সেপ্টেম্বর ৭, ২০২২, ১২:৩৯ এএম
রাজধানীর নান্দনিক সৌন্দর্য বর্ধনে নতুন মাত্রা যোগ করতে তৈরি করা হাতিরঝিলের ভেতর দিয়ে যাত্রীবাহী অবৈধ মাইক্রোবাস পরিবহনের অভিযোগ অনেক পুরোনো। নেই অনুমোদন, নেই ফিটনেস। যাত্রীদের বিড়ম্বনাকে পুঁজি করেই পরিকল্পিত অঞ্চলে চলছে মাইক্রোবাস। প্রশাসন দেখেও না দেখার ভান করে। যারা এই মাইক্রোবাস ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছেন, তাদের গায়ে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সাইনবোর্ড থাকায় তাদের বিরুদ্ধেও প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না। আবার ব্যবসা নিয়ন্ত্রণকারীরা থানা পুলিশকে মাসোহারা দিয়ে ম্যানেজ করে থাকেন বলে অভিযোগও রয়েছে।
হাতিরঝিল এলাকায় গণপরিবহন হিসেবে চালু রয়েছে চক্রাকার বাস। কিন্তু অনুমোদন ছাড়াই হাতিরঝিলে যাত্রী পরিবহনের জন্য চালু হয়েছে সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও মাইক্রোবাসের রুট। এই রুটের আওতায় কারওয়ান বাজার থেকে হাতিরঝিল হয়ে রামপুরা মোল্লা টাওয়ার পর্যন্ত প্রতিদিন চলছে শতাধিক অটোরিকশা ও মাইক্রোবাস, যার বেশির ভাগই ফিটনেসবিহীন।
হাতিরঝিল প্রকল্পের রামপুরা অংশ থেকে বেগুনবাড়ি সিগন্যাল পর্যন্ত মাইক্রোবাসে করে যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছে প্রতিদিন। প্রকল্পের দু’অংশে এসব পরিবহন চলাচলে রীতিমতো স্ট্যান্ড করা হয়েছে। সারিবদ্ধভাবে রাখা হয় মাইক্রো।
কারওয়ান বাজারের সামনে মাইক্রোতে বসে থাকা কয়েকজন যাত্রীর সঙ্গে কথা হয় দ্য রিপোর্ট ডট লাইভের। হাতিরঝিলের চক্রাকার বাস ও বোট সার্ভিস থাকার পরেও কেনো ফিটনেসবিহীন এই গাড়ি গুলোতে যাতায়াত করেন জানতে চাইলে তারা বলেন, ভাড়া বাঁচানোর জন্যেই এই সার্ভিস নেন। কারওয়ান বাজার থেকে হাতিরঝিল কোনায় রিক্সা ভাড়া নেয় ২০ টাকা। আবার চক্রাকার বাসের ভাড়া রামপুরা পর্যন্ত ২৫ টাকা। কিন্তু এই ম্যাক্রোতে গেলে ভাড়া নেয় ২৫ টাকা তাই এটাতেই চলাচল করেন তিনি।
প্রতিদিনে এই রুটে যাতায়াত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী কেয়া জাহানের। ভাড়া কম, হাটতে হয় কম তাই মাইক্রোবাসে কারওয়ান বাজার থেকে রামপুরা যান তিনি। কিন্তু নানা ভাবে হেনস্তার শিকার হন বলে জানান দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে। বলেন, ছোট একটা গাড়ি, নিশ্বাস ফেলার জায়গা থাকে না। অনেক চাপাচাপি করে বসতে হয়। অনেক গাড়ির দরজা ঠিক মত লাগে না। তাই দরজার পাশে বসলে ভয় হয়। চালকরা ওভার স্পিডে গাড়ি চালায়। কিছু বললে বলে, ঊটতে মন চাইলে যাবেন, না হলে নিজের প্রাইভেট গাড়িতে যাতায়াত করবেন। আমাগো গাড়ি এমনেই চলে।
‘আমি একজন ছাত্রী তাই সময়, গাড়ি ভাড়া বাঁচাতেই এত কিছু শুনেও এই মাইক্রোতে যাতায়াত করি” এমন্ টাই বলেন তিনি।
কয়েকবার এই রুটে গাড়ি বন্ধ করাসহ ডাম্পিং ও জরিমানা করা হলেও আটকানো যায়নি এই সিন্ডিকেটকে। কারা এর নেপথ্যে কাজ করছে তা কারোর জানা নেই। তবে এই রুটে মাইক্রোবাস চালাতে লাইনম্যানের অনুমতি ও প্রতিদিন লাইনম্যানকে চাঁদা দিতে হয় বলে জানান মো. রাশেদ নামে এক মাইক্রোবাস চালক। বলেন, এই পুরো সিস্টেমটা চালায় লাইনম্যান মাসুদ। যাকে প্রতিদিন ৮০০ থেকে ১২০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেকজন চালক জানান, আগে লেগুনা চালাতাম আর এখন হাতিরঝিল পারাপারে মাইক্রোবাস চালাই। প্রতি ক্ষেপে ৪২০ টাকা যাত্রীদের কাছ থেকে নেই। জন প্রতি ভাড়া ৩০টাকা। দিনে ১২ থেকে ১৫ বার ক্ষেপ মারি।
লাইসেন্স আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার বয়স হয়নি তাই লাইসেন্স করতে দিতে পারিনা। আর এই রুটে কেউ লাইসেন্স দেখতে চায় না।
এমনই একজন মাইক্রোবাস চালক আশিক। যার এই রুটের নিজের গাড়ি চলে। তিনি বলেন, এই রুটে মাইক্রোবাস চালকদের শক্তির উৎস হচ্ছে কাউন্সিলর ও লাইনম্যান মাসুদের ৮ থেকে ১০টা নিজস্ব গাড়ি। এছাড়াও সংরক্ষিত ৮ নাম্বার ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মিতু আক্তার। যার নিজেরও রয়েছে এই রুটে গাড়ি।তাদের শক্তিতেই বাকি চালকরা সবার সাথে দুর্ব্যবহার করে।
মাঝেমাঝে যাত্রী উঠানোর সিরিয়াল নিয়ে চালকদের মধ্যে দেখা দেয় বাকবিতণ্ডা। এই রুটে চলাচলকারী এক মাইক্রোর মালিক ও চালক সিদ্দিকুর রহমান জানান, সংরক্ষিত ওয়ার্ড ৮-এর কাউন্সিলর মিতু আক্তারের রাজনৈতিক পাওয়ারে অন্য চালকরা সব সময় ঝামেলা করে, সিরিয়াল ভঙ্গ করে।
এ বিষয়ে জানতে কাউন্সিলর মিতু আক্তারের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি পরোপুরি বিষয়টা অস্বীকার করেন।
মিতু আক্তারকে হাতিরঝিলে মাইক্রোবাসের চালকদের সাথে ঝামেলা মেটাতে দেখা গেছে বহুবার। এই বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, নিজ এলাকায় পড়েছে হাতিরঝিল। তাই এখানে কোন ঝামেলা হলে তিনি নিজে এসে সেটা মিটমাট করেন। এই রুটে তার কয়টা গাড়ি এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি ভড়কে যান এবং বলেন, এই রুটে তার কোন গাড়ি নেই। এলাকার মধে তাই তিনি আসেন।
অনেক খোঁজাখুঁজির পর পাওয়া যায় লাইনম্যান মাসুদকে। রামপুরার বাসিন্দা মোহাম্মদ মাসুদ এই ব্যবসার নিয়ন্ত্রক। চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে হাতিরঝিল রুটের লাইনম্যান-এই কথাগুলো অস্বীকার করে বলেন, আমার এই রুটে ৭ থেকে ৮টা গাড়ি আছে। অন্যদের মত তিনিও এই রুটে ব্যবসা করেন।
এই রুটে চক্রাকার বাস ছাড়া সকল প্রকার যাত্রীবাহী পরিবহন অবৈধ তাহলে কেনো এই রুটে মাইক্রো নামিয়েছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা গরীব মানুষ। কিছু গরীব মানুষের পেট চালাতেই এই ব্যবসা করি।
কিন্তু তিনি নিজেই লাইনম্যান মাসুদ সেই বিষয়টি পুরোপুরি অস্বীকার করেন এবং কথা এড়িয়ে খুব দ্রুত স্থান ত্যাগ করেন।
এ বিষয়ে হাতিরঝিল এলাকায় চক্রাকার বাস কাউন্টারের সুপারভাইজার সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘অবৈধ রুটের এসব যানবাহনের কারণে প্রায়ই হাতিরঝিলে জ্যাম হয়। অনেক দুর্ঘটনাও ঘটে, তবে কেউ কোন ব্যবস্থা নেয়না।’
জানা গেছে, একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের ১৫ থেকে ২০ জন মাইক্রোবাস চলাচলের পুরো বিষয়টি দেখাশোনা করছেন। পার্শবর্তী ৬টি থানাকে মোটা অঙ্কের মাসোহারাও দিচ্ছেন। একাধিক ড্রাইভারে সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে গুলশান, বাড্ডা, রামপুরা, রমনা, তেজগাঁও ও তেজগাঁও শিল্প থানাকে ম্যানেজ করে অনৈতিকভাবে মাইক্রোবাস চলছে এ এলাকায়।
অবৈধ যানবাহন এবং নিরাপত্তা প্রসঙ্গে রাজানী উন্নূয়ন কর্তপক্ষ’র ( রাজউক) চেয়ারম্যান মো. আনিছুর রহমান মিঞা দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, ‘অটোরিকশা ও মাইক্রোবাস বন্ধ করতে ট্রাফিক বিভাগ এবং হাতিরঝিল থানাকে চিঠি দিয়েছি। পুলিশের গোয়েন্দা শাখার ( ডিবি) প্রধানকে অনুরোধ করেছি তাঁর টিম পাঠাতে, যাতে সন্ধ্যার পর হাতিরঝিলে মানুষের নিরাপত্তা বিঘ্নিত না হয়।’
এ বিষয়ে সহকারী পুলিশ কমিশনার কাজী মিজানুর রহমান জানান, হাতিরঝিল একটি বাইপাস রোড। এই রুটে যাত্রীবাহী মাইক্রোবাস নিষিদ্ধ। আর তাই আমরা সবসময় রেকি ও তদারকি করি।
ট্রাফিক পুলিশের সামনে দিয়ে কি করে এই মাইক্রো যাতায়াত করে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি আরো বলেন, “আমার জানা মতে এমন হওয়ার কথা নয়। আমাদের চোখে পড়লেই আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করছি।’
পুলিশ বললেও তাদের নেওয়া ব্যবস্থা চোখে পড়েনা রাজধানীবাসীর। তবে চোখে না পড়লেও হাতিরঝিল হয়ে উঠবে মাইক্রোবাস পরিবহনমুক্ত, যানজট ও ঝামেলামুক্ত-এটাই তাদের প্রত্যাশা।