আগস্ট ২৮, ২০২৩, ১২:২৮ এএম
‘বল বীর, বল উন্নত মম শির’ অথবা মহা-বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত/আমি সেই দিন হব শান্ত/যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দল-রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না,/অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না-’।
বাংলা ভাষার ভিজে স্যাঁতসেঁতে দেহের ভেতরে যে তেজোদীপ্ত লাভা থাকতে পারে, ভাষা যে ডিনামাইটের মতো বিধ্বংসী হতে পারে নজরুলের জন্ম না হলে তা অজানাই থেকে যেত।
শোষিত মানুষের পক্ষে কলম ধরায় যুগবাণী, বিশের বাঁশিসহ তার পাঁচটি গ্রন্থ বাজেয়াপ্ত করে ব্রিটিশ সরকার। কোনো কবির এতগুলো গ্রন্থ একসাথে বাজেয়াপ্ত করার রেকর্ড নেই। ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতার জন্য রাজদ্রোহের মামলায় জেলে পাঠানো হয় কবি নজরুলকে। সেখানেও নজরুলের কলম থেমে থাকেনি।
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের কিংবদন্তি নেতাজি সুভাস চন্দ্র বসু একবার আজাদ হিন্দ ফৌজকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, “যুদ্ধের সময় নজরুলের গান গাওয়া হবে, গান গাওয়া হবে জেলে যাওয়ার সময়ও।”
নজরুলকে বিশ্ব সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি হিসেবে এবং তাঁর বিদ্রোহী কবিতাকে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম তাৎপর্যপূর্ণ কবিতা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন মার্কিন ফোকলোরবিদ ও সাহিত্য-সমালোচক প্রফেসর ড. হেনরি গ্লাসিসহ পশ্চিমা বিশ্বের খ্যাতনামা মনীষীরা। প্রফেসর হেনরি গ্লাসি তাঁর বিবেচনায় দুটো কবিতাকে শ্রেষ্ঠতম বলে প্রকাশ করেছেন -তার একটি হচ্ছে কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’।
১৯৬৫ সালে কবির বন্ধু মুজফ্ফর আহমদ-এর বয়ানে জানা যায়, ‘বিদ্রোহী রচিত হয়েছিল ১৯২১ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে। আমার মনে হয়, নজরুল ইসলাম শেষ রাত্রে ঘুম থেকে উঠে কবিতাটি লিখেছিল। তা না হলে এত সকালে সে আমায় কবিতা পড়ে শোনাতে পারত না। এখন থেকে চুয়াল্লিশ বছর আগে নজরুলের কিংবা আমার ফাউন্টেন পেন ছিল না। দোয়াতে বারে বারে কলম ডোবাতে গিয়ে তার মাথার সঙ্গে তার হাত তাল রাখতে পারবে না, এই ভেবেই সম্ভবত সে কবিতাটি প্রথমে পেন্সিলে লিখেছিল।’
প্রেম, দ্রোহ, সাম্যবাদ ও জাগরণের কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা ও গান শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে সংগ্রামে জাতিকে উদ্বুদ্ধ করেছে। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর গান ও কবিতা ছিল প্রেরণার উৎস। নজরুলের কবিতা, গান ও সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যে নবজাগরণ সৃষ্টি করেছিল। তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার পথিকৃৎ লেখক। তাঁর লেখনি জাতীয় জীবনে অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিকাশে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। তাঁর কবিতা ও গান মানুষকে যুগে যুগে শোষণ ও বঞ্চনা থেকে মুক্তির পথ দেখিয়ে চলছে।
কাজী নজরুল ছিলেন চির প্রেমের কবি। তিনি যৌবনের দূত। তিনি প্রেম নিয়েছিলেন, প্রেম চেয়েছিলেন। মূলত তিনি বিদ্রোহী কিন্তু তাঁর প্রেমিক রূপটিও প্রবাদপ্রতিম। তাই মানুষটি অনায়াসেই বলতে পারেন ‘আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন খুঁজি তারে আমি আপনায়।’
বিদ্রোহী কবি হিসেবে পরিচিত হলেও তিনি ছিলেন একাধারে কবি, সংগীতজ্ঞ, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক, চলচ্চিত্রকার, গায়ক ও অভিনেতা। তিনি বৈচিত্র্যময় অসংখ্য রাগরাগিণী সৃষ্টি করে বাংলা সংগীতজগেক মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন।
নজরুলের সৃষ্টিকর্ম প্রসঙ্গে নজরুল বিশেষজ্ঞ বাংলা একাডেমির সভাপতি অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বলেন, নজরুল ইতিহাস ও সময় সচেতন মানুষ ছিলেন যার প্রভাব তাঁর লেখায় স্পষ্টভাবে পাওয়া যায়। তিনি বলেন, তুরস্কে কামাল পাশার নেতৃত্বে প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা, রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব আর ভারতবর্ষে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের তরঙ্গকে নজরুল তাঁর সাহিত্যে বিপুলভাবে ধারণ করেছেন। সেই সময়ে ধর্মান্ধ মুসলমানদের তিনি পুনর্জাগরণের ডাক দিয়েছেন এবং এক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা ছিল একজন বলিষ্ঠ নেতার মতো।
কবি নজরুল শুধুমাত্র বাঙালির নয়, তিনি বিশ্বের শোষিত ও নিপীড়িত মানুষের। আপাদমস্তক সাম্যবাদী এই কবির অসংখ্য কবিতা সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হতো। রুটির দোকানের সামান্য বেতনের কর্মচারী থেকে উঠে আসা এই মানবতাবাদী কবির শতাধিক কবিতা ইংরেজি, রুশ, জার্মানসহ ৪০টিরও বেশি ভাষায় অনুবাদ হয়েছে।
কবি কাজী নজরুল শুধু দেশের নয়, সীমানার বাইরেরও। জাপানের টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নজরুলের সাহিত্য নিয়ে গবেষণা করে ডক্টরেট করেছেন অনেকে। শুধু তাই নয়, যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ, যুক্তরাষ্ট্রের কানেকটিকাট বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য দেশের শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নজরুল সাহিত্য পড়ানো হয়।
কাজী নজরুলই বিশ্বের একমাত্র কবি যার একটি কবিতার (বিদ্রোহী) ৯০ বছর পূর্তি রাষ্ট্রীয়ভাবে উদযাপন করেছে দুই রাষ্ট্র-বাংলাদেশ ও ভারত। দুই দেশেই তাঁর নামে বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। আর এসব সম্ভব হয়েছে নজরুল বলেই।
২৭ আগস্ট বিশ্বসাহিত্যে সার্বজনীন কবি ও তাঁর অবিস্মরণীয় প্রভাব নিয়ে স্বল্প সময় রাজত্ব করে নির্বাক হয়ে যাওয়া প্রেম ও দ্রোহের এই কবির মৃত্যুবার্ষিকী। এই দিনে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি।