হাঙ্গর ও রে মাছসহ বিশ্বব্যাপী বিপন্ন সামুদ্রিক বন্যপ্রাণীদের বৈচিত্র্যময় আবাসস্থলগুলোর মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ বাংলাদেশ অন্যতম। দেশটি প্রায় ১০০ প্রজাতির মহাবিপন্ন এসব সামুদ্রিক প্রাণির আদর্শ আবাসস্থল হিসেবে এগুলোকে টিকিয়ে রেখেছে।
বঙ্গোপসাগর দক্ষিণ এশিয়ায় হাঙর ও রে বাণিজ্যের অন্যতম হটস্পট। দেশটির সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে প্রতিবছর এখান থেকে দুই হাজার টন হাঙরের শুকনো পাখনা রপ্তানি করা হয়। যা থেকে দেশটি প্রায় দুই মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে।
সামুদ্রিক প্রতিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে এবং মানব জাতির জন্য একটি সুস্থ সাগর নিশ্চিত করতে হাঙ্গর ও রে মাছের অবদান অনস্বীকার্য।
সাধারণত এদের বংশ বিস্তার ও বেড়ে ওঠা ধীরগতি সম্পন্ন হওয়ার ফলে অতিরিক্ত মৎস্য আহরণ এদের টিকে থাকার জন্য মারাক্ত হুমকিস্বরূপ। এছাড়া হাঙ্গর ও রে মাছের পাখনা, ফুলকা প্লেট ও চামড়ার উচ্চমূল্যের কারণে এগুলো আন্তর্জাতিক বাজারগুলিতে ব্যাপক চাহিদা থাকার দরুণ অবৈধভাবে শিকার ও রপ্তানির ফলে বিপন্ন প্রজাতিগুলো ভবিষ্যতে প্রকৃতি থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে।
বাংলাদেশ সরকার বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, ২০১২-এ অন্তর্ভুক্ত প্রজাতি ও প্রজাতিগোষ্ঠীর তালিকা হালনাগাদ করার মাধ্যমে বিপন্ন হাঙ্গর ও রে মাছের অধিকতর সুরক্ষা প্রদানে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এই হালনাগাদকৃত তালিকা হাঙ্গর ও রে মাছের আটটি গণ ও ২৩ টি প্রজাতিসমূহকে যথাযথ সুরক্ষা প্রদান এবং বন অধিদপ্তরের অনুমতিক্রমে একটি গণ ও ২৯ টি প্রজাতির হাঙ্গর ও রে মাছের টেকসই আহরণ, ব্যবহার ও বৈধভাবে বাণিজ্য করার অধিকার প্রদান করবে, যদি এদের আহরণ সামুদ্রিক পরিবেশে প্রজাতিগুলোর টিকে থাকার জন্য হুমকির কারণ হিসেবে চিহ্নিত না হয়।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সম্মানিত সচিব জনাব মোঃ মোস্তফা কামাল বলেন যে, ‘বাংলাদেশ ১৯৮১ সালে Convention on International Trade in Endangered Species of Wild Fauna and Flora (CITES) এবং ২০০৫ সালে Convention on the Conservation of Migratory Species of Wild Animals (CMS) এ স্বাক্ষরকারী দেশ । সুতরাং, হাঙ্গর ও রে মাছসহ বিপন্ন বন্যপ্রাণীর বৈধ বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি অবৈধ বাণিজ্য প্রতিরোধ করা আমাদের দায়িত্ব। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতি রক্ষার্থে নিবেদিতভাবে কাজ করে চলেছে।’
