শেখ মুজিব: যাঁর মোটা ফ্রেমের চশমার আলোয় পথ দেখেছিল জাতি

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

মার্চ ১৭, ২০২৩, ১২:০৫ এএম

শেখ মুজিব: যাঁর মোটা ফ্রেমের চশমার আলোয় পথ দেখেছিল জাতি

খোকা। পরিবার ও এলাকাবাসীর দেওয়া ভালবাসার এক নাম। যাকে এখন আমরা জানি শেখ মুজিবুর রহমান নামে। জাতির স্থপতি হিসেবে। বাঙালি জাতির জনক হিসেবে। দেশবাসী যাকে ভালবেসে বঙ্গবন্ধু উপাধি দিয়েছে। সেই যে একশো বছরেরও আগের মার্চের সতেরো তারিখ, গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার নিভৃত এক পল্লীতে বাবা শেখ লুৎফর রহমান ও মা সায়রা খাতুনের কোল আলো করে যাঁর জন্ম। 

প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে পড়াকালেই ছোট্ট খোকার ভেতরে মানবিকতার এক অপূর্ব সম্মিলন লক্ষ্য করা যায়। কোমল মনের এই খোকা শীতে জবুথবু দরিদ্র মানুষকে নিজের সোয়েটার পর্যন্ত খুলে দিয়ে দিতেন। দুর্ভিক্ষে সহপাঠীদের নিয়ে খুলতেন লঙ্গরখানা। আবার এই খোকাকেই দেখা গেছে ইস্পাত কঠিন মানুষ হিসেবে। অন্যায় অবিচার দেখলেই তিনি প্রতিবাদী হয়ে উঠতেন। বাবা-মা খোকার এই চারিত্রিক বৈশিষ্টে মুগ্ধ হয়ে ভাবতেন, একদিন এই খোকাই বড় হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াবে। অন্যায়-জুলুমের প্রতিবাদ করবে।

বাবা-মায়ের সেই ধারনা সত্যি হয়েছির। খোকা বড় হয়ে বঙ্গবন্ধু হয়েছিলেন।  

অথচ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জীবন কুসুম কোমল ছিল না। চ্যালেঞ্জে ভরা ছিল তার জীবন। মাত্র ১৪ বছর বয়সেই তাঁর বেরিবেরি রোগ হয়। চোখের আলো নিভে যাবার দশা হয়। সেই রোগ থেকে মনের জোরে কিশোর মুজিব সুস্থ হন; কিন্তু চোখের দৃষ্টি বিভ্রাট হল অপারেশন। ১৬ বছর বয়স থেকে কিশোর মুজিবুরের চোখে উঠল চশমা। সেই যে মোটা ফ্রেমের চশমার কাঁচের ভেতর দিয়ে চোখের আলো ফিরিয়ে আনা, সেই চশমায় ফিরেছিল অন্ধকারে নিমজ্জিত গোটা এক জাতীর পথ চলার আলোও। 

আজকে আমরা শোনাবো কীভাবে কিশোর মুজিব মোটা ফ্রেমের ওই চশমায় নিজের চোখের আলো এনেই ক্ষ্যান্ত হননি, অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়া একটি জাতিকেই আলো এনে দিয়েছিলেন সেই গল্প।

মুজিবের জীবন সংগ্রামী এক মহাকাব্য। ১৯৩৮ সালে ১৮ বছর বয়সে দাদার আদেশে অনাথ অসহায় তিন বছরের রেনুকে বিয়ে করে নিজের ঘরে নিয়ে আসেন তিনি। পরে পূর্ণ বয়েসে এই দম্পতির দুই কন্যা ও তিন ছেলে হয়। তারা হলেন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা এবং শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শেখ রাসেল।

একদিকে সংসার, অন্যদিকে রাজনীতি। সমানে চালিয়েছেন তিনি। তার মধ্যে ছাত্রাবস্থাতেই নেতৃত্বের গুণ প্রবলভাবে চোখে পড়ে। তাঁর নিজের স্কুল পরিদর্শনে এসে অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীও সেটি টের পান । মুজিব তখন স্কুলের ছাদ দিয়ে পানি পড়ার কারণে ছাত্রদের অসুবিধা এবং ছাত্রাবাসের দাবি স্কুল ছাত্রদের পক্ষ থেকে তুলে ধরেন। তার ভাষা ছিল পরিপক্ক। যা শুনে প্রবীণ এই দুই নেতা তার ভূয়সী প্রশংসা করেন।

