বাসে উঠে যাত্রীদের প্রথম প্রশ্ন, বাসটি সিএনজি নাকি তেলে চলে ? কিন্তু উত্তর একটাই ডিজেলে। সকল বাসই যেন রাতারাতি ডিজেল চালিত হয়েছে বলে মন্তব্য করছেন যাত্রীরা। মিরপুরে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কামাল হাসান বলেন, এখন সব বাসই নিজেদের ডিজেল চালিত দাবি করে বাড়তি ভাড়া নিচ্ছে। যেমন খুশি তেমন ভারা হাঁকাচ্ছে।
সিএনজির দাম বৃদ্ধিতেও বাস ভাড়া বেড়েছিল
২০১৫ সালে সিএনজির মূল্য যখন বাড়ল, তখন বাসমালিকরা দাবি করেছে যে তাদের মাত্র ২ শতাংশ বাস তেলে চলে। এই সুবাদে গণপরিবহনের ভাড়া বৃদ্ধি করা হয়। তখন লেগুনার ভাড়া দ্বিগুণ করা হয়েছিল। গ্যাসে মহানগরের বাসগুলো চলে বিধায় ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরে বাস ভাড়ানো হয়। কিন্তু সম্প্রতি যখন ডিজেলে দাম বৃদ্ধি পায় তখন সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্ল্যাহ দাবি করে যে তাদের মাত্র ২ শতাংশ গাড়ি সিএনজিতে চলে।
চার্ট ছাড়াই ভাড়া আদায়
গত দুদিন ডিজেলচালিত গণপরিবহনের পাশাপাশি সিএনজিচালিত গণপরিবহনেও যাত্রীদের কাছ থেকে বাড়তি ভাড়া আদায় করতে দেখা গেছে। এমনকি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নির্ধারিত ভাড়ার চেয়েও অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়ার অভিযোগ যাত্রীদের।মিরপুর রুটের বাস হেল্পার মামুন জানান, যেমন ভাবে ভাড়া কাটতে আমাদের বলে হয়েছে তেমন ভাবেই আমরা ভাড়া কাটি। কিন্তু যাত্রীরা বুঝতে চায়না যে ডিজেলের দাম বাড়ছে।
ডিজেল ও সিএনজির পার্থক্য চান যাত্রীরা
গুলিস্থানে অবস্থানরত অনেক যাত্রীরা বলেন, বাস ডিজেলচালিত না সিএনজিচালিত সেটি বাইরে থেকে দেখে প্রমাণ সম্ভব হয় না। ফলে সরকারের উচিত এটি নিশ্চিত করে বাসে মার্ক করে দেয়া বা স্পষ্ট উল্লেখ করে দেয়া। অন্যদিকে বর্ধিত ভাড়ার কোন চার্টও এখনো বাসে বা টার্মিনালে দেয়া হয়নি, এটিও যাত্রীদের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি করেছে। এ সময় সঠিক মনিটরিং খুব দরকার।
ডিজেলচালিত গণপরিবহনে ভাড়া বাড়ানোর ঘোষণায় সিটি পরিবহনের মতো দূরপাল্লায় আন্তঃজেলা বাস সার্ভিসগুলোতেও মানা হচ্ছে না নির্ধারিত নিয়ম-নীতি। যাচ্ছেতাই ভাড়া আদায়ের ধুম পড়েছে। কোন রুটে কোন পরিবহনে কতো টাকা বাড়তি আদায় করবে এর কোনো সুস্পষ্ট নির্দেশনা নেই। নজরদারির অভাবে পরিবহনগুলো সুযোগ বুঝে যেমন খুশি তেমন ভাড়া আদায় শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগী যাত্রীরা।
হিসেব ছাড়াই চলছে ভাড়া আদায়
মঙ্গলবার (৯ নভেম্বর) কোনো ধরনের হিসেব ছাড়াই গড়ে ১৫০-২০০ টাকা পর্যন্ত বাড়তি ভাড়া আদায় করতে দেখা গেছে। রাজধানীর অন্যতম বাসস্ট্যান্ড গাবতলী-কল্যাণপুর এলাকার কাউন্টার, গুলিস্থান ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।
বাড়তি ভাড়া আদায় নিয়ে বাস কাউন্টারগুলোতে টিকিট বিক্রেতাদের সঙ্গে যাত্রীর বাগবিতণ্ডার ঘটনাও ঘটছে। এরপরেও বাধ্য হয়ে বাড়তি ভাড়াতেই গন্তব্যে রওনা হচ্ছেন সবাই। নির্ধারিত বাড়তি ভাড়ার হারের নিয়ম না মানার বিষয়ে সুস্পষ্ট বক্তব্য দিতে পারছেন না কাউন্টারের দায়িত্বরতরা। তাদের বক্তব্য, মালিকের নির্দেশ মতো বাড়তি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে, এর বেশি তারা কিছু জানে না।
কল্যাণপুরে হানিফ বাস কাউন্টারে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত টিকিটের দাম রাখা হচ্ছে ৬০০ টাকা। আগে এ রুটে ৪৮০ টাকা ভাড়া থাকলেও এক লাফে টিকিটপ্রতি ১২০ টাকা বাড়তি আদায় করা হচ্ছে।
বাড়তি ভাড়া আদায় নিয়ে কাউন্টারে কর্মরত জসীম দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, ভাড়া বাড়ানোর ঘোষণার পর মালিকপক্ষ যেমন নির্দেশনা দিয়েছে সে অনুযায়ী ভাড়া রাখা হচ্ছে। এর বেশি আমি কিছু বলতে পারবো না।
চট্টগ্রামগামী সানজিদা নামে এক যাত্রী দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো নিয়ে যে ধর্মঘট করা হয়েছিলো সেটা আসলে ভাড়া বাড়ানোর ধান্দা ছিলো। এখন ভাড়া বাড়ানোর ঘোষণা পেয়ে যেমন খুশি তেমন ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। সুনির্দিষ্ট কোনো নিয়ম নেই, এটা দেখারও যেন কেউ নেই। আমরা সাধারণ মানুষ কই যাবো। এত টাকা কই পাবো?
