে যোগদান করেছিলেন, ১৯৯৫ সালের ২৪ এপ্রিল। মৃত্যুর সময় পর্যন্ত তিনি সেখানেই কর্মরত ছিলেন।

সংবাদের নেপথ্য রহস্য উদঘাটনের জন্য সারাজীন যিনি নিজেকে বিলিয়ে দিলেন, সেই মানুষটির মৃত্যুও হয়েছিল রহস্যময় এক ঘটনায়। ১৯৯৫ সালের ২৯ ডিসেম্বর বাহাদুরাবাদ-তিস্তামুখ ঘাটের তেলচুরির ওপর অনুসন্ধানীমূলক রিপোর্ট করতে গিয়ে তিনি নিহত হন। তার পরিবার ও সহকর্মীদের পক্ষ থেকে সে সময় অভিযোগ করা হয়েছিল, সেখানকার শক্তিশালী তেলচোর সেন্ডিকেটের সদস্যরা মোনাজাতকে ফেরির স্টিমারের উপর থেকে ধাক্কা দিয়ে যমুনায় ফেলে দেয়। ফলে ঘটনাস্থলে তার মৃত্যু হয়। একজন সংবাদঅন্তপ্রাণ সাংবাদিকের এভাবেই জীবনাবসান ঘটে।

দেশের সাংবাদিকতায় এখন ক্রান্তিকাল চলছে। এমন সময়ে মোনাজাতউদ্দিনের মতো সাংবাদিকদেরকে নতুন প্রজন্মের কাছে বেশি করে তুলে ধরার দরকার ছিল। কিন্তু সেরকম কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ে না। আর সে কারণেই এ প্রজন্মের সাংবাদিকরা মোনাজাতকে চেনেনও না। কী মফস্বল, কী রাজধানী ঢাকা— সবখানেই সাংবাদিকতার ক্ষয়িষ্ণু দশা। সর্বত্রই অবক্ষয়। অর্থাৎ সর্বত্র চলছে জোড়াতালির এক অসাংবাদিকতা-অপসাংবাদিকতার সংস্কৃতি। দেশে বেশুমার সংবাদপত্র। সেইসাথে যুক্ত হয়েছে ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া, অনলাইন নিউজ পোর্টাল, নেট টেলিভিশন, বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ইত্যাদি। এতে সংবাদক্ষেত্রের আকার বেড়েছে, সংবাদের সংখ্যাও বেড়েছে। গুণগত মান কি বাড়লো তাতে? কোথায় মোনাজাতের মতো সংবাদঅন্তপ্রাণ সাংবাদিক? কোথায় খবরের নেপথ্য রহস্যসন্ধ্যানে নামা ‘দেশান্তরী’ সাংবাদিক? নেই! কেন নেই- নিজেদের বর্তমান অবস্থান জানার জন্য হলেও এ যুগের সংবাদকর্তা ও সাংবাদিকদের সে ব্যাপারে খোঁজখবর নেওয়ার দরকার আছে বৈকি।

লেখক: সম্পাদক, দ্য রিপোর্ট

 

 

Link copied!