ডিসেম্বর ১৬, ২০২১, ০২:৩২ পিএম
দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধ শেষে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিলো। যুদ্ধে অতুলনীয় সাহস এবং আত্মত্যাগের প্রদর্শনের মাধ্যমে এ জাতি ছিনিয়ে আনে স্বাধীনতা। দেশ স্বাধীনের পর যুদ্ধে এই আত্মত্যাগ এবং অপরিসীম বীরত্বের নিদর্শনস্বরূপ সাত যোদ্ধাকে বীরশ্রেষ্ঠ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। বিজয়ের এই মাসে আমরা নিয়ে এসেছি এই সাত যোদ্ধার গল্প। দ্বিতীয় পর্বে আজ থাকছে বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল এবং বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ রুহুল আমিনের কথা।
সন্তানের মুখ দেখতে পারেননি বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল
মুক্তিযুদ্ধের সময় চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে ঘিরে তিনটি প্রতিরক্ষা ঘাঁটি গড়ে তুলেছিলো এন্ডারসন খালের পারে। চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দুই নম্বর প্লাটুনের একজন সেকশন কমান্ডার ছিলেন সিপাহী মোস্তফা কামাল।
১৪ এপ্রিল থেকে পাকিস্তানী বাহিনী চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ওপর ত্রিমুখী আক্রমণ চালায়। পাকিস্তানীদের আক্রমণে দুই নম্বর প্লাটুনের সমস্ত রেশন ধ্বংস হয়ে যায়। মোস্তফা কামাল রেশনের জন্য মেজর শাফায়াতকে অনুরোধ করলে মেজর শাফায়াত তাদেরকে অনতিবিলম্বে প্রতিরক্ষা অবস্থানে যেতে নির্দেশ দেন এবং রেশনের ব্যবস্থা করেন।
১৭ এপ্রিল সকাল থেকে পাকিস্তানী বাহিনী প্লাটুন পজিশনের ওপর তীব্র গোলাবর্ষণ শুরু করে। খবর পেয়ে মেজর শাফায়াত অবস্থানকে আরো শক্তিশালী করতে হাবিলদার মুনিরের নেতৃত্বে ডি কোম্পানির ১১ নম্বর প্লাটুন পাঠান। সারাদিন যুদ্ধের পর ১৮ এপ্রিল সকালে শত্রুবাহিনী দরুইন গ্রামের কাছে পৌঁছে যায়।
দুপুর ১২ টায় অবস্থানের পশ্চিমদিক থেকে মূল আক্রমণ শুরু হয়। শত্রুর একটি দল প্রতিরক্ষার পিছন দিক দিয়ে মুক্তিবাহিনীকে ঘিরে ফেলে। মুক্তিবাহিনী দরুইন গ্রাম থেকে আখাউড়া রেল স্টেশনের দিকে পশ্চাদপসরণের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু ওই অবস্থান থেকে নিরাপদে সরে যাওয়ার জন্য তাদের নিরবচ্ছিন্ন কাভারিং ফায়ারের প্রয়োজন ছিল। মোস্তফা কামাল সহযোদ্ধাদেরকে কাভারিং ফায়ার দেয়ার কথা বলে নিজে রয়ে যান আক্রমণের মুখে। সহযোদ্ধারা মোস্তফাকে পশ্চাদপসরণের অনুরোধ করলেও তিনি অবিচল ছিলেন।
কাভারিং ফায়ার দেয়ার উদ্দেশ্যে মোস্তফা এল.এম.জি. দিয়ে গুলিবর্ষণ করতে থাকেন। তার নিখুত গুলিবর্ষণে পাকিস্তানি সৈন্যদের প্রায় ২০-২৫ জন হতাহত হয় এবং তাদের অগ্রগতি মন্থর হয়ে পড়ে। পাকিস্তানিরা মরিয়া হয়ে মোস্তফা কামালের অবস্থানের উপর মেশিনগান এবং মর্টারের গোলাবর্ষণ করতে থাকে। এক পর্যায়ে মোস্তফা কামালের এল.এম.জি-র গুলি নিঃশেষ হয়ে যায় এবং তিনি মারাত্বক জখম হন। তখন পাকিস্তানি সৈনিকরা ট্রেঞ্চে এসে তাঁকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে।
দরুইন গ্রামের জনগণ মোস্তফা কামালকে তাঁর শাহাদাতের স্থানের পাশেই সমাহিত করেন।
