চনপাড়া: যেখানে সন্ধ্যা নামে অপরাধীদের মুখে হাসি ফুটিয়ে!

আহম্মেদ মুন্নী

জুলাই ২৩, ২০২৩, ০৬:৫৮ পিএম

চনপাড়া: যেখানে সন্ধ্যা নামে অপরাধীদের মুখে হাসি ফুটিয়ে!

দিনের বেলা লোকজনের তেমন উপস্থিতি না মিললেও রাতে সরব হয়ে উঠে চনপাড়া। ছবি: দ্য রিপোর্ট ডট লাইভ

দেশের স্বাধীনতা লাভের পর বিধ্বস্ত দেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বহু কল্যাণমূলক উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। এগুলোর মধ্যে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন অন্যতম। কারণ তারাই দেশ এনে দিয়েছেন। এমনই একটি পুনর্বাসন কেন্দ্র হল ঢাকার অদূরে চনপাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্র। কথা ছিল বিশাল এলাকা জুড়ে বানানো ওই বসতিটি মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানী, পঙ্গু ও অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা এবং বীরাঙ্গনাদের এবং তাদের পরবর্তী প্রজন্মের পদচারণায় ধন্য হয়ে উঠবে। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করা হলে ওই পুনর্বাসন কেন্দ্রটিও যেন হারিয়ে ফেলে তার পথ। তারপর থেকে চনপাড়ায় শুরু হয় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। গত কয়েক দশকে এটি পরিণত হয়েছে অপরাধের আখড়ায়। স্থানীয়রা বলেন, এমন কোনো অপরাধ নেই যা চনপাড়ায় হয় না! এখানে সন্ধ্যা নামে অপরাধীদের মুখে হাসি ফুটিয়ে!

চনপাড়া! নামটি এখন শুনলে প্রথমে যে দৃশ্যটি মানসপটে ভেসে উঠে তা কোনো পুনর্বাসন কেন্দ্র নয়, অপরাধ আর অপরাধীদের স্বর্গরাজ্যেরই প্রতিচ্ছবি। এখানকার অপরাধীরা বেপরোয়া। লোকে বলে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও এখানকার অপরাধীদের সমঝে চলেন! অথচ ঢাকা থেকে মাত্র ১৮ কিলোমিটারের অদূরে অবিস্থিত ১২৬ একর জমি নিয়ে গড়ে উঠা ওই বসতিটি সত্যিকারের পুনর্বাসন কেন্দ্র হয়ে গড়ে উঠবার কথা ছিল। কিন্তু হয়ে গেছে অপরাধীদের বিচরণ কেন্দ্র! মাদকের বিপণন কেন্দ্র!

শীতলক্ষ্যা ও বালু নদের মোহনা ঘেঁষে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার কায়েতপাড়া ইউনিয়নে অবস্থিত এই চনপাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্র। কেন্দ্রে কয়েক হাজার ছোট ঝুপড়ি ঘরে দেড় লক্ষাধিক মানুষের বাস। স্থানীয়দের ভাষ্য, বাসিন্দাদের বেশিরভাগই কমবেশি মাদক ব্যবসায়ী। মাদককে কেন্দ্র করে জুয়া, চাঁদাবাজি, চুরি, ডাকাতিসহ হেন কর্মকাণ্ড নেই যা এখানে ঘটছে না। ফিবছর একাধিক খুনের ঘটনাও ঘটছে। চার দশকে এখানে ২৩টি খুনের কথা জানা যায়। তবে প্রকৃত পরিসংখ্যান আরও ভয়াবহ!

রূপগঞ্জ উপজেলার সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা এটি। অধিকাংশ মানুষ ভাসমান এবং দরিদ্র। ফলে খুব সহজেই এখানে ঘাঁটি গেড়েছে সন্ত্রাসী ও মাদক কারবারিরা।

সম্প্রতি এই প্রতিবেদক ওই পুনর্বাসন কেন্দ্রে সরেজমিনে কয়েকদিন গিয়ে এলাকাটি ঘুরে দেখেন। দিনের বেলা সেখানে রাস্তাঘাট, দোকানপাট তেমন একটা খোলা থাকে না। লোকজনও থাকে না এলাকায়। পুরো এলাকা জুড়ে শুনশান নীরবতা থাকে। কিন্তু সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলেই দৃশ্যপট বদলাতে থাকে। রাস্তার নিয়ন বাতি জ্বলে উঠার সাথে সাথে চনপাড়া যেন অন্য চেহারায় জেগে উঠে।

নানা জায়গা থেকে লোকজন আসতে থাকে। এদের বেশিরভাগই মাদকসেবী কিংবা মাদক ক্রেতা। বহিরাগত এই লোকদের বিশেষ সমাদর করা হয়। সারাদেশে সাধারণত টং চায়ের দোকানে চেয়ার-টুল দিয়ে চা পরিবেশন করা হলেও চনপাড়ার এই মাদক ক্রেতাদের বসতে দেওয়া হয় মাদুর বিছিয়ে বিশেষ কায়দায়। যদিও চা দোকানগুলোর এক কোণায় চায়ের কেটলি ও বিস্কুট সাজানো থাকে, তবে সেগুলো লোক দেখানোর জন্য! এসব দোকানের ভেতরে শাটার আংশিক খোলা অথবা বন্ধ করে ভেতরে রাখা হয় মৃদু আলো-আঁধারির ব্যবস্থা।

