শেখ হাসিনাকে ব্যবসায়ীদের সমর্থন: কী বলছে বিরোধীরা

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

জুলাই ১৬, ২০২৩, ০৫:৫৪ পিএম

শেখ হাসিনাকে ব্যবসায়ীদের সমর্থন: কী বলছে বিরোধীরা

বাংলাদেশে এফবিসিসিআই থেকে শুরু করে প্রায় সব ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারাই ‍‍`আগামী নির্বাচনে বর্তমান সরকার ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আবারো ক্ষমতায় দেখতে চান‍‍` বলে বক্তব্য দেxয়ার পর বিরোধী দলগুলো বলছে এসব ব্যবসায়ীরা দলীয় এবং তাঁরা নিজেরা সুযোগ সুবিধা পাওয়ার জন্যই এ ধরণের বক্তব্য দিয়েছেন।

বিরোধী নেতারা বলছেন, তাঁরা মনে করেন শীর্ষ ব্যবসায়ীদের রাজনীতি ও নির্বাচন নিয়ে দেয়া বক্তব্যের কোনো রাজনৈতিক গুরুত্ব নেই।

কারণ এসব সংগঠনগুলোতে নির্বাচনের প্রক্রিয়া বন্ধ করে দিয়ে সরকার সমর্থকদের নিয়ে কমিটি গঠনের রেওয়াজ চালু করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ তাঁরা বলছেন, শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠন এফবিসিসিআইতেই গত কয়েকবছর ধরে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন হচ্ছে না। বরং সরকার সমর্থকদের দিয়ে সেখানে সিলেকশনের ভিত্তিতে কমিটি হচ্ছে।

এদিকে, এফবিসিসিআইয়ের একজন সাবেক সভাপতি বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, তাঁরা দেশের উন্নয়নের ধারাবাহিকতার কথা চিন্তা করেই বর্তমান সরকারকে সমর্থন দিচ্ছেন।

তবে জাতীয় নির্বাচনে যদি অন্য কোন দলের সরকার আসে, তাহলে তাদের সাথেও এফবিসিসিআই কাজ করবে।

শনিবার ঢাকায় এফবিসিসিআই এর উদ্যোগে ঢাকায় ‘স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে ব্যবসায়ীদের করণীয়’ শীর্ষক সম্মেলনে দেশের শীর্ষ স্থানীয় ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতা এবং শিল্পোদ্যোক্তারা প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে বক্তব্য দেন।

ব্যবসায়ীরা বলছেন অর্থনীতির স্বার্থে তারা শেখ হাসিনাকে আবারো ক্ষমতায় দেখতে চান।

ব্যবসায়ী সম্মেলনে যা হলো

শনিবারের ওই সম্মেলনে ব্যবসায়ীদের অনেকেই ‘সংবিধান অনুযায়ী আগামী নির্বাচনে’র পক্ষে মত দেন এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। কেউ কেউ ‘শেখ হাসিনার সরকার-বারবার দরকার’ এমন শ্লোগানও দেন।

বলে রাখা ভালো যে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কিভাবে হবে তা নিয়ে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তীব্র মতপার্থক্য রয়েছে।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনা সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে বললেও বিএনপি সহ বিরোধী দলগুলো শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগ ও নির্বাচনের জন্য নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে এক দফা আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে।

এমন প্রেক্ষাপটে ব্যবসায়ীরা যখন নির্বাচন নিয়ে সরকারের প্রতি সমর্থন জানালেন তখনো ঢাকায় এসে আগামী নির্বাচন বিষয়ে আলোচনা করছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি প্রতিনিধি দল। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের একটি উচ্চ পর্যায়ের দল ঢাকা সফর করে গেছে।

তবে তারও আগে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসা নীতি ঘোষণার পর থেকেই মূলত সরকার আগামী নির্বাচন নিয়ে এক ধরণের চাপে পড়েছে বলে অনেকে মনে করছিলেন।

এই নীতির আওতায় যে কোন বাংলাদেশি ব্যক্তি যদি সেদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের প্রক্রিয়া ব্যাহত করার জন্য দায়ী হন বা এরকম চেষ্টা করেছেন বলে প্রতীয়মান হয় - তাহলে যুক্তরাষ্ট্র তাকে ভিসা দেয়ার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারবে বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ্যান্টনি ব্লিংকেন।

মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের এক বিবৃতি অনুযায়ী, নতুন এ নীতির আওতায় পড়বেন বর্তমান এবং সাবেক বাংলাদেশি কর্মকর্তা, সরকার-সমর্থক ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্যবৃন্দ, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিচারবিভাগ এবং নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর সদস্যরা।

কী বলছেন শীর্ষ ব্যবসায়ীরা

বিরোধীরা বলছেন সরকারকে সমর্থন করা ব্যবসায়ীরা সরকার দলীয় ও সুবিধাপ্রাপ্ত।

শনিবার প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে মেট্রোপলিটন চেম্বারের সভাপতি সাইফুল ইসলাম সিঙ্গাপুরের পিপলস অ্যাকশন পার্টির ৫৮ বছরের শাসনের কথা উল্লেখ করেছেন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বের বিকল্প নেই উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, “আপনার নেতৃত্বের বিকল্প নেই। দেশের নেতৃত্বের ক্ষেত্রে আমরা ঝুঁকি নিতে পারবো না”।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) এবং এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার বলেছেন তিনি শেখ হাসিনাকেই আবারো প্রধানমন্ত্রী দেখতে চান। “তত্ত্বাবধায়ক, নিরপেক্ষ এসব বুঝি না। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে,” বলছিলেন মজুমদার।

