করোনার বালাই নেই কড়াইল বস্তিতে!

তুহিন কান্তি দাস

মে ১৬, ২০২১, ০৪:৪৪ এএম

করোনার বালাই নেই কড়াইল বস্তিতে!

প্রায় তিন কোটি মানুষের এই ঢাকা শহরে বহু মানুষের বাস বস্তিতে। সরু ঢোকার পথ, অসংখ্য অলি-গলি, নোংরা গোসলখানা-টয়লেট, চারপাশে আবর্জনা, অন্ধকার খুপরি সব বস্তির মোটামুটি একই চিত্র। পেশায় বেশিরভাগ মানুষ গৃহকর্মী, গার্মেন্টস কর্মী, রিক্সা চালক, ভ্যান চালক, বাস-ট্রাক শ্রমিক এবং কেউ কেউ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। বাংলাদেশের সবচাইতে বড় বস্তিগুলোর একটি কড়াইল বস্তি। মারাত্নক স্বাস্থ্যঝুঁকির ঢাকা শহরে সবচাইতে অস্বাস্থ্যকর বস্তির এই পরিবেশ। কিন্তু এই পরিবেশেও এই বস্তিতে করোনাভাইরাসে প্রাণহানির কোনো খবর নেই!  

সারা বিশ্বের মতো দেশে করোনা মহামারি চলছে। কয়েক লাখ মানুষের বসতি এই বস্তিতে এখন পর্যন্ত করোনার থাবা দেখা যাচ্ছে না। বস্তিবাসী তাই পাত্তাও দিচ্ছে না করোনা ভাইরাসকে। কঠোর লকডাউনের ভেতর কার্যত স্বাভাবিক চিত্র দেখা যায় পুরো বস্তি এলাকাজুড়ে। বাস্তিবাসী জানান, তাদের জানামতে বস্তিতে নেই কোন করোনা আক্রান্তের তথ্য বা আক্রান্ত হয়ে কারোর মৃত্যুর খবর।

Karail-cover 2

করোনা সংক্রমণের দেড় বছর চলছে বাংলাদেশে। শুরুতে এবং তার পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে করোনা আক্রান্তের খবর বস্তি এলাকায় বাতাসের মতো ছড়িয়েছে। পরে  তার সত্যতা মেলেনি। অবিশ্বাস্য হলেও সরেজমিনে কড়াইল বস্তিতে গিয়ে পাওয়া যায় তার সত্যতা!

যে কারণে করোনায় প্রাথমিক লক্ষণ দেখা দিলে করোনা টেস্ট করাতো দূরের কথা ডাক্তারি পরামর্শ গ্রহণে পর্যন্ত অনিচ্ছুক নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া কড়াইলের বাসিন্দারা। অনেকটা পুলিশি ভয়ে বাধ্য হয়ে পরছেন মাস্ক, ব্যবহার করছেন হ্যান্ড সেনিটাইজার। সবকিছু ছাপিয়ে বস্তিবাসীর মূল উৎকন্ঠা আসলে জীবন জীবিকা নিয়ে।

Karail-cover-4

কড়াইল বস্তির পাশেই গুলশান-বনানী অভিজাত পাড়ায় চলমান লকডাউনের সময় গিয়ে দেখা যায় পুরো ভিন্নচিত্র। করোনা আতংকে ফাঁকা রাস্তায়  সুনসান নীরবতা। মোড়ে মোড়ে চেকপোস্ট। মাস্ক ব্যবহার, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, ভেক্সিন নেওয়া থেকে শুরু করে নিয়মিত ডাক্তারি পরামর্শ গ্রহণসহ সব ধরণের সতর্কতার দৌড়ঝাঁপ। তবুও এতটুকুও স্বস্তি নেই কারো মনে।

স্বস্তি মিলছে না সরকার ঘোষিত সর্বাত্মক লকডাউন দিয়েও। করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রাদুর্ভাবে বাংলাদেশে মৃত্যুর সংখ্যা ছাড়িয়েছে এগারো হাজার (১১মে ২০২১)। কঠোর লকডাউনে থমকে আছে দেশের অর্থনীতি।

বস্তিবাসীর সাথে কথা বলে জানা যায়, গত বছর করোনা ভাইরাস সংক্রমণের প্রথম পর্বে অন্যান্যদের মতো বস্তিবাসীও আতংকিত হয়ে পড়েন। কিন্তু আর্থিক অবস্থা এতোই নাজেহাল যে করোনার ভয়ে ঘরে বসে থাকলে না খেয়ে মরতে হতো তাদের। ফলে শতভাগ স্বাস্থ্যবিধি তাদের পক্ষে মানা সম্ভব হয়নি। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বের হতে হয়েছে কর্মের সন্ধানে।

Karail-cover-5

বস্তিতে বড় হওয়া গার্মেন্টস শ্রমিক মো. রুবেল মিয়া (২৭) বললেন, ’শুরুতে ঠাণ্ডা, শর্দি, কাশি ও জ্বরে কেউ অসুস্থ হইলেই করোনা বলে প্রচার হইয়া যাইত বস্তি এলাকায়। তার পরের দিনই আবার দেখা গেলো ঐ অসুস্থ ব্যক্তি সুস্থ-স্বাভাবিক। এইরকম একাধিক ঘটনার জইন্য করোনা নিয়া এমন উদাসীনতা তৈরি হইছে। কাজের খোঁজ করতে করতে বস্তির মানুষ বুইঝে গেছে করোনা তাদের কাবু করতে পারতাছে না। করোনা মনে হয় বড় লোকেরই রোগ।’

