আগস্ট ৮, ২০২৫, ০৬:৫৬ পিএম
ছবি: সংগৃহীত
পাকিস্তানের স্বাধীনতা এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময় জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, সেই জামায়াত এখন ‘নতুন নতুন বাণী’ জাতির সামনে আনছে।
জুলাই ঘোষণাপত্রের সমালোচনা করে জামায়াত নেতা সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহেরের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় শুক্রবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের এক অনুষ্ঠানে এ কথা বলেন একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা হাফিজ।
সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা বলেন, “এই জামায়াতে ইসলামী তারা বলেছেন, জুলাই ঘোষণাপত্রে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠাকে অত্যন্ত গৌরবের সাথে উপস্থাপন করা হয়নি। তারা ভেবেছে, বাংলাদেশের মানুষের স্মরণ শক্তি খুবই দুর্বল। ১৯৭১ সালে আন্দোলনের সময়ে এই দল জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের বিরোধিতা করেছিল।”
এর আগে গত বুধবার প্রধান উপদেষ্টার দেওয়া জুলাই ঘোষণাপত্রের প্রতিক্রিয়ায় জামায়াত নেতা তাহের বলেছিলেন, “ঘোষণাপত্রে দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামের কথা বলা হলেও ১৯৪৭ এর আজাদীকে উপেক্ষা করা হয়েছে।”
এর প্রতিক্রিয়ায় হাফিজ বলেন, “আমার যথেষ্ট বয়স হয়েছে… ৮১ বছর বয়স। সুতরাং সেদিন কথা মনে হয়, আমাদের যথেষ্ট জ্ঞান-বুদ্ধি হয়েছিল। সেই ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিল জামায়াতে ইসলামী, একাত্তর সালেও মহান মুক্তিযুদ্ধের তারা বিরোধিতা করেছে। এখন তারা নতুন নতুন বাণী নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে।”
জুলাই অভ্যুত্থানের বর্ষপূতিতে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস যে জুলাই ঘোষণাপত্র ঘোষণা করেন, সেটি অপূর্ণাঙ্গ বিবৃতি বলে পরদিন বুধবার প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের।
তিনি বলেন, “ঘোষণাপত্রে দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামের কথা বলা হলেও ১৯৪৭ এর আজাদীকে উপেক্ষা করা হয়েছে। এতে পিলখানা হত্যাকাণ্ড, শাপলা হত্যাকাণ্ড, ২৮ অক্টোবরের (লগি বৈঠা আন্দোলন) হত্যাকাণ্ডের উল্লেখ নেই। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আলেম-ওলামা, মাদ্রাসা শিক্ষক ও ছাত্র, প্রবাসী ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের ভূমিকার উল্লেখ নেই, যা ইতিহাসের প্রতি অবিচার ও অবহেলা ছাড়া আর কিছুই নয়। জুলাই অভ্যুত্থানের টার্নিং পয়েন্ট ছিল ৯ দফা, যা এক দফায় রূপান্তরিত হয়েছিল। সে বিষয়টিও ঘোষণাপত্রে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।”
ভোট বানচালের শঙ্কা
প্রেস ক্লাবের জহুর হোসেন হলে ‘অগ্নিসেনা সোশাল ফাউন্ডেশন’ ও ‘আমাদের নতুন বাংলাদেশ’ এর যৌথ উদ্যোগে জুলাই অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে ‘দ্রুত বিচার সম্পন্ন, মৌলিক সংস্কার ও সংসদ নির্বাচন’ শীর্ষক এই আলোচনা সভা হয়।
সেখানে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন বানচালের আশঙ্কা করে দেশের সবাইকে এক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন হাফিজ উদ্দিন আহমেদ।
তিনি বলেন, “ভারতে আশ্রয় নিয়ে মাফিয়া নেত্রী শেখ হাসিনা এই দেশকে লন্ডভন্ড করার জন্যে, নির্বাচনকে বানচাল করার জন্যে অনেক সহিংস ঘটনার অবতারণা করবেন।
“আমাদের সবাইকে সর্তক থাকতে হবে। আমরা দলমত নির্বিশেষে দেশবাসী সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে এই মাফিয়াদের নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডকে প্রতিহত করব আজকের দিনে এই হোক অঙ্গীকার।”
তার কথায় এবারের নির্বাচন হবে গণতন্ত্রকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা এবং অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন করার জন্য।
“এবারের নির্বাচন হবে এই হাসিনা মার্কা, আওয়ামী লীগ মার্কা দুঃশাসনকে চিরতরে নির্বাসনে দেবার জন্যে।”
সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
এ এম এম নাসির উদ্দিন নেতৃত্বাধীন ইসির প্রতি বিএনপির আস্থা রয়েছে জানিয়ে হাফিজ উদ্দিন বলেন, “ইসিতে নিরপেক্ষ ব্যক্তিরা সেখানে রয়েছেন। আমি আশা করব, একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমেই গণরায় প্রতিফলিত হবে। এই নির্বাচনের জন্য দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের মানুষ অপেক্ষা করে আছে। অনেক মানুষ জীবন দিয়েছে গণতন্ত্র ফেরানোর জন্যে এবং সুষ্ঠু নির্বাচন পাওয়ার জন্যে।”