মোস্তফা কামাল ভোলা জেলায় দৌলতখান উপজেলার পশ্চিম হাজীপাড়া গ্রামে ১৯৪৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাড়ি থেকে পালিয়ে তিনি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগ দেন। ১৯৭০ সালে তিনি বিয়ে করেন ১৬ বছরের কিশোরী পেয়ারা বেগমকে। তিনি যখন মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন তখন পেয়ারা বেগম ছিলেন অন্তঃস্বত্ত্বা। মোহাম্মদ মোস্তফা স্ত্রীকে বলেছিলেন তার অনুপস্থিতিতে যদি ছেলে হয় নাম 'বাচ্চু' আর মেয়ে হলে নাম 'টুনি' রাখতে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর কয়েকদিন পূর্বে সিপাহি মোস্তফা কামাল অবৈতনিক ল্যান্স নায়েক হিসেবে পদোন্নতি পান। ভালো বক্সার হিসেবে রেজিমেন্টে তার সুনাম ছিলো।
মুক্তিযুদ্ধে সাহসিকতা ও আত্মত্যাগের স্বীকৃতি স্বরূপ বাংলাদেশ সরকার তাঁকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ খেতাবে ভূষিত করে।
গানবোট বাঁচাতে গিয়ে শহীদ হন রুহুল আমিন
মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারত সরকার নবগঠিত বাংলাদেশ নৌ বাহিনীকে দুটি টাগবোট (পদ্মা ও পলাশ) উপহার দিয়েছিলো। টাগবোট দুটিকে গানবোটে রূপান্তরিত করার পর মোহাম্মদ রুহুল আমিন পলাশ গানবোটের ইঞ্জিনরুম আর্টিফিশার হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন।
মংলা বন্দরে পাকিস্তানী নৌ ঘাটি পি. এন. এস. তিতুমীর দখলের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ নৌ বাহিনীর দুটী গানবোটে করে মোহাম্মদ রুহুল আমিন এবং তার সহযোদ্ধারা তিনি ও তাঁর সহযোদ্ধারা ৬ ডিসেম্বর ভারত থেকে যাত্রা শুরু করেছিলেন বাংলাদেশ অভিমুখে।
মংলাতে তাঁরা বিনা বাধাতে প্রবেশ করেছিলেন ৯ ডিসেম্বর। পরদিন ১০ ডিসেম্বর সকাল নয়টায় মংলা থেকে শুরু হয় চূড়ান্ত অভিযান। ১২টার দিকে গানবোটগুলো শিপইয়ার্ডের কাছে পৌঁছালে আকাশে তিনটি জঙ্গি বিমান দেখা যায়।
শত্রুবিমান মনে করে সেগুলোর ওপর পদ্মা ও পলাশ থেকে গুলিবর্ষণের অনুমতি চাওয়া হয়। মুক্তিযোদ্ধারা দ্রুত প্রস্তুত হন। কিন্তু তাদের বহরে থাকা ভারতীয় গানবোট পানভেল থেকে জানানো হয় ওগুলো ভারতীয় বিমান।
কিন্তু অপ্রত্যাশিতভাবে বিমানগুলো হঠাত্ বোমা বর্ষণ করে শুরু করে পদ্মা ও পলাশের ওপর। বোমার আঘাতে মুক্তিবাহিনীর গানবোটে আগুন ধরে যায়। পলাশের কমান্ডার সবাইকে গানবোট ত্যাগ করার নির্দেশ দিলেও রুহুল আমিনসহ অনেকে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত গানবোটেই ছিলেন। হঠাত বোমা লেগে পলাশের ইঞ্জিনরুম ধ্বংস হয়ে যায়। শেষ মুহূর্তে এক সহযোদ্ধা রুহুল আমিনকে নিয়ে পানিতে ঝাপ দেন।
আহত অবস্থায় রুহুল আমিন আপ্রাণ চেষ্টায় সাঁতার কেটে নদীর তীরে পৌঁছান। তবে সেখানে অপেক্ষা করছিল আরেক বিপদ। তীরে আগে থেকেই অবস্থান নিয়ে ছিল কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও অনেক রাজাকার। রাজাকাররা তাঁকে আটকের পর বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। নদীতীরে পড়ে থাকে তাঁর ক্ষতবিক্ষত মরদেহ।
পরে স্থানীয় বাসিন্দারা তাঁর মরদেহ উদ্ধার করে নদীতীরের এক স্থানে সমাহিত করেন। তাঁর সমাধি চিহ্নিত ও সংরক্ষিত।
বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিনের জন্ম ১৯৩৫ সালের জুন মাসের কোনো এক বর্ষণমুখর রাতে নোয়াখালীর বাঘচাপড়া গ্রামে। পিতা মোহাম্মদ আজহার পাটোয়ারি ছিলেন মোটামুটি স্বচ্ছল গৃহস্থ এবং মাতা জোলেখা খাতুন ছিলেন গৃহিণী। হাইস্কুল পাশ করে ১৯৫৩ সালে তিনি নৌ বাহিনীতে যোগ দেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে কয়েক দিন পর মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তিনি মুক্তিবাহিনীর নৌদলে অন্তর্ভুক্ত হন।