ছবি: সংগৃহীত
২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থান বদলে দিয়েছে বাংলাদেশের সার্বিক চিত্র। আসছে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত। এর ফলে, জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেওয়ার প্রক্রিয়া হয়ে উঠবে- সহজ থেকে সহজতর। কিন্তু কঠিন হবে সরকার গঠন। ব্যালট পেপারে যুক্ত হচ্ছে ‘না’ ভোটের বিধান। এমনকি কোনো আসনে ৪০ শতাংশ ভোট না পড়লে, অটোমেটিক্যালি বাতিল হয়ে যাবে সেই সংসদীয় আসনের নির্বাচন। ফলে যেনতেনভাবে নির্বাচনে অংশ নিয়ে, সরকার গঠনের চিন্তা বাদ দিতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোকে। কারণ প্রার্থী পছন্দ না হলে, ‘না’ ভোট প্রদানের মাধ্যমে দলগুলোকেও প্রার্থী পরিবর্তনে বাধ্য করার সুযোগ পাবে জনগণ।
ঠিক এমনটাই ঘটতে যাচ্ছে সামনের সব নির্বাচনে, যদি ‘নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন’-এর সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করে অন্তবর্তী সরকার।
কী আছে সংস্কার কমিশনের সুপারিশে?
প্রথমেই আসছি- রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের বিষয়ে। কারণ নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোই শুধু অংশ নেয় জাতীয় নির্বাচনে। তাই নিবন্ধন পেতে প্রতিবারই নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনে দৌড়ঝাঁপ শুরু করে রাজনৈতিক দলগুলো। কিন্তু কঠিন নিয়মের গ্যাঁড়াকলে শেষপর্যন্ত সফলতার মুখ দেখতো না নতুন দলগুলো। তাই প্রতি নির্বাচনে, ঘুরে ফিরে সেই একই পুরনো দল ও পুরনো প্রার্থীদের মুখই দেখতো জনগণ।
তবে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার প্রক্রিয়া সহজ করতে নেওয়া হয়েছে নতুন উদ্যোগ। আগে নির্বাচনে অংশ নিতে, যেকোনো দলের জন্য, অন্তত ২১টি জেলা এবং ২০০ উপজেলায় দলীয় অফিস থাকতে হতো। সংস্কার কমিশন এই জটিল শর্ত কমানোর সুপারিশ করেছে, যা বাস্তবায়িত হলে- দেশের সর্বোচ্চ ৭ জেলা ও ২৫ উপজেলায় দলীয় কার্যালয় থাকলে এবং নূ্নতম ৫০০০ সদস্য থাকলেই রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন দেবে নির্বাচন কমিশন, ফলে জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেওয়ার দুয়ার খুলে যাবে আরো অনেক দলের জন্য। ফলে ভোটের মাঠে বাড়বে প্রতিদ্বন্দ্বীর সংখ্যা, আরো বাড়বে প্রতিযোগিতা, মানুষের সামনে বাড়বে ভোট দেওয়ার অপশন।
স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জন্যেও সহজ হচ্ছে নির্বাচন
আগে নির্দলীয় প্রার্থী হিসেবে কেউ জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে চাইলে, সংশ্লিষ্ট আসনের ১ শতাংশ ভোটারের স্বাক্ষর জমা দেওয়ার বিধান ছিল। এবার এই জটিলতা থেকেও মুক্তি পাচ্ছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। সুপারিশে বলা হয়েছে, হলফনামায় মাত্র ৫০০ ভোটারের স্বাক্ষর থাকলেই, নির্দলিয় যে কোনো ব্যক্তি যেন প্রার্থী হতে পারেন।
নির্বাচ ব্যবস্থাতেও আসছে আমূল পরিবর্তন
একইসঙ্গে নির্বাচ ব্যবস্থাতেও আসছে আমূল পরিবর্তন।
