হেলমেটের সামান্য টাকা বাঁচাতে যায় মূল্যবান জীবন

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

ডিসেম্বর ১০, ২০২১, ০৮:৩০ পিএম

হেলমেটের সামান্য টাকা বাঁচাতে যায় মূল্যবান জীবন

প্রায় প্রতিদিন দেশের নানা প্রান্ত থেকে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় বাইকারের মৃত্যুর খবর আসে। এসব দুর্ঘটনায় হতাহতের প্রধান কারণ নিম্নমানের হেলমেটের ব্যবহার। হেলমেট নিম্নমানের হওয়ায় দুর্ঘটনায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চালক ও আরোহীর জীবন রক্ষা হয় না। সামান্য টাকা বাঁচাতে গিয়ে মানহীন হেলমেট কিনে নিজের মৃত্যু ডেকে আনেন বাইকাররা।  

জরিমানা এড়াতে দায়সারা হেলমেট

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়াকড়িতে রাজধানীতে চালক ও আরোহীদের হেলমেট ব্যবহার বেড়েছে এখন। রাইড শেয়ারিং কোম্পানিগুলো তাদের রাইডার ও গ্রাহকদের জন্য হেলমেট ব্যবহার বাধ্যতামূলক করেছে। কিন্তু রাইডাররা যাত্রীদের যেসব হেলমেট পরতে দেন সেসবের বেশিরভাগই নিম্নমানের।

জানা যাচ্ছে, রাজধানীসহ সারা দেশের অধিকাংশ মোটরসাইকেলের চালক ও আরোহীরা হেলমেট পরতে চান না। তবে ২০১৮ সালের সড়ক পরিবহন আইনের ‘কারাদণ্ড’ ও ‘জরিমানা’ এড়াতে গত দুই-তিন বছর ধরে পাল্টেছে এই চিত্র। চালক ও আরোহীদের অধিকাংশই এখন হেলমেট পরছেন। কিন্তু হেলমেট পরার হার বাড়লেও কমেনি দুর্ঘটনায় মৃত্যু ও স্থায়ী পঙ্গুত্বের হার। এর কারণ ওই নিম্নমানের হেলমেট।

যাত্রীরা ঝুঁকিতে বেশি

বাংলামোটর ওভারব্রিজের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা রাইডার রফিকুল ইসলাম দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে গতকাল বলেন, ‘তীব্র গরমে হাফ হেলমেটই বরং ভালো! আর বাইক চালাতে জানলে হেলমেট বেশি একটা গুরুত্ববহন করে না।’

রাইডারের কাছ থেকে নিম্নমানের হেলমেট পাওয়ার অভিযোগের কথা বলেছেন অনেক যাত্রীই। রামপুরার বাসিন্দা অমিয় দত্ত কাজ করেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। তিনি বললেন, ‘সময় বাঁচাতে প্রতিদিন রামপুরা থেকে মতিঝিল যাই রাইড শেয়ারিংয়ে। তবে যে হেলমেট রাইডারদের কাছ থেকে পাই, সেগুলো খুব নিম্নমানের। প্লাস্টিকের হেলমেট। যা দিয়ে ট্রাফিক পুলিশদের চোখ এড়ানো যায়, কিন্তু দুর্ঘটনা এড়ানো যাবে না।’

এ বিষয়ে কথা হয় বনশ্রীতে বাইক সরঞ্জামাদির বিক্রেতা রাতুল আহমেদের সাথে। তিনি দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, ‘আমার শো রুমে অনেক প্রকারের, অনেক ব্রান্ডের হেলমেট রয়েছে। তবে বেশি বিক্রি হয় কম দামী হেলমেটগুলো। যাদের ব্যাক্তিগত মোটরসাইকেল আছে তারা নিজের জন্য ভালো হেলমেট কিনলেও আরোহীর জন্য কেনেন কম দামীটা।’

