বিরোধী দলে নয়, সরকারের সঙ্গে জোটে আগ্রহ স্বতন্ত্র প্রার্থীদের

মাহাবুব আলম শ্রাবণ

জানুয়ারি ২৭, ২০২৪, ১১:১৭ পিএম

বিরোধী দলে নয়, সরকারের সঙ্গে জোটে আগ্রহ স্বতন্ত্র প্রার্থীদের

ছবি: দ্য রিপোর্ট ডট লাইভ

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকার প্রার্থীদের সাথে লড়াইয়ে দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয় পেয়েছে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা, যা দেশের নির্বাচনী ইতিহাসে নজিরবিহীন। ভোটের মাঠে প্রধান বিরোধী দলের অনুপস্থিতির সুযোগে আওয়ামী লীগের নেতারাই লড়েছেন নৌকার বিরুদ্ধে। কিন্তু আসন জয়ে এগিয়ে থাকলেও সংসদে বিরোধী দল হচ্ছে জাতীয় পার্টি।

বিএনপির ভোট বর্জনে এবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার সুযোগে আওয়ামী লীগের নেতারাই নৌকার বিরুদ্ধে লড়েছেন এবার। তারাসহ স্বতন্ত্র ৪৩৬ জনের মধ্যে ৬২ জন বিজয়ী হয়েছেন। এদের ৫৯ জন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা।

বাকিদের মধ্যে দুজন সরাসরি দলীয় রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাদের একজন মোহাম্মদ সিদ্দিকুল আলম। জাতীয় পার্টির মনোনয়ন না পেয়ে নীলফামারী-৪ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে বাজিমাত করেছেন। স্বতন্ত্র হয়ে জেতা আরেকজন সৈয়দ এ কে একরামুজ্জামান বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা ছিলেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ (নাসিরনগর) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ায় তাকে বহিষ্কার করে বিএনপি। আর সিলেট-৫ (জকিগঞ্জ ও কানাইঘাট) আসনে নৌকাকে হারিয়ে জয় পেয়েছেন ধর্মভিত্তিক সংগঠন আঞ্জুমানে আল ইসলাহ’র সভাপতি মোহাম্মদ হুছাম উদ্দিন চৌধুরী।

জাতীয় সংসদে কে হবে বিরোধী দল? এমন প্রশ্নের উত্তর অবশ্য মিলেছে খোলা চিঠিতে। নানা জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ১৮ জানুয়ারি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরকে সংসদীয় দলের নেতা নির্বাচন করে দলটি অপরদিকে সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদকে উপনেতা ও মহাসচিব মো. মজিবুল চুন্নুকে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ মনোনীত করে ঠিক দুদিন পরই বিষয়টি অবহিত করে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীকে চিঠি দেয় জাতীয় পার্টি।

সংবিধান বিশ্লেষকদের মতে, জোট করে বিরোধী দলের আসনে বসতে পারতেন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা। তবে সেক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতা রয়েছে একজন হবে বিরোধীদলীয় নেতা। তবে ৬২ জন স্বতন্ত্র প্রার্থীর মধ্যে ৫৯ জনই আওয়ামী লীগ নেতা। জোটবদ্ধ হলে আনুপাতিক হারে সংরক্ষিত নারী আসনের মধ্যে ১০টিও পাবেন তারা।

গুঞ্জন ছিল স্বতন্ত্র প্রার্থীরাই এবার সংসদে হতে পারেন বিরোধীদল, তবে সেই শঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা বিরোধী দলের ভূমিকায় থাকছেন না। জোট গঠনে বরাবরই অনাগ্রহ ছিল স্বতন্ত্র প্রার্থীদের। এ ছাড়াও সংসদে আওয়ামী লীগের সভাপতির সিদ্ধান্তের বাহিরে গিয়ে কিছু করবেন না বলেও জানান তাঁরা। এ কারণেই বিরোধী দলের ভূমিকায় নেই তাঁরা।