মনিটরিংয়ের প্রস্তাব
গণপরিবহনে ভাড়া সমন্বয়ের পর এ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে বিআরটিএ চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার গণমাধ্যমকে বলেন, সিএনজিচালিত গণপরিবহনে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় হচ্ছে কি না, এ বিষয়টি বিআরটিএ মনিটরিং করবে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পরিপ্রেক্ষিতে গণপরিবহনে ভাড়া বৃদ্ধির ঘোষণার পর বস্তুত সড়কে সব গাড়িই যাত্রীদের কাছ থেকে বর্ধিত ভাড়া আদায় করছে। এমনকি সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়েও অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। এ নিয়ে গত দুদিন বিআরটিএ তদারকি করছে বলে দাবি করলেও প্রয়োজনের তুলনায় সে মনিটরিং অনেক কম। সাধারণ যাত্রীদের অভিযোগ, ভাড়া সমন্বয়ের ঘোষণার পরও বাসগুলো নিজের মনের মত ভাড়া আদায় করছে বলে জানায় সিটি কলেজের এক শিক্ষার্থী রবিউল।
এ বিষয়ে বিআরটিএ পরিচালক (এনফোর্সমেন্ট) সারওয়ার আলম গণমাধ্যমকে বলেন, আমাদের মনিটরিং টিম গতকাল (৮ নভেম্বর) থেকে ঢাকা ও চট্টগ্রামে কাজ করেছে। এদিন বিআরটিএ ১৩টি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে ২২০টি গাড়ি মনিটরিং করেছে। এর মধ্যে ৫৯টি সিএনজিচালিত পরিবহন ছিল। ডিজেলচালিত ৩৮টি গাড়ি ও ২৯টি সিএনজিচালিত গাড়িকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের দায়ে জরিমানা করা হয়েছে। ওইদিন মোট আদায় করা জরিমানার পরিমাণ এক লাখ ৫৪ হাজার ১০০ টাকা। এর বাইরে জেলা ও পুলিশ প্রশাসনও তদারকি করছে।
ডিজেলেই ভাড়া বৃদ্ধি
গত ৩ নভেম্বর রাতে ডিজেলের দাম ৬৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮০ টাকা করে সরকার, যা ৪ নভেম্বর থেকে কার্যকর হয়। তখন পরিবহন মালিকরা বলেন, এত দামে ডিজেল কিনে বিদ্যমান ভাড়ায় গাড়ি চালানো সম্ভব নয়। পরে মালিকরা শুক্রবার সকাল থেকে বাসসহ পণ্যবাহী যান চালানো বন্ধ করে দেন। যদিও মালিক সংগঠনগুলোর দাবি, ধর্মঘটের বিষয়ে তাদের কোনো নির্দেশনা ছিল না। অঘোষিত ওই ধর্মঘটের ফলে সারাদেশে চরম ভোগান্তিতে পড়েন সাধারণ মানুষ।
সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির পক্ষ থেকে বিআরটিএর কাছে ভাড়া বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয় বৃহস্পতিবার বিকেলে। কিন্তু বৃহস্পতি, শুক্র ও শনিবার কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে বিআরটিএ মালিক সমিতিকে বৈঠকের জন্য ডাকে রোববার। রোববার বিকেলে বৈঠক শেষে মালিকপক্ষের দাবি মেনে বাসের ভাড়া বাড়ানোর ঘোষণা দেয় বিআরটিএ। এ বিষয়ে ওইদিন সন্ধ্যায় সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ থেকে এ প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, দূরপাল্লার বাস ভাড়া কিলোমিটারে ১ টাকা ৪২ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১ টাকা ৮০ পয়সা করা হয়েছে। ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে বাস ভাড়া কিলোমিটারে ১ টাকা ৭০ পয়সা থেকে ২ টাকা ১৫ পয়সা করা হয়েছে। মিনিবাসের ক্ষেত্রে তা ১ টাকা ৬০ পয়সা থেকে ২ টাকা ৫ পয়সা করা হয়েছে। সংস্থাটি বলছে, এ বর্ধিত ভাড়া সিএনজিচালিত গণপরিবহনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। যদিও মাঠ পর্যায়ে তা কার্যকর হচ্ছে না। গত দুদিন ডিজেলচালিত গণপরিবহনের পাশাপাশি সিএনজিচালিত গণপরিবহনেও যাত্রীদের কাছ থেকে বাড়তি ভাড়া আদায় করতে দেখা গেছে। এমনকি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নির্ধারিত ভাড়ার চেয়েও অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়ার অভিযোগ যাত্রীদের।