সড়ক দুর্ঘটনায় বারংবার উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও। তারা বলেছে, ভালো মানের হেলমেট ব্যবহারে দুর্ঘটনায় মৃত্যুঝুঁকি ৪০ শতাংশ কমানো যায়। আর জখম থেকে সুরক্ষা পাওয়া যায় ৭০ শতাংশ।

মানদন্ড না থাকায় ট্রাফিক পুলিশ ব্যবস্থা নিচ্ছে না

বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী বললেন, ‘বেশিরভাগ রাইডার যেসব হেলমেট আরোহীকে ব্যবহার করতে দেন, সেগুলো ব্যবহার করা আর না করা সমান কথা। ট্রাফিক পুলিশ এ নিয়ে কোনো কথাও বলে না। তাদের উচিত, নিম্নমানের হেলমেট দেখলে তাদের আটকানো এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া।’

অভিযোগের ব্যাপারে ট্রাফিক পু্লিশের ডেপুটি কমিশনার এম ডি সাহেদ আল মাসুদ দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, ‘হেলমেটের মান নিয়ে আমরা কাজ করি না। কোনো মোটরসাইকেল আরোহী বা চালক হেলমেট পরেছেন কিনা, সেটা আমরা নিশ্চিত করি এবং প্রয়োজন অনুযায়ী আইনি পদক্ষেপ নেই। বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস এন্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) থেকে হেলমেটের মান ঠিক করে দেওয়া নেই। যদি মান ঠিক করে দেয় তাহলে পুলিশ তাদের আটকাবে এবং ব্যবস্থা নেবে। আইন করা থাকলে বা নির্দেশনা থাকলে আমরা সেমতে কাজ করবো।’

হেলমেটের মানদণ্ড নিয়ে কাজ করছে বিআরটিএ ও বিএসটিআই। প্রতিষ্ঠান দুটির কারও কাছেই হেলমেটের মানদণ্ড নির্ধারণে কার্যকর কোনো পদ্ধতি নাই। বিআরটিএ বলছে, তারা হেলমেট দেখে মানদণ্ড ঠিক করে। আর বিএসটিআই বলছে, তাদের কোনো ল্যাব নেই হেলমেটের মান পরীক্ষার।

সড়ক দূর্ঘটনার এক তৃতীয়াংশই মোটরসাইকেলের

গত ৯ ডিসেম্বর বিকেলে রাজধানীর একটি হোটেলে এক অনুষ্ঠানে আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদ বলেন, ‘দেশ যত উন্নত হচ্ছে, রাস্তায় বিভিন্ন ধরনের যানবাহনের সংখ্যাও তত বাড়ছে। সড়ক নিরাপত্তাও দিন দিন চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠছে। সড়ক দুর্ঘটনার শিকারের ৭০ শতাংশই পথচারী। মোটরসাইকেল ভিকটিমদের বেশিরভাগই তরুণ, যাদের বয়স ২০ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে।’  

তিনি বলেন, ‘গত ছয় মাসে দেশে ১ হাজার ৪৯৪টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটেছে ৪৭৮টি। গত ছয় মাসে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ৩৩৬ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এদের মধ্যে ২৩৯ জনের হেলমেট ছিল। আহত হয়েছেন ৩০৫ জন, এর মধ্যে ২২৪ জনের হেলমেট ছিল না। এটা হলো হেলমেট থাকা না থাকার একটা দিক। অন্যদিক হলো হেলমেটের কোয়ালিটি।’  

গবেষকদের মতে, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় বেশির ভাগই মাথায় আঘাত পেয়ে মারা যায়। নিরাপদ হেলমেট ব্যবহার করলে এই হতাহতের সংখ্যা ৪০ শতাংশ কমিয়ে আনা সম্ভব। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্বদ্যিালয়ের (বুয়েট) এক গবেষণা বলছে, মোটরসাইকেলে হেলমেটের ব্যবহার বাড়লেও নিশ্চিত হচ্ছে না নিরাপত্তা। দেশে ব্যবহৃত বেশির ভাগ হেলমেট দুর্ঘটনায় সুরক্ষা দেয় না।

Link copied!