বাঙ্গালির প্রাণের উৎসব কিংবা সরকার ঘোষিত জাতীয় যেকোন উৎসব মানেই বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক উদযাপন। রমরমা আলোকসজ্জার সাথে সাজানো মঞ্চে শিল্পীদের তাক লাগানো পরিবেশনার প্রধান অনুষঙ্গ উপযুক্ত সাউন্ড সিস্টেম। কনসার্ট কিংবা ঘরোয়া অনুষ্ঠান পুরো আয়োজনটাই যেন ব্যর্থ হয়ে যায় পর্যাপ্ত সাউন্ডের অভাবে, সে হোক মাইক কিংবা সাউন্ড বক্স।
সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বর্ষপূর্তি, রজতজয়ন্তী, সুবর্ণজয়ন্তী, হীরকজয়ন্তী, প্লাটিনামজয়ন্তী কিংবা শতবর্ষের অনুষ্ঠান কোথায় নেই সাউন্ডের ছড়াছড়ি! শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্লাসপার্টি, ব্যাচপার্টি, নবীন বরণ ও বিদায়কালীন অনুষ্ঠানের মূল আকর্ষণ শিক্ষার্থীদের সাথে আমন্ত্রিত অতিথি শিল্পীদের অংশগ্রহণে বৈচিত্রপূর্ণ সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। ব্যক্তিগত পর্যায়ে গায়ে হলুদ ও বিবাহবার্ষিকীসহ একাধিক প্রচলিত উৎসবে নাচ-গান-আবৃত্তি পরিবেশনা যেন মাইক কিংবা সাউন্ড বক্স ছাড়া প্রায় অসম্ভব। এ ছাড়া রাজনৈতিক কর্মসূচি এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানেও রয়েছে নানামাত্রিক সাউন্ডের ব্যবহার। আর এই প্রয়োজনীয় চাহিদার যোগান নিশ্চিত করতেই সারাদেশে পাল্লা দিয়ে গড়ে উঠেছে ছোট-বড় অসংখ্য সাউন্ড ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান। প্রাতিষ্ঠানিক এবং ব্যক্তি পর্যায়ের এই সকল উৎসব অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করেই এইসব সাউন্ড ব্যবসায়ীদের আয়-রোজকার।
আবার উৎসব মানেই আনন্দ। উৎসব মানেই জনাসমাগম। করোনাভাইরাস সংক্রমণ চক্র নিয়ন্ত্রণে জনসমাগম এড়াতে লকডাউনের পর শাটডাউনের অভিজ্ঞতা প্রত্যক্ষ করেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশে নমুনা পরীক্ষার বিচারে গড়ে প্রতি পাঁচ জনের একজন কোভিড রোগী শনাক্ত হচ্ছেন।
দেশে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের ১৬ মাস (২০২০সালের মার্চ থেকে ২০২১সালের জুন) অতিক্রান্ত হয়েছে। শহর সংক্রমিত করে গ্রামে পৌঁছে গেছে করোনা মহামারি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে দীর্ঘ সময় ধরে। বন্ধ হয়ে গেছে সকল প্রকার জনসমাগম উৎসব। মহামারি কেড়ে নিয়েছে মানুষের সকল প্রকার উৎসবমুখরতা। সেই সঙ্গে কেড়ে নিয়েছে উৎসব ঘিরে সাউন্ড ব্যবসায়ীদের রুটি-রুজির পথ। এমতাবস্থায় রোজগারের বিকল্প খুঁজছেন দীর্ঘমেয়াদী প্রাদুর্ভাবে সর্বশান্ত সাউন্ড ব্যবসায়ীরা।
সুমা মাইকের সত্ত্বাধিকারী মো. আরিফ দ্য রিপোর্টকে জানান, আমাদের কথাতো কেউ বলেনা। বউ-বাচ্চা নিয়া খুব বিপদের মধ্যে আছি,কর্মচারীদের কথা আর নাই কইলাম। কোনকিছু নাই দের বছর ধইরা বুঝেন না।
জানতে চাইলে রাব্বি সাউন্ড সার্বিসের সত্ত্বাধিকারী মো. তৈয়বুল্লাহ দ্য রিপোর্টকে বলেন, আমাদের অবস্থা খুবই করুণ। আজকে দেড় বছর ধরে ব্যবসার অবস্থা খুব খারাপ বুঝছেন। কর্মচারীদের অবস্থা শোচনীয়,দোকানে তালা।
রোর সাউন্ড সিস্টেমে ১৮জন কর্মচারীর মাঝে গোডাউনে মাত্র একজন কর্মরত আছেন উল্লেখ করে প্রতিষ্ঠানটির সত্ত্বাধিকারী মো. আফজাল হোসেন দ্য রিপোর্টকে জানান, দেশের এই অবস্থা। আমাদের অবস্থা আর কেমন থাকবে? উৎসব-অনুষ্ঠান-কনসার্ট কিছুই নাই, গোডাউনে তালা। কর্মচারীদের কেউ রিক্সা-অটোরিকশা চালাচ্ছে। মাঝে মধ্যে পাঁচশো একহাজার টাকা পাঠাই, এই আরকি। খুব খারাপ অবস্থা।
বাংলাদেশের ঐতিহাসিক সাউন্ড ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কলরেডী এড সার্ভিসের সত্ত্বাধিকারী এবং বাংলাদেশ মাইক সমিতির উপদেষ্টা তৃনাথ ঘোষ সাগর দ্য রিপোর্টকে জানান, ২০২০সালের মার্চ মাস থেকে সবকিছু বন্ধ। আমাদের ব্যবসার অবস্থাতো সবচাইতে খারাপ, খারাপ বলতে আমরা এখন কি করবো জানিনা। দিশেহারা হয়ে আছি। আমাদের ২০ জন স্থায়ী এবং অস্থায়ী আরও বিশজন কর্মচারীর মাঝে মাত্র একজন আছে। যে যার মতো যেভাবে পারছে জীবিকার তাগিদে কেউ রিক্সা চালাচ্ছে কেউ খেত-খামারে কাজ করছে। মুজিব বর্ষে বাম্পার ব্যবসা হওয়ার কথা কিন্তু কি হয়ে গেল।
সাউন্ড মেশিনের সত্ত্বাধিকারী তিতি ক্ষোভের সাথে এই পেশা পরিবর্তনের চেষ্টায় আছেন জানিয়ে দ্য রিপোর্টকে বলেন, মিউজিক এন্টারটেইনমেন্ট মিডিয়া এইগুলা আসলে মানুষের জীবনের সবচাইতে কম গুরুত্বপূর্ণ জিনিস যখন কোন অভাবে বা এইরকম একটা বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে। আমরাতো সবসময় একটা ক্ষতির মাঝেই থাকি। করোনা চলে গেলে যে অর্থনৈতিক ক্ষতির মধ্যে পড়সে দেশ, এইটা থেকে উঠবে, তারপর এই মিউজিক-এন্টারটেইনমেন্ট-সাউন্ড। এই পেশা পরিবর্তন করে যে পারছে সে চলে যাচ্ছে।
কিরকম ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন বলে মনে করেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, শিল্পীদের আর্থিক ক্ষতির বিষয়ে আমি কিছু বলতে চাইনা। শিল্পীরা কিছু না কিছু করে জীবন চালাবে। তারচেয়ে এই রাষ্ট্র এবং সমাজের অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। করোনা পরবর্তীতে একটা সাংস্কৃতিক শুন্যতা তৈরি হবে। আমি নিজেই অন্য একটা পেশায় যুক্ত হয়েছি।