বাংলাদেশ বন অধিদপ্তরের প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমির হোসাইন চৌধুরী জানান, ‘বাংলাদেশে নিশ্চিতভাবে প্রাপ্ত বা পাওয়া যেতে পারে এমন ১১৬ প্রজাতির হাঙ্গর ও রে মাছের অর্ধেকেরও বেশি প্রজাতি বর্তমানে হুমকির সম্মুখীন। এই সংশোধিত তালিকাটি বন অধিদপ্তর এবং অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে বিশ্বব্যাপী মারাত্মকভাবে হুমকির সম্মুখীন কিছু সামুদ্রিক বন্যপ্রাণীকে সুরক্ষা প্রদান করতে যেমন কার্যকর ভূমিকা পালন করবে, তেমনি বিপন্ন নয় এমন প্রজাতিসমূহের টেকসই আহরণের লক্ষ্যে একটি সুনির্দিষ্ট কাঠামো বাস্তবায়নের মাধ্যমে স্থানীয় মৎস্যজীবীদের লাভবান করবে।’
বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চল, ঢাকা এর বন সংরক্ষক মোল্যা রেজাউল করিম বলেন, ‘মৎস্য অধিদপ্তর সহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞগণের মতামতের ভিত্তিতে এবং ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন সোসাইটি (ডাব্লিউসিএস) এর কারিগরি সহযোগিতায় বাংলাদেশ বন অধিদপ্তর কর্তৃক প্রস্তুতকৃত এই হালনাগাদ তালিকায় বাংলাদেশে প্রাপ্ত হাঙ্গর ও রে মাছ সম্পর্কিত নতুন তথ্য সংযোজন করা হয়েছে। এই হালনাগাদ তালিকা বিপন্ন সামুদ্রিক বন্যপ্রাণী এবং এদের গুরুত্বপূর্ণ আবাসস্থল রক্ষায় বাংলাদেশ সরকারের আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক ও সাংবিধানিক অঙ্গীকারের ভিত্তিতে প্রস্তুত করা হয়েছে। ”
বন অধিদপ্তরের বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট এর পরিচালক এএসএম জহির উদ্দিন আকন জানান, ‘OCITES Convention অনুযায়ী বিশ্বে হাঙ্গর ও রে মাছের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এই কনভেনশন অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রাপ্ত তিন প্রজাতির করাত মাছের বাণিজ্য সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তবে এই কনভেনশন মোতাবেক বাংলাদেশে প্রাপ্ত ২৫ প্রজাতির হাঙ্গর ও রে মাছ রপ্তানি করতে হলে বন অধিদপ্তর কর্তৃক ইস্যুকৃত CITES পারমিট আবশ্যক। এই CITES পারমিট তখনই প্রদান করা হবে, যখন এই প্রজাতিসমূহের আহরণ ও বাণিজ্য প্রাকৃতিক পরিবেশে এদের টিকে থাকার জন্য ক্ষতির কারণ নয়-এরূপ সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যাবে।’
মৎস্য অধিদপ্তরের সামুদ্রিক মৎস্য জরিপ ব্যবস্থাপনা ইউনিটের পরিচালক ড. মো. শরীফ উদ্দিন বলেন, ‘বঙ্গোপসাগরে প্রাপ্ত হাঙ্গর ও রে মাছের বিলুপ্তির ঝুঁকি হ্রাস করার ক্ষেত্রে আইনের এই সংশোধনী প্রণয়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।’
তিনি আরও বলেন, ‘আইনের এই সংশোধনীর কার্যকরী প্রয়োগ নিশ্চিতকরণের সাথে সাথে প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে আইনে সংরক্ষিত প্রজাতিগুলোর জীবিত অবমুক্তকরন পদ্ধতি এবং টেকসই মৎস্য ব্যবস্থাপনার প্রতিবেশগত উপকারী দিকগুলি সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করতে হবে। যদি মৎস্যজীবী, মৎস্য ব্যবসায়ী এবং ভোক্তারা বুঝতে পারে যে বিপন্ন হাঙ্গর ও রে মাছ রক্ষার মাধ্যমে তারা তাদের জীবন-জীবিকা ও খাদ্যসুরক্ষা নিশ্চিত করছে, তাহলে বাংলাদেশে হাঙ্গর ও রে মাছের অত্যধিক আহরণকে ভবিষ্যতে টেকসই সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। ’
সূত্র: ফোর্বস।