‘পুলিশ বাহিনীর সংস্কার করতে হবে’
সরকার পতনের বছর পেরিয়েও পুলিশ বাহিনীর ‘সংস্কার হয়নি’ বলে হতাশা প্রকাশ করেছেন হাফিজ উদ্দিন।
তিনি বলেন, ‘‘এ দেশের পুলিশ বাহিনী একটি পেটুয়া বাহিনীতে পরিণত হয়েছিল, বাংলাদেশ একটি পুলিশ স্টেটে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু একবছর অতিক্রান্ত হলেও এখনো পুলিশ বাহিনীতে কোনো সংস্কার হয়নি।”
এই পুলিশ বাহিনী নির্বাচনে কতটুকু কার্যকর হবে তা নিয়ে জনমনে ‘সন্দেহ’ রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। র্যাব বিলুপ্তির জন্য বিএনপির করা সুপারিশের কোনো ফলাফল আসেনি বলেও অভিযোগ করেন হাফিজ উদ্দিন।
“ইতিমধ্যে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছেন যে, র্যাবকে নির্বাচনের দায়িত্বে রাখা হবে। কিন্তু এই বাহিনীকে এখনো রাখা হল কেন? বিএনপি থেকে যে একটা পুলিশ সংস্কার একটি কমিটি করা হয়েছিলো আমি সেই কমিটির আহ্বায়ক ছিলাম। আমরা সুপারিশ করেছিলাম এই র্যাবকে বিলুপ্ত করে দেওয়ার জন্যে। এতো কলঙ্ক তারা লেপন করেছে, এতো অত্যাচার-নির্যাতন করেছে এই বাহিনী সম্পর্কে উপযুক্ত কঠিন ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সেই ধরণের কোনো ব্যবস্থা আমরা দেখতে পারছি না।”
এলিট ফোর্স র্যাব গঠন করা হয় বিএনপি-জামায়ত জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালে।
গত বছরের ডিসেম্বরে বিচারবর্হিভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ তুলে পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট র্যাব বিলুপ্তির সুপারিশ করেছিলেন হাফিজ উদ্দিন আহমেদ।
পাশাপাশি জনবান্ধব-মানবিক পুলিশ বাহিনী গড়ে তুলতে ‘পুলিশ কমিশন’ গঠন করারও আহ্বান রেখেছিলেন তিনি।
‘তারা কৃতি কিন্তু অনভিজ্ঞ’
সরকারের সমালোচনা করে সাবেক মন্ত্রী হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, “এই অর্ন্তবর্তী সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনূসসহ অন্য যারা আছেন তারা নিঃসন্দেহে ভালো লোক, কৃতি মানুষ। কিন্তু রাজনীতিতে একেবারেই অনভিজ্ঞ।”
অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তির দিনে প্রধান উপদেষ্টা জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের যে সম্ভাব্য সময় ঘোষণা করেছেন সে জন্য সরকারের প্রশংসা করে তিনি বলেন, “অবশেষ যে, তাদের বোধদয় হয়েছে যে, নির্বাচিত সরকার ছাড়া বাংলাদেশের জনগণের এইসব সমস্যার সমাধান কেউ করতে পারবে না। দেরিতে হলেও তারা উপলব্ধি করেছেন এবং প্রফেসর ইউনূস আমাদের নেতা তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠকে বসে লন্ডনে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচন হবে এই প্রতিশ্রুতি পালন করার জন্যে আমি প্রফেসর ইউনূসকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। আমরা আশা করব, তারা একটি সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দেবেন।”
‘পিআর নয়, জনগণের ভোটে নির্বাচন হবে’
সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচনের মাধ্যমে একশত আসনের জাতীয় সংসদের উচ্চকক্ষ গঠনের সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। ভোটের এই ব্যবস্থার বিরোধিতা করে হাফিজ উদ্দিন বলেন, দেশের সাধারণ মানুষ ‘একজন ব্যক্তিকে ভোট দিতে চায়’।
“যে দেশের মানুষের পাশে থাকবেন, যার কাছে গেলে পুলিশের অত্যাচার, সমাজপতিদের অত্যাচার, গ্রামাঞ্চলে বা শহরাঞ্চলে দুর্বৃত্তদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য, একজন ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত করে তিনি হবে তাদের কাছে আপাতত প্রধান আশ্রয়।
জনগণ এইভাবে সচেতন হয়নি এবং রাজনৈতিক দলগুলো এতখানি পরিপক্কতার পরিচয় এতবছর দিতে পারে নাই যে, কেবলমাত্র প্রতীকে ভোট দি্লেই তাদের সমস্যার সমাধান হবে। ফলে সরাসরি ভোটে নির্বাচন ব্যবস্থা পরিবর্তনে আমরা কোনো যুক্তিযুক্ত কারণ দেখি না।”
হাফিজ বলেন, “কিছু কিছু রাজনৈতিক দল তারা ধরেই নিয়েছে যে, নির্বাচনে তাদের জামানত বাজেয়াপ্ত হবে, তাদের পক্ষে নির্বাচিত হওয়া সম্ভব নয়। এই নির্বাচনকে বিলম্বিত করার জন্য তারা পিআর সিস্টেমের কথা বলে।”
অগ্নিসেনা সোশাল ফাউন্ডেশনের সভাপতি তালুকদার জহিরুল হক তুহিনের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় গণসংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকি ও বিএনপির রেজাবুদ্দৌলা চৌধুরী, জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের গোলাম মোহাম্মদ চৌধুরী আলালসহ আরো অনেকে উপস্থিত ছিলেন।