তিনবারে প্রায় তিন শতাধিক নেতাকর্মী পেলেন আওয়ামী লীগের ক্ষমা

মাহাবুব আলম শ্রাবণ

অক্টোবর ২৩, ২০২৩, ০৯:০০ পিএম

তিনবারে প্রায় তিন শতাধিক নেতাকর্মী পেলেন আওয়ামী লীগের ক্ষমা

ছবি: দ্য রিপোর্ট ডট লাইভ

গত ১৫ বছরের শাসনামলে সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