রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। তবে এবার উপদেষ্টা পরিষদেও সংস্কারের দাবি চেয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। উপদেষ্টা পরিষদের রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের পাশাপাশি পেশাদার ব্যবসায়ীদের অন্তর্ভূক্তির পরামর্শ দিয়েছে তারা। শনিবার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে সংলাপে বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল উপদেষ্টামণ্ডলীর সংস্কার নিয়ে এ প্রস্তাব দিয়েছে।
যে সব রাজনৈতিক দল ছিল সংলাপে
গত ৫ অক্টোবর বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, গণতন্ত্র মঞ্চ, হেফাজতে ইসলাম, বাম গণতান্ত্রিক জোট, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদের সঙ্গে সংলাপ করেন প্রধান উপদেষ্টা।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে শনিবার ১৯ অক্টোবর সংস্কারপ্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে নয়টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনায় বসেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। দলগুলো হলো- গণফোরাম, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি(এলডিপি), জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, ১২ দল, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল, লেবার পার্টি, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি), বাংলাদেশ জাসদ (শরীফ নুরুল আম্বিয়া), ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট।
উপদেষ্টা পরিষদে যে সংস্কারের দাবি
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণফোরাম,এলডিপি,জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, বাংলাদেশ জাসদ (শরীফ নুরুল আম্বিয়া) উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য দাবি জানায়। তাদের মতে সংস্কার কাজ সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক করতে উপদেষ্টামণ্ডলীর সংখ্যা বৃদ্ধি করার প্রয়োজন।
বর্তমানে উপদেষ্টাপরিষদের অরাজনৈতিক ব্যক্তি বেশি। সেই সাথে ভিন্ন পেশাজীবীদের সংখ্যাও কম। তাই নিরপেক্ষ রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ,ব্যবসায়ীদেরও এই উপদেষ্টাপরিষদের অংশ হওয়া উচিৎ বলে তারা মনে করেন।
গণফোরামের সমন্বয় কমিটির চেয়ারম্যান মোস্তফা মহসীন মন্টু বলেন, বর্তমানে উপদেষ্টা মণ্ডলীর সংখ্যা আরও বৃদ্ধি করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এছাড়াও আমরা ২৩ টি প্রস্তাবনা দিয়েছি।
এদিকে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বলেন, সঠিক ভাবে সংস্কার কাজ পরিচালনার জন্য উপদেষ্টা মণ্ডলীর সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে।
বাংলাদেশ জাসদের সভাপতি শরীফ নুরুল আম্বিয়াও এই বক্তব্য দিয়েছেন। তাঁর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে, চিকিৎসক,ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন পেশাজীবিরা হয়ত ভিন্ন কারনে আওয়ামী লীগের সাথে সম্পৃক্ত ছিল। কিন্তু কোন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড না করলে যেন তাদের আটক না করা হয়। এজন্য আলাদা কমিশন গঠন করা দরকার। সেখানে উপদেষ্টাদের কাজের ব্যপ্তিও বৃদ্ধি পাবে। সেক্ষেত্রে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।
এদিকে লেবার পার্টি চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান বলেন, সবার আগে উপদেষ্টামণ্ডলীর সংস্কারের প্রয়োজন। হাতেগোনা কয়েকজন ব্যতীত বাকি সবাই ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। তাই তাদের অপসারণ করা দরকার। রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে পরামর্শের ভিত্তিতে নতুন করে উপদেষ্টা নিয়োগ দিতে হবে।
তিনি আরও বলেন, আমরা ভেবেছিলাম ছাত্র উপদেষ্টারা হয়ত ভাল করবে না। কিন্তু বিভিন্ন সচিব,আমলা উপদেষ্টাদের চেয়ে তারা অনেক ভাল করেছে। আলী ইমাম মজুমদার প্রশাসনে আওয়ামী লীগদের বেছে বেছে নিয়োগ দিচ্ছেন। ইতোমধ্যে ক্ষমতা নেওয়ার পরে ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের অনেকগুলো কথা বলেছেন, সুপ্রদীপ চাকমা শপথ নেওয়ার পর আওয়ামী লীগের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। তিনি আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী। সেই সাথে উপদেষ্টাদের জবাবদিহিতার আওতায়ও আনা প্রয়োজন।
ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক মুভমেন্টের (এনডিএম) চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ বলেন, আমারা উপদেষ্টামণ্ডলীর পরিধি বাড়ানোর কথা বলেছি। সেখানে স্বচ্ছ ইমেজের ব্যবসায়ী,রাজনীতিবিদ,সাবেক আইজিপিসহ পেশাজীবিদের সংযুক্ত করার পরামর্শ দিয়েছি।