একাধিক স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এখনও স্পষ্ট হয়নি জোটের বিষয়টি, নির্ধারণ হয়নি কী ভূমিকায় সংসদে থাকবেন তারা তবে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের দাবি জোট হয়ে আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলে যুক্ত থাকবেন তাঁরা। দলীয় প্রধানের সাথে সাক্ষাতের পর এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে। 

আগামী ২৮ জানুয়ারি সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় গণভবনে আওয়ামী লীগ সভাপতির সঙ্গে সাক্ষাতের কথা রয়েছে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের। এমনকি সংরক্ষিত মহিলা সদস্য মনোনয়নের দায়িত্বও আওয়ামী লীগের হাতে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। তাদের মনোনয়ন দেবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি, সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। 

ঢাকা-১৮ আসনে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য মোহাম্মদ খসরু চৌধুরী বলেন, এই বিষয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে। স্বতন্ত্র বললেও আমরা তো পুরোপুরি স্বতন্ত্র না। আমরা তো আওয়ামী পরিবারের লোক। আমি এর আগেও বলেছি এবং এখনো বলছি, জননেত্রী শেখ হাসিনা সিদ্ধান্ত নিবেন আমরা কী করবো, কোথায় বসবো। কিংবা মোর্চা করে বিরোধী দলের আসনে বসব কিনা। তিনি যেখানে থাকতে বলবেন সেখানেই থাকব। আমরা তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাশীল তার যে কোন সিদ্ধান্ত মেনে নিতে আমরা প্রস্তুত। 

দলীয় সূত্রে জানা যায়, প্রায় ৪০ জনের অধিক স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য সরকারি দল আওয়ামী লীগের সাথেই থাকতে ইচ্ছুক। জোটবদ্ধভাবে বিরোধী দল হতে অনেকটাই অনীহা তাদের।

ঢাকা-৪ আসনের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য আওলাদ হোসেন বলেন, স্বতন্ত্র হিসেবে আমাদের আলাদা স্বাধীনতা আছে। আমরা সত্যকে সত্য বলতে পারব, মিথ্যাকে মিথ্যা বলতে পারব। জনগণের যে বক্তব্য সে বক্তব্য আমরা সংসদে উপস্থাপন করার সুযোগ পাব। তবে এখনি কিছু বলা মুশকিল বিরোধী দল সম্পর্কে।

মোর্চা করে বিরোধী দলে আসনে যাবেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কিভাবে বিরোধী দল হবে, সেটা সংসদ নেতার উপর ন্যাস্ত। এই মুহূর্তে কিছু বলা যাচ্ছে না।

যশোর-৬ আসনের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য আজিজুল ইসলাম খন্দকার আজিজ বলেন, বিরোধীদল হব কিনা এমন কোন সিদ্ধান্ত এখন পর্যন্ত হয়নি। রবিবার বসলে বোঝা যাবে আমাদের কোন দলে রাখবে, নাকি বিরোধীদল বানাবে। তবে বিরোধী দলীয়র প্রশ্নে আমার একটা কিন্তু আছে। আমরা দলীয় লোক বঙ্গবন্ধুর আদর্শে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুসারী। আমরা চাই আমরা আওয়ামী লীগের সাথেই থাকি।

তিনি বলেন, অন্য কারো বিরোধী দল হওয়ার ইচ্ছা আছে কিনা আমি জানি না, তবে ব্যক্তিগতভাবে বিরোধী দল হওয়ার কোনো ইচ্ছেই আমার নেই। আমাদের বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা অনুযায়ী বাকি বিস্তারিত জানতে পারবেন।

এদিকে ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের আসনে জাতীয় পার্টিই বসবে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আসন পাওয়া রাজনৈতিক দলই হবে সংসদে প্রধান বিরোধী দল। স্বতন্ত্ররা স্বতন্ত্রই আছে। দল যদি বলেন তাহলে জাতীয় পার্টিই হবে সংসদে প্রধান বিরোধী দল।