মুজিব এভাবে রাজনীতিতে সক্রিয় হন। একদিকে পড়ালেখা অন্যদিকে রাজনীতি সমানে চালাতে থাকেন। এসএসসি পাস করে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসে ভর্তি হন এবং বেকার হোস্টেলে থাকতে শুরু করেন। সেখানে থাকা অবস্থায় পাকিস্তান আন্দোলনে যুক্ত হয়ে পড়েন।

যোগ দেন বেঙ্গল মুসলিম লীগে। তখন তিনি বাঙ্গালীর নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর স্নেহাশিষ লাভ করেন। নেতৃত্বগুণে মুসলিম লীগের কাউন্সিলরও নির্বাচিত হন। ১৯৪৭ এ দেশভাগ এর বছর ইসলামিয়া কলেজ থেকে বিএ করলে তিনি পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে আসেন।

পড়ালেখা এবং রাজনীতি দুটোই তখন তুমুলভাবে চালাতে থাকেন মুজিব। ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন এবং ৪ জানুয়ারি মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন। ভাষা আন্দোলন নিয়ে উত্তাল তখন ঢাকা। শাসকদের চাপিয়ে দেওয়া ‘উর্দুই হবে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ঘোষণার তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ জানান মুজিব। ১৯৪৮ সালে ভাষার প্রশ্নে তাঁর নেতৃত্বেই প্রথম প্রতিবাদ এবং ছাত্র ধর্মঘট শুরু হয় যা চূড়ান্ত রূপ নেয় ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে।

বঙ্গবন্ধু স্কুলের ছাত্রাবস্থায় ১৯৩৮ সালে সর্বপ্রথম কারাগারে যান।  সংগ্রামমুখর মুজিবের ৫৪ বছরের জীবনের এক-চতুর্থাংশই এভাবে কেটেছে কারাগারে। কখনো তিনি আপস করেননি। মুচলেকা দেননি। তার ওই সংগ্রাম ছিল দেশ ও দেশের মানুষের জন্য। এভাবে তিনি এ দেশের কোটি জনতার প্রিয় নেতায় পরিণত হন। সংগ্রামমুখর এমনই এক সময়ে ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে শেখ মুজিবুর রহমানকে গণসম্বর্ধনা দেওয়া হয়৷ সেখানেই লাখো মানুষের এই জমায়েতে শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’উপাধি দেওয়া হয়৷

সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ইতিহাস সৃষ্টিকারী এক ভাষণ দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেই ভাষণ ছিল মূলত স্বাধীনতার ডাকই। রেসকোর্সের জনসমুদ্রে সেদিন তিনি ঘোষণা দেন: এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।

বঙ্গবন্ধুর সেই ডাকে কেঁপে ওঠে সারা বাংলা। মুজিবের নেতৃত্বে বাঙ্গালী জাতি হাতে তুলে নেয় অস্ত্র। পাকিস্তানি শাসক শেখ মুজিবকে করে গ্রেপ্তার। কিন্তু গোটা মুক্তিযুদ্ধ শেখ মুজিবের নির্দেশেই পরিচালিত হয়। এবং ১৬ই ডিসেম্বর আসে কাঙ্খিত স্বাধীনতা।

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু ফিরে আসেন তাঁর মাতৃভূমিতে, তাঁর স্বপ্নের স্বাধীন দেশে। দেশে ফিরেই যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে ঝাঁপিয়ে পড়েন বঙ্গবন্ধু। যার একান্ত প্রচেষ্টায় দেশে স্থিতিশীলতা আসতে শুরু করে। সমস্ত দেশ যখন ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠে ঘুরে দাঁড়ায়, তখনই আসে ষড়যন্ত্রকারী মীরজাফরদের আঘাত।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মধ্যরাতে একদল বিপথগামী সেনা কর্মকর্তা হত্যা করে শেখ মুজিব এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের। কেবল তাঁর দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা সেই সময় দেশের বাইরে থাকায় বেঁচে যান। সদ্য স্বাধীন জাতির জীবনে এক অপূরণীয় ক্ষতি নিয়ে আসে এই জঘন্য হত্যাকাণ্ড, তৈরি করে রাজনৈতিক শূণ্যতা, ব্যাহত হয় গণতান্ত্রিক উন্নয়নের ধারা।

Link copied!