সুপারিশে বলা হয়েছে- নির্বাচনের আগে চার মাসের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু, ইভিএম ব্যবস্থা বাতিল এবং নির্বাচনের সময় আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা হিসেবে প্রতিরক্ষা বিভাগকে অন্তর্ভুক্ত করতে। ফলে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে এবং প্রতিরক্ষা বাহিনীর নিরপত্তার ঘেরাটোপেই হয়তো অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে আগামীর নির্বাচন।
‘না’ ভোট
এক্ষেত্রে হয়তো এবার থাকতে পারে ‘না’ ভোটের চমক।
কারণ ব্যালট পেপারে ‘না’ ভোট চালুর রাখার বিধান প্রস্তাব করেছে কমিশন। প্রার্থী পছন্দ না হলে, ‘না’ ভোট প্রদানের মাধ্যমে একজন ভোটার যেন তার মতামত জানাতে পারেন, সেজন্যই এই আয়োজন। অনেক রাজনৈতিক দলের হিসেবই বদলে দিতে পারে এই ‘না’ ভোট। আর ‘না’ ভোট বিজয়ী হলে বাতিল হবে নির্বাচন, অনুষ্ঠিত হতে পুনঃনির্বাচন। এমনকি ‘না’ ভোটের কারণে নির্বাচন বাতিল হলে, পুনঃনির্বাচনে আর আগের প্রার্থীরা অংশ নিতে পারবে না। সব দলকেই আনতে হবে নতুন প্রার্থী।
চমকের শেষ নয় এখানেই।
৪০ শতাংশ ভোটের বিধান
দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো যুক্ত হচ্ছে ৪০ শতাংশ ভোটের বিধান। এর অর্থ, কোনো আসনে ৪০ শতাংশ ভোট না পড়লে, বাতিল হবে সেই নির্বাচনও। ওই আসনে অনুষ্ঠিত হবে পুনঃনির্বাচন।
জাতীয় নির্বাচনের মনোনয়ন ও প্রচারণাকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলগুলোর গ্রুপিং এবং অস্থিতিশীল পরিবেশের সম্ভাবনা থাকলে, কিংবা ভোটাররা ভোটকেন্দ্র বিমুখ হলে, যেকোনো আসনেই ঘটে যেতে পারে ভোট বাতিলের বিপর্যয়।
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশ থেকে আরো জানা যায়- বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন বন্ধ, রাজনৈতিক দলগুলো কর্তৃক সৎ ও যোগ্য প্রার্থী বাছাই, এবং রাজনৈতিক দল কর্তৃক ভোটারদের কাছে গ্রহণযোগ্য প্রার্থী দেওয়া নিশ্চিত করতেই `না` ভোট চালু এবং ন্যূনতম ৪০ শতাংশ ভোটের বিধান প্রস্তাব করা হয়েছে।
তবে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের প্রক্রিয়া সহজ করা হলেও, থাকছে বিশেষ কিছু শর্ত। তারমধ্যে- দলের লেজুরবৃত্তিক ছাত্র, শিক্ষক ও শ্রমিক সংগঠন, ভাতৃপ্রতীম বা অন্য যেকোনো নামে কোন সংগঠন না রাখা; কোনো রাজনৈতিক দলের বিদেশি সংগঠন না থাকা, দলীয় সদস্যদের গোপন ভোটের মাধ্যমে দলের সর্বোস্তরের কমিটি এবং জাতীয় নির্বাচনের জন্য প্রতি আসনে সর্বোচ্চ ৩ জন দলীয় প্রার্থীর প্যানেল নির্ধারণ এবং সেই প্যানেল থেকেই চূড়ান্ত মনোনয়ন প্রদান, এসব সুপারিশ উল্লেখযোগ্য।
প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা
সংস্কার প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতা কমানোর সুপারিশও করেছে কমিশন। বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর মেয়ার সর্বোচ্চ দুই টার্ম করা; দুইবার নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীকে রাষ্ট্রপতি পদের নির্বাচনে অযোগ্য করা; এমনকি একই সঙ্গে একই ব্যক্তি যাতে দলীয় প্রধান, সংসদ নেতা এবং প্রধানমন্ত্রী পদে থাকতে না পারেন, তার বিধান করা।
দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট সংসদ
এছাড়াও দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট সংসদ। বিরোধী দলকে ডেপুটি স্পিকারের পদ দেওয়া। সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে ১০০ আসন নিয়ে উচ্চকক্ষ সৃষ্টি, উচ্চকক্ষের সংসদ সদস্যদের বয়স কমপক্ষে ৩৫ এবং শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতক নিশ্চিত করা। এবং সংসদ নির্বাচনে প্রাপ্ত দলগুলোর ভোটের হারের ভিত্তিতে, দলগুলোর মধ্যে সংখ্যানুপাতিকভাবে উচ্চক্ষের আসন বণ্টন করা। এক্ষেত্রে প্রত্যেক দল তার প্রাপ্ত আসনের ৫০ শতাংশ দলের সদস্যদের মধ্য থেকে; বাকি ৫০ শতাংশ নির্দলীয় ভিত্তিতে নাগরিক সমাজ, শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী, শ্রমজীবীদের প্রতিনিধি, নারী উন্নয়নকর্মী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীদের মধ্য থেকে সংখ্যানুপাতিকহারে নির্বাচিত করা বিধান। এক্ষেত্রে প্রত্যেক দলকেই তার প্রাপ্ত অংশ থেকে কমপক্ষে ৪০ শতাংশ নারী অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে হবে।
অন্যদিকে নিম্নকক্ষের আসনসংখ্যা ১০০ বাড়িয়ে ৪০০ করা এবং এই ৪০০ আসনের মধ্যে নারীদের জন্য নির্ধারিত ১০০ আসন ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে নির্বাচনের বিধান করা। যাতে নির্দিষ্ট আসন থেকে নারীদের সরাসরি নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ থাকে এবং সংরক্ষিত আসনের নামে নির্বাচনি আসনগুলোতে দ্বৈত প্রতিনিধিত্বের অবসান ঘটে।
একইসঙ্গে, সংসদ সদস্যদের জন্য শুল্কমুক্ত গাড়ি, আবাসিক প্লটসহ সব ধরণের প্রটোকল ও ভাতা পর্যালোচনা এবং সংশোধনের প্রস্তাবও দিয়েঠে কমিশন। এমনকি সংসদ সদস্যদের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের উপদেষ্টার পদ থেকে অপসারণ এবং এমপি হিসেবে বিশেষ প্রটোকল ব্যবস্থার অবসান ঘটানোর প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশে।
ফলে, বলাই যায় যে, এসব সুপারিশ বাস্তাবায়িত হলে- আগামীর নির্বাচনে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হওয়ার প্রক্রিয়া যতো কঠিন হতে যাচ্ছে, বিপরীতে হয়তো ততোটাই কমতে পারে সংসদ সদস্যদের সুযোগসুবিধা। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায়-- আবারো হয়তো পুরনো সন্মান ফিরে পাবেন জনপ্রতিনিধিরা...
তবে, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের যে প্রক্রিয়ার কথা বলা হয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে- সংসদের উভয় কক্ষের সদস্য এবং দেশের স্থানীয় সরকারের সকল নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত বৃহত্তর নির্বাচক নির্বাচকমণ্ডলীর ভোটে নির্বাচিত হতে হবে রাষ্ট্রপতিকে। বৈষম্যহীন ও বিভেদমুক্ত রাষ্ট্র গঠতে, বাংলাদেশ এখন হয়তোবা-- দলনিরপেক্ষ, সৎ, যোগ্য ও সুনামসম্পন্ন--- এরকম একজন ব্যক্তির প্রতীক্ষায়?