এরকম একটি পরিবেশেই পরিবেশন করা হয় নানা ধরনের মাদক। একেক দোকানে জনা দশেক থেকে ১৫ জন বসে মাদক সেবন করে। কাউকে কাউকে নিয়ে যাওয়া হয় শীতলক্ষ্যায়। সেখানে ভ্রাম্যমাণ নৌকায়ও চলে মাদক সেবন। এভাবে চলে সারারাত।

ভোরের আলো ফুটতে শুরু করলেই বহিরাগত মাদক ক্রেতা ও সেবনকারীরা বিদায় নেয়। পুরো চনপাড়ার দিনের বেলা আবারও অস্বাভাবিক জনশূন্যতা ভর করে! চনপাড়ায় এরকম মাদক সেবনের টং ঘর আছে হাজারের ওপরে!

চনপাড়ায় অঘোষিত এক ‘কারফিউ জারি’ করে রাখে মাদক কারবারিরা। বাইরের লোকদের সাথে স্থানীয়রা কথা বলে মেপে মেপে। স্থানীয় এক যুবক নাম না প্রকাশ করে জানালেন, চনপাড়ায় সূর্য ডুবলে শুরু হয় দিন! তখনই শুরু হয় মাদকের রমরমা আসর। এই আসর চলে গভীর রাত পর্যন্ত। খুপরি চায়ের দোকান ছাড়াও ফেরি করে চলে মাদক বেচাকেনা। দোকানগুলোর শাটার খুলে চলে ইয়াবা বিকিকিনি। গাঁজা ও হেরোইনের পুরিয়াও বিক্রি হয় ফেরি করে। শিশু ও কিশোররা মাদকের বাহক হিসেবে কাজ করে। আবার অনেক মহিলাও বিশেষ কায়দায় বেচেন মাদকদ্রব্য। মাদকসেবীদের কেউ কেউ চলে যান শীতলক্ষ্যার বুকে নৌকায় ভেসে মাদক সেবন করতে।

ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ জেলার সীমান্তবর্তী শীতলক্ষ্যা এবং বালু নদের মোহনায় অবস্থিত এই চনপাড়া পুর্নবাসন কেন্দ্রে প্রবেশ ও বের হওয়ার পথ রয়েছে অনেক। ফলে একদিক দিয়ে অভিযানের জন্য পুলিশ প্রবেশ করলে মাদকসেবীরা অন্যপথ দিয়ে সহজেই বের হয়ে যায়। এখানকার মানুষজন দিনমজুর, ঠেলাগাড়ি চালক, রিকশাচালক, ফেরিওয়ালা, গার্মেন্টস শ্রমিক হলেও এখানে মাদক কারবারি, পেশাদার কিলার, ছিনতাইকারী, মলম-খয়ের পার্টির সদস্যরাও সংখ্যায় অনেক। ফলে মাদক সেবন বা অপরাধমূলক কাজের তদবির বা বায়নার লোকজন ছাড়া এখানে কেউ আসে না বললেই চলে।

চনপাড়া মাদক সেবনকারী, বিক্রেতা ও ব্যবসার জন্য সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত। প্রশাসন বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা এখানে সহসাই যান না।

এ বিষয়ে কথা হয় রূপগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ এ এফ এম সায়েদের সাথে। তিনি বলেন, চনপাড়া বস্তিতে মাদক আছে, এটা অস্বীকার করা যাবে না। চনপাড়ায় পুলিশের একটি টিম প্রতিদিন অভিযান পরিচালনা করে। এলাকাটা ঘিঞ্জি। পুলিশ ঢোকার আগেই মাদক কারবারীরা পালিয়ে যায় নদীপথে। দেখেছেন তো পাশেই শীতলক্ষা নদী। আমরা আমাদের অভিযান নিয়মিত পরিচালনা করি। আসলে এখানে দুই লাখ মানুষ যদি বসবাস করে, সেই দুই লাখই যদি হয় মাদক ব্যবসায়ী অথবা মাদকসেবী বা তাদের সহযোগী, সেটা একটু কঠিনই। আমরা অভিযান পরিচালনা করতে গিয়ে যদি দুই থেকে তিন শতাধিক পুলিশ সদস্যও নিয়ে যাই, তাহলেও তারা তাদের মহিলা ও নারীদের দিয়ে একটি ঢাল তৈরি করে ফেলে। মহল্লায় ঢুকতে গেলে এরা বিবস্ত্র হয়ে পুলিশের দিকে তেড়ে আসে। শুধু তাই নয় তারা আরও অনেক রকম প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। তারপরও আমাদের আসামী ধরা ও অভিযান থেমে নেই। এখান থেকে মাদক নির্মূল করতে আমরা বদ্ধ পরিকর।

এ বিষয়ে রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ ফয়সাল হক বলেন, চনপাড়া বস্তি যে মাদক ও অপরাধীদের আখড়া, সে কথা অস্বীকারের কোনো সুযোগ নেই। ১২ জুন উপ-নির্বাচন থাকায় সে সময় অভিযান কিছুটা কম ছিল। তবে তার আগে অনেকগুলো বড় ধরনের অভিযান টানা চালানো হয়েছে। আবারও খুব তাড়াতাড়ি অভিযান চালানো হবে।

Link copied!