দিবস বাতিল নিয়ে বিতর্ক
আটটি দিবস বাতিল করা হয়েছে, এ নিয়ে কোনও আলোচনা হয়েছে কি না, এমন প্রশ্নে গণফোরামের সমন্বয় কমিটির চেয়ারম্যান মোস্তফা মহসীন মন্টু বলেন, জাতীয় দিবস ছাড়া কোনও দিবসই রাখা উচিত নয়।
বাংলাদেশ জাসদের সভাপতি শরীফ নুরুল আম্বিয়া বলেছেন, সম্প্রতি ওনারা বঙ্গবন্ধু ও ৭ই মার্চ নিয়ে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা নিয়ে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে এবং তা গ্রহণযোগ্য হয়নি। আমরা বলেছি, শেখ হাসিনার সরকারের পারিবারিক কর্মকাণ্ডের দায় তার। শেখ হাসিনা সরকারের ভুলত্রুটির দায় বঙ্গবন্ধুর ওপর চাপানোর যৌক্তিকতা নেই। তাই আমরা মনে করি, উপদেষ্টা পরিষদের বক্তব্য সংশোধন করা উচিত।
এদিকে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ বলেন, এই সরকার নির্বাচিত সরকারের মত আচরণ করবে এটা কাম্য নয়। তারা সংস্কারের জন্য প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা নিবে সেটাই আশা করছি।
আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধের পরামর্শ
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে হত্যার জন্য আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করাসহ নতুন করে আরও ২৩ দফা প্রস্তাব দিয়েছে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি)। একইসঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের মতো আওয়ামী লীগ নেতাদের বিচার করে ফাঁসি দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন দলটির চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) অলি আহমদ।
জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের (এনডিএম) চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটি আইন করতে যাচ্ছে যেখানে মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড করলে সর্বোচ্চ দশ বছরের নিষেধাজ্ঞার কবলে পরবে দল। সেই সুবাদে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হতে পারে।
লেবার পার্টি চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান বলেন, শুধু আওয়ামী লীগ নয়, এখানে শেখ হাসিনা যেমন গণহত্যাকারী, জাতীয় পার্টি-মহাজোটের দলগুলো শেখ হাসিনার সমপরিমাণ অপরাধী। এ জন্য জাতীয় পার্টির শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছি। তাদের রাজনৈতিক দল হিসেবেও ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে চালানো গণহত্যার সঙ্গে জড়িতদের রাজনীতি ও নির্বাচন থেকে দূরে রাখার দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) সভাপতি আন্দালিব রহমান পার্থ। গণহত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হবে না সে ব্যাপারে প্রশ্নও তুলেছেন তিনি।
নির্বাচন নিয়ে যৌক্তিক সময় দেয়ার আশ্বাস
জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের (এনডিএম) চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ বলেছেন, সংস্কার এবং নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। নির্বাচন নিয়ে আমরা বলেছি আমরা বিশ্বাস করি, ২০২৫ সালের জুন বা জুনের পরেই নির্বাচন দেওয়া সম্ভব। উনাদের চিন্তাভাবনা প্রয়োজন। উনারা আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন আমাদের সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রাখবেন এবং আমাদের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা চালিয়ে যাবেন।
তিনি আরও বলেন, তবে যদি তারা আরও বেশি সময় প্রয়োজন হয় তাহলে তারা সেগুলো নিতে পারে।
যা বলেছেন ববি হাজ্জাজ
দেখুন ভিডিও
নির্বাচন নিয়ে কথা হয়েছে জানিয়ে গণফোরামের মোস্তফা মহসীন মন্টু বলেন, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে, এটার জন্য সার্চ কমিটি বা কিছু করার প্রয়োজন আছে, ভালো লোক নিয়োগ দেওয়ার দরকার আছে। যাতে অতীতের মতো কোনও সমস্যা না হয়।
রোডম্যাপ নিয়ে আলোচনা হয়েছে কি না, এমন প্রশ্নে মোস্তফা মহসীন মন্টু বলেন, আমরা কোনও তারিখ উল্লেখ করিনি। বলেছি সংস্কার শেষে অতিদ্রুত নির্বাচন দেওয়ার জন্য। তবে সংস্কার শেষ না হলে সব একই হবে। নির্বাচনের আগে থাকি রাম, নির্বাচনের পরে হই রাবণ। ওই ধরনের নির্বাচন কমিশন চাই না। অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশন কমিশন চাই।
তবে বাকিদলগুলো প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে যৌক্তিক সময়ের মধ্যে নির্বাচন দেয়ার পক্ষে পরামর্শ দিয়েছে।
এছাড়া রাজনৈতিক দলগুলো বাজারের সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ,পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার পাশাপাশি যেসব ব্যবসায়ীরা আর্থিক কেলেঙ্কারীতে যুক্ত তাদের অর্থ দ্রুত ফিরিয়ে আনার পরামর্শ দিয়েছে।