বিরোধী দলীয় নেতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সংসদের কার্যপ্রণালি বিধি অনুযায়ী বিরোধী দল বলে কোনো কিছু না থাকলেও বিরোধী দলীয় নেতার বিষয়টি রয়েছে। কার্যপ্রণালি বিধি অনুযায়ী বিরোধী দলের নেতা কে হবেন, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার স্পিকারের। স্পিকার যাকে বিরোধী দলের নেতা হিসেবে স্বীকৃতি দেবেন, তিনি সংসদে প্রধান বিরোধী দলের নেতা হবেন।

এদিকে, নির্বাচন কমিশন (ইসি) থেকে স্বতন্ত্র এমপিদের কাছে চিঠি দিয়ে সংরক্ষিত আসনের নির্বাচনে তাদের অবস্থান জানতে চাওয়া হয়েছে। গত ২২ জানুয়ারি ইসি সচিব জাহাংগীর আলমের সই করা ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, সংরক্ষিত মহিলা আসনে নির্বাচনের জন্য সংসদে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির ভিত্তিতে রাজনৈতিক দল ও জোটের মধ্যে আসন বণ্টনের জন্য আলাদা তালিকার নিয়ম রয়েছে। 

সংসদের সাধারণ নির্বাচনের ফল গেজেটে প্রকাশিত হওয়ার ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে এই তালিকা প্রস্তুত করতে হবে। এতে স্বতন্ত্র সদস্য কোনো রাজনৈতিক দল বা জোটে যোগ দিলে আলাদা তালিকা তৈরির নিয়ম রয়েছে। বিষয়টি সাধারণ নির্বাচনের ফল গেজেটে প্রকাশিত হওয়ার পরবর্তী ২১ কার্যদিবসের মধ্যে ইসিকে অবহিত করতে হবে। এমন পরিস্থিতিতে সংরক্ষিত মহিলা আসনে নির্বাচনের উদ্দেশ্যে কোনো দলের সঙ্গে জোট গঠন করা হলে ৩১ জানুয়ারির মধ্যে কমিশনকে জানানোর অনুরোধ জানানো হয়।

একাধিক স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য জানায়, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর সংরক্ষিত নারী আসনের নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হবে। সেক্ষেত্রে রবিবার সিদ্ধান্ত হবে, জোটগতভাবে সংসদীয় দল নাকি বিরোধী দল। তবে অধিকাংশের দাবি নিজেদের আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলে যুক্ত করার।

জাতীয় পার্টি (জেপি) মহাসচিব শেখ শহীদুল ইসলাম বলেন, এবার উল্লেখযোগ্য স্বতন্ত্র এমপি হওয়ায় সংসদে একক দল হিসেবে জাতীয় পার্টির পক্ষে কার্যকরী বিরোধী অবস্থান সম্ভব হবে না। 

সংসদ সদস্যরা যারা স্বতন্ত্র তারা যদি সমর্থন না দেয় সে ক্ষেত্রে তাদের বিরোধী দল বানানো সমচিত কোন সিদ্ধান্ত হবে না। কারণ তারা তখন সংখ্যাগরিষ্ঠ বিরোধী দলীয় সদস্যদের মতামতকে উপস্থাপন করতে পারবে না।

গত ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ২৯৯ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২২৩টি আসনে জয় পায়। দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে জাতীয় পার্টি (জাপা) পায় ১১ আসন। জাসদ, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি ও কল্যাণ পার্টি একটি করে আসন পায়। ৬২ আসনে জয় পান স্বতন্ত্ররা। এই অবস্থায় নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর থেকে প্রধান বিরোধী দল কারা হবে, তা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে গুঞ্জন তৈরি হয়। ১১ আসন নিয়ে জাপা বিরোধী দলের মর্যাদা পাবে কিনা, তা নিয়ে নানা বিশ্লেষণ চলতে থাকে। স্বতন্ত্র সদস্যরা জোট গঠনের মাধ্যমে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে পারেন এমন আলোচনাও শুরু হয়।

Link copied!