রাষ্ট্রভাষা একটি থাক, আঞ্চলিকতা স্বীকৃতি পাক

সম্পা আক্তার

ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২৪, ০৪:৫২ পিএম

রাষ্ট্রভাষা একটি থাক, আঞ্চলিকতা স্বীকৃতি পাক

সংগৃহীত ছবি

মানুষের মনের ভাব প্রকাশ করার একটি বাহন হচ্ছে ভাষা। মানুষ যে অঞ্চলে বেড়ে ওঠে এবং মনের ভাব প্রকাশ করার জন্য যে ভাষায় কথা বলে সেই ভাষাকে আঞ্চলিক ভাষা বলা হয়। রাষ্ট্রভাষা হল এমন একটি ভাষা যা কোনো নির্দিষ্ট দেশ বা রাষ্ট্রে ব্যবহারের জন্য সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত ও বলবৎকৃত। তবে অঞ্চল বা রাষ্ট্রভেদে ভাষার ভিন্নতা রয়েছে। বাংলাদেশে এমন ভাষার সংখ্যা ৪২টি। এসব ভাষাকে যদি রাষ্ট্রভাষা করা হতো তাহলে কেমন হতো? আমার মতে, রাষ্টীয়ভাবে এত ভাষার ব্যবহার বা আত্মস্থ করা কঠিন হয়ে যেত। তাই অনেক ভাষার পরিবর্তে একটি মাতৃ রাষ্ট্রভাষা রাখা সুবিধাজনক।

একটি দেশের রাষ্ট্রভাষা সেই দেশের মানুষের মুখের ভাষা হতেও পারে নাও হতে পারে। কারণ রাষ্ট্রভাষা সবসময় ব্যাকরণগত নিয়ম দ্বারা পরিচালিত। অন্যদিকে আঞ্চলিক ভাষার কোনো নির্দিষ্ট উচ্চারণ, ব্যাকরণ, শব্দভান্ডার থাকে না কারণ এটি একটি নির্দিষ্ট ভৌগলিক অঞ্চলে বা কোনো বিশেষ গোষ্ঠি দ্বারা কথিত ভাষার একটি সংস্করণ। অঞ্চল ভিত্তিক মানুষের মুখের ভাষায় অনেক পার্থক্য দেখা যায়। তাই বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় লিখিত ফর্মগুলো যদি আঞ্চলিক ভাষায় সংবিধান অনুযায়ী লেখার অনুমোদন থাকত, তাহলে এই ব্যতিক্রম অনেকগুলো ভাষা শিখতে মানুষের আরও বেশি সমস্যা হত। কারণ এই ভাষাগুলোর কোন নির্দিষ্ট নিয়ম না থাকায় প্রতিষ্ঠানগুলোতে বহু ভাষার ব্যবহার মানুষের মধ্যে দেখা যেত। যা রাষ্ট্রীয় বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করত।

 তবে আঞ্চলিক ভাষা কোনোভাবেই বিকৃত ভাষা নয়। বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থার কথা বিবেচনা করলে বেশির ভাগ মানুষ আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে। বরিশাল, নোয়াখালী, সিলেট, চট্টগ্রাম রাজশাহী সহ নানা অঞ্চলের ভাষা, একেটি একেক রকম। এছাড়া, আদিবাসীদের প্রধান কথ্য ভাষা বা মাতৃভাষাও বাংলা নয়। তবে কাজের প্রয়োজনে শুদ্ধ বাংলা শিখতে হয়। ভাষার মানদন্ড অনুযায়ী রাষ্ট্র আদিবাসীদের ভাষা বা আঞ্চলিক  ভাষাকে সংবিধানিক ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেয় না। ভাষার মানদন্ড বলতে মূলত ভাষার ‍‍`বিশুদ্ধতা‍‍` বোঝায়। যা ওই ভাষার ব্যাকরণ, বানান, শব্দকোষ, এবং সাহিত্যের ব্যাপার বিবেচনা করে গঠিত হয়।

তবে কিছু ক্ষেত্রে ভাষার মানদন্ড মাথায় রেখে শুদ্ধ এবং আঞ্চলিক ভাষা নিয়ে অনেক সময় ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে পক্ষপাতের সৃষ্টি হয় যা অনেক সময় বৈষম্যের সৃষ্টি করে। যেমন: বাংলাদেশ বহু ভাষাভাষী দেশ হওয়া সত্ত্বেও অনেক মানুষ চাইলেই রাষ্টীয় প্রতিষ্ঠান গুলোতে তাদের আঞ্চলিক ভাষা ব্যাবহার করতে পারছে না। কারণ মানুষ তাদের ভাষাকে স্বাভাবিক ভাবে নিচ্ছে না। এছাড়া, বিভিন্ন স্কুল বিশ্ববিদ্যালয়সহ রাষ্ট্রের অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে ইংরেজির ব্যাবহার চোখে পড়ার মতো হলেও, দেশের আঞ্চলিক ভাষা গুরুত্ব হারাচ্ছে দিন দিন। চাকরির সাক্ষাৎকারেও কেউ আঞ্চলিক ভাষায় কথা বললে আমরা তাকে প্রাধান্য দেই না। এছাড়া, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শুদ্ধ বাংলা ব্যতিত অন্য কোনো আঞ্চলিক ভাষায় লিখিত কাগজও গ্রহণযোগ্যতা না পাওয়া স্বাভাবিক, তবে কোন শিক্ষার্থী অঞ্চলিক ভাষায় কথা বললে অন্য সবাই তাকে আলাদা দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখে সেটা অস্বাভাবিক। বাংলাদেশের ৯৮ শতাংশ মানুষের মাতৃভাষা কেবলমাত্র স্ট্যান্ডার্ড বাংলা বা তথাকথিত ‘শুদ্ধ বাংলা’ নয়। তাই, স্বাধীন রাষ্ট্রে কথা বলতে তাদের শুদ্ধ বাংলা নিয়ে ভাবতে হয়, যা কষ্টকর।

বাংলাভাষা আরবি, পর্তুগিজ, ফার্সি এবং আরও কয়েকটি ভাষার শত শত শব্দের সংমিশ্রণে তৈরি। বিগত কয়েক দশক ধরে, বহু ইংরেজি শব্দ বাংলা শব্দভাণ্ডারেও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তবে একাত্তরের স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ বহুল জনসংখ্যার জনসংখ্যার একটি দেশে পরিণত হয়েছে। এখানকার প্রাতিষ্ঠানিক ভাষা যদি একাধিক হয় তাহলে ভাষা নিয়ে বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হবে। তাই  অনেক ভাষার পরিবর্তে একটি মাত্র রাষ্ট্রভাষা সংবিধান স্বীকৃতি দেয়া আমাদের জন্য গর্বের।

লেখক: সাংবাদিক

Link copied!