কড়াইল বস্তিতে ১৫ বছর ধরে আছেন কৃষ্ণা বর্মন (৩৪)। তিনি জানান, পাঁচ-সাত লাখ লোকের এই বস্তিতে কেউ আক্রান্ত হইলে কয়েক মিনিটের মধ্যে সারা বস্তি জাইনা যায়। কই, এতো দিন ধইরা এমন নিউজ পাই নাই। শুনি নাই। মৃত্যু তো অসম্ভব। ঠাণ্ডা-শর্দিজ্বর হইছে অনেকের। পরে এমনি এমনিই ছাইড়া গেসে।

’আমার পঁচাত্তর হাজার টাকা দেনা, দেনার যন্ত্রণায় বাড়িতে বাচ্চা দুইডারে পাঠায়া দিছি। বস্তির মানুষ ভয়ানক কষ্টে আছে। টাকা নাই, কাম নাই।’ যোগ করেন কৃষ্ণা। 

গৃহকর্মী নাজমা আক্তার (২৪)। এক অফিসে রান্নার কাজ করতেন। করোনায় সেই কাজ হারিয়েছেন। তিনি বলেন, ’কাজ-কাম নাই, খাইতে পারতেসি না। এইটাই বড় করোনা, আল্লাহ দিলে কড়াইল বস্তিতে করোনা নাই, শুনি নাই কারো করোনা হইছে। না থাকলে কি বানাইয়া কইমু? ’

সত্তরোর্ধ সালমা খাতুনের (৬৫) ভাষায়, বস্তিতে করোনা নাই, শুনি নাই কেউ করোনার ভিতরে আছে।

Karail-cover-3-3

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ২০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোহাম্মদ নাসির বলেন, ’ভোটার এবং ভোটার ছাড়া কড়াইল বস্তিতে তিন লাখের কম না বেশিই হবে মানুষ। ফার্স্ট করোনা ভাইরাস আসার পর থেকে ২৪ ঘন্টাই তাদের পাশে জড়িত ছিলাম। সব সময় খবর বার্তা রাখসি। বাস্তবতা এই যে আমরা সবাই করোনা ভাইরাস ভয় পাই। আতংকে ঘরে ঢুকে গেছি, ওরাও ঘরে ঢুকছিল। যেভাবে মিডল ক্লাসের লোকজন মারা গেছে, এই গরিব-দুখী যারা বস্তিবাসী আমরা শুনি নাই কোন লোক করোনায় মারা গেছে কিংবা করোনা হইসে।

দুইটা বস্তিতে করোনায় কোন লোক মারা গেছে এইরকম কোন ইনফেরমেশন পাই নাই কিন্তু বস্তির বাইরের এলাকায় অনেক লোক মারা গেছে।’

করোনায় বস্তিবাসীর এই টিকে থাকার ঘটনায় কাউন্সিলর নিজেও বিস্মিত।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীববিজ্ঞান বিভাগের এসোসিয়েট প্রফেসর ড. মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘ইমিউন সিস্টেমের একটা বড় ভূমিকা আছে করোনা ভাইরাসের ক্ষেত্রে। নিম্ন আয়ের মানুষ যারা বস্তিতে বসবাস করে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের বিরুপ পরিস্থিতির সাথে লড়তে লড়তে তাদের দেহে একপ্রকার রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়ে যায়। আবার তাদের অনেক প্ররিশ্রমও করতে হয়। শুধু বস্তিবাসি নয়, রিক্সা চালকদের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। করোনা ভাইরাস সংক্রমণ খুব একটা দেখা যায় না তাদের মাঝে। তারা যে আক্রান্ত হচ্ছে না, তা কিন্তু নয়। তাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার কারণে করোনা ভাইরাস তাদের শরীরে বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারছে না হয়তো। তবে এই বিষয়ে সঠিক তথ্যের জন্যে আমাদের গবেষণা দরকার।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৬১ সালে তৎকালীন টিএন্ডটির নামে ১৭০ একর জমি অধিগ্রহণ করে সরকার। এর আগে এই জমি ছিল ব্যক্তি মালিকানাধীন। ১৯৯০ সালে টিএন্ডটি ৯০ একর জমি পিডাব্লিউডির নামে বরাদ্দ করে। যা নিয়ে আইনগত বৈধতার প্রশ্নে বিরোধিতা শুরু হয় জমিদাতার সাথে। চুক্তি অনুযায়ী টিএন্ডটিই শুধু এই জমি ব্যবহারের অধিকার রাখে। এর মাঝেই ১৯৮৮ সালের বন্যায় উদ্বাস্তু মানুষেরা আশ্রয় নিতে থাকে কড়াইল বস্তিতে। প্রায় ১৬০ একর জমিতে গড়ে উঠেছে এই বস্তি।

বর্তমানে বস্তিতে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা ও তথ্য উপাত্ত নিয়ে বেশ বিতর্ক রয়েছে। বস্তিবাসীর দাবি অনুযায়ী ৫-৭ লাখের মতো মানুষের বাস এই বস্তিতে। ২০১৪ সালে বাংলাদেশে সর্বশেষ বস্তি শুমারি করেছিলো পরিসংখ্যান ব্যুরো। শুমারি অনুযায়ী সারা দেশে বস্তিবাসীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে ২২ লক্ষ।

Link copied!