মজুমদার বক্তব্যের শুরুতে ‘জয় শেখ হাসিনা’ এবং শেষে ‘শেখ হাসিনার সরকার-বারবার দরকার’ শ্লোগান দেন।

বসুন্ধরা শিল্পগোষ্ঠীর চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান তত্ত্বাবধায়ক সরকার আনার ষড়যন্ত্র হচ্ছে দাবি করে ব্যবসায়ীরা আমৃত্যু শেখ হাসিনার সাথে থাকবে বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, “কারও দ্বিমত নেই আগামী নির্বাচন সংবিধান অনুযায়ী হবে’।

এফবিসিসিআই সভাপতি মো: জসিম উদ্দিন প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন ‘দেশ যেভাবে এগিয়েছে এবং ব্যবসায়ীদের যে অবস্থান তৈরি হয়েছে তা ধরে রাখার জন্য আপনাকে প্রয়োজন’।

প্রধানমন্ত্রীকে নিরঙ্কুশ সমর্থন জানিয়ে আরো যারা বক্তব্য দিয়েছেন তাদের মধ্যে ছিলেন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান, বিটিএমএ সভাপতি মোহাম্মদ আলী, ঢাকা চেম্বারের সভাপতি সামীর সাত্তার, এইচএসবিসি বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাহবুব উর রহমান।

সাধারণত ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো নির্বাচনে সরাসরি পক্ষ নেয় না। কিন্তু এবার কেন নির্বাচনের অনেক আগেই একযোগে তারা সরকারি দলকে সমর্থন দিচ্ছেন – এমন প্রশ্ন উঠেছে।

জবাবে এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, দেশের স্বার্থেই তারা ব্যবসায়ীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারকে সমর্থন দিয়েছেন।

তিনি বলেন, "আমরা মনে করি দেশের স্বার্থে চলমান উন্নয়ন এগিয়ে নিতে বর্তমান সরকারের ধারাবাহিকতা থাকা উচিত। বিদেশীরা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। শেখ হাসিনার সরকার সেটির নিশ্চয়তা দিয়েছে।"

"এখন নির্বাচনে জনগণ যদি শেখ হাসিনাকে ভোট না দেয় তাহলে যাকে ভোট দিবে এবং যারা সরকারে আসবে, আমরা তার সাথে কাজ করবো কারণ আমরা ব্যবসায়ী। তবে আমরা মনে করি শেখ হাসিনার ভিশন আছে এবং চলমান কাজগুলো এগিয়ে নিতে তার বিকল্প নেই।”

বিরোধী দল বিএনপি ইতোমধ্যেই সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছে। তাঁরা বলেছে, শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে তারা নির্বাচনে যাবে না এবং এ ধরণের নির্বাচন তারা হতেও দেবেন না।

বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বিবিসিকে বলছেন যেসব ব্যবসায়ীরা আওয়ামী লীগকে জেতানোর ঘোষণা দিয়েছে, তারা দলীয় ব্যবসায়ী। এবং তাদের বক্তব্যে সাধারণ ব্যবসায়ীদের মতামতের প্রতিফলন ঘটেনা বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।

“সমর্থন আদায়ের একটি হর্স ট্রেডিং শুরু হয়েছে। এসব ব্যবসায়ী সংগঠন সরকারি দলের নিয়ন্ত্রণে। কোথাও নির্বাচিত কেউ নেই। এরা দলীয় বলে এদের রাজনৈতিক গুরুত্বও নেই,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা নাগরিক ঐক্যের আহবায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছেন, এসব ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোতে গত বেশ কয়েকবছর ধরে কোনো নির্বাচনই হয়না।

“ট্রেড বডিগুলোতে নির্বাচনের সংস্কৃতিই ধ্বংস করে দিয়েছে সরকার। সব জায়গায় নিজেদের দলীয় লোকজন। তারা কাকে সমর্থন করলো আর কার বিরোধিতা করলো, তাতে কার কি আসে যায়! এসব কথার গুরুত্ব নেই”।

অন্যদিকে, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ বলছেন, যারা সরকারকে এই সমর্থন দিচ্ছে তাদের অনেকে টিভি এবং ব্যাংকের লাইসেন্সসহ নানা সুবিধা পেয়েছে।

“অনেকের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগ আছে, কিন্তু দুদক তাদের ডাকে না। ফলে তাদের তো সরকারকেই সমর্থন করতে হবে। আর দলীয়করণ সরকার এমন পর্যায়ে নিয়েছে যে এসব সংগঠন এখন সরকারি দলের নেতাদেরই হাতে। আর সরকার তো রাজনৈতিক কাজও এখন দলের রাজনৈতিক নেতাদের বদলে ব্যবসায়ীদের দিয়ে করাচ্ছে,” বলে মন্তব্য করেন আন্দালিব রহমান পার্থ।

উল্লেখ, সম্প্রতি মার্কিন প্রতিনিধি দলের ঢাকা সফরের সময় মন্ত্রীরা ছাড়াও বৈঠক করেছেন প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি খাত বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের নেতৃত্বাধীন একটি প্রতিনিধি দলের সাথে।

যদিও ব্যবসায়ী নেতা এ কে আজাদ বলছেন, ব্যক্তিগত সুবিধার কোনো বিষয় নেই। বরং জাতীয় ও দেশের স্বার্থেই তারা শেখ হাসিনার সরকারকে আবার চাইছেন। 

সূত্র: বিবিসি বাংলা

Link copied!