মার্চ ২৯, ২০২৩, ০৪:২৭ পিএম
দেশের নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে ৯০.২ শতাংশই নিজের খাদ্যাভাসে আমূল পরিবর্তন এনেছে। মাত্র ৬ মাসের ব্যবধানে এই পরিবর্তন আনতে বাধ্য হয় তারা। কেননা এই সময়ে আয় বৃদ্ধি না পেলেও ব্যয় প্রায় ১৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। আর খরচ চালাতে ৭৩.৮ শতাংশ মানুষ ধার দেনা করে চলতে হচ্ছে।
প্রতি পাঁচ জনের একজন না খেয়ে থাকে
সারা দেশে নিম্ন আয়ের এক হাজার ৬০০ জন মানুষের ওপর জরিপ করে গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং বা সানেম জানতে পেরেছে, এদের প্রতি পাঁচ জনের একজনের কোনো না কোনো দিন অর্থাভাবে না খেয়ে থাকতে হয়েছে বা হচ্ছে। ছয় মাস আগেও যা ছিল অর্ধেক। যাদেরকে প্রশ্ন করা হয়েছে, তাদের এক তৃতীয়াংশের কিছু কম মানুষ স্বল্পমূল্যে সরকারের খাদ্য বিক্রি কর্মসূচির সুবিধাভোগী। বাকিরা সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির অংশ হিসেবে সরাসরি টাকা পান সরকার থেকে।
তাদের কাছ থেকে আসা বক্তব্য বিশ্লেষণ করে অর্থনীতি নিয়ে গবেষণা করা সংস্থাটি জানাচ্ছে, ‘না খেয়ে থাকা’ এই মানুষের সংখ্যা গত ছয় মাসে দ্বিগুণ হয়েছে। বুধবার রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে ‘কেমন আছেন নিম্ন আয়ের মানুষ?’ শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে জরিপের ফলাফল এবং গরিব মানুষের আয়-ব্যয় চিত্র তুলে ধরেন সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান।
তিনি জানান, মূল্যস্ফীতি গরিবদের জীবনে কতটা প্রভাব ফেলেছে, তা জানতে গত ৯ থেকে ১৮ মার্চ সারাদেশে আটটি বিভাগের প্রতিটিতে ২০০ জন করে মোট ১ হাজার ৬০০ নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর এই জরিপ চালানো হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, খরচ চালাতে হিমশিম খাচ্ছে অধিকাংশ পরিবার। যে কারনে ৩৯.৩ শতাংশ নিম্ন আয়ের মানুষ অতিরিক্ত কাজ করছে। ১৩.১ শতাংশ মূল কাজের পাশাপাশি নতুন আরেকটি কাজে যোগ দিচ্ছে। এছাড়া প্রায় ১০ শতাংশ মত লোক জমি, স্থাবর জিনিস বিক্রি ও পড়াশুনার খরচ কমিয়ে এনেছে। এদিকে মেয়েকে দ্রুত বিয়ে দেয়ার ঘটনাও হয়েছে।
ভালো নেই নগরবাসী
খাদ্যাভাসে পরিবর্তনে গ্রামের চেয়ে শহরের বাসিন্দারা বেশি ভুক্তভোগী। গ্রামের ৮৬ শতাংশ নিম্ন আয়ের মানুষ খাদ্যে পরিবর্তন আনলেও শহরের খাদ্যাভাসে পরিবর্তন এনেছে ৯৪.৪ শতাংশ মানুষ। এদিকে অন্য সব সূচকে শহরের নিম্ন আয়ের মানুষ নেতিবাচক অবস্থানে রয়েছে।
প্রতি ১ হাজারে মাত্র ৩ জন খাচ্ছে গরুর মাংস
এদিকে বিশেষ বা দামি খাবার নিম্ন আয়ের মানুষ খায় না বললেই চলে। বর্তমানে প্রতি ১০০০ জনে মাত্র ৩ জন গরুর মাংস খায় আর মুরগীর মাংস খেতে পারে মাত্র ২০ শতাংশ মানুষ। খাদ্যপণ্যের মধ্যে ভাত খাওয়া কমিয়েছে ৩৭.০৮ শতাংশ মানুষ। মাংস খাওয়া কমিয়েছে ৯৬.৪ শতাংশ মানুষ। মাছ ও ডিম খাওয়া কমিয়েছে ৯৬.৪০ ও ৮৮.২২ শতাংশ মানুষ।
শুধু মাত্র খাওয়ার পরিমানই কমায় নি বরং মানসম্মত খাবারের ক্ষেত্রেও ছাড় দিচ্ছে তারা। চালের ক্ষেত্রে কমদামী চাল, ভাঙ্গা ডিম, খোলা পাম তেল ইত্যাদির দিকে ঝুঁকছে তারা। ভাতের ক্ষেত্রে মান কমিয়েছে ৫৬.৪৮ শতাংশ মানুষ, ডিমের ক্ষেত্রে ৫৭.০৩ শতাংশ মানুষ। মাছ ও মাংসের ক্ষেত্রে মান কমিয়েছে ৮৬.৩৫ শতাংশ ও ৮৭.০৪ শতাংশ মানুষ।
চিকিৎসা ও শিক্ষায় ছাড়
এতে আরও বলা হয়, খাদ্যের ব্যয় মেটাতে বস্ত্র, চিকিৎসা, শিক্সাসহ অন্যান্য খাতে ব্যয় কমিয়ে আনছে নিম্ন আয়ের মানুষ। প্রায় ৯২.৪ শতাংশ মানুষ পোশাক কেনা কমিয়ে দিয়েছে। চিকিৎসায় বাবদ খরচ কমিয়েছে ৬০.৯ শতাংশ। এছাড়া শিশুর শিক্ষায় খরচ কমিয়েছে ৪৫.১ শতাংশ।
আর কম মূল্যে পণ্য পেতে ২৮.৫০ শতাংশ নিম্ন আয়ের মানুষ টিসিবি’র ট্রাক সেলে অপেক্ষা করে। এদের মধ্যে অনেকেই ৫ ঘন্টা ধরেই ট্রাকের সামনে অপেক্ষা করে। আর ভবিষতে চলার জন্য এরা ধার করাকেই প্রধান উপায় বলে বেছে নিয়েছে।
খাদ্যের ব্যয় মেটাতে ‘ঋণের দুষ্টু চক্রে’
সানেমের জরিপ দলের সদস্য সায়মা হক বিদিশা বলেন, “মূল্যস্ফীতির সময়ে দেশের সাধারণ মানুষের জীবনে তা কতটা প্রভাব ফেলছে আমরা সেটাই দেখতে চেয়েছি। গত ছয় মাসে তাদের আয় না বাড়লেও ব্যয় কী হারে বেড়েছে সেটাই আমরা দেখতে পেলাম। জীবন যাপন করতে এ ধরনের মানুষজন ক্ষুদ্রঋণসহ বিভিন্ন মাইক্রো ক্রেডিট ফার্ম থেকে ঋণ নিচ্ছে। এভাবে নতুন করে ঋণের দুষ্টু চক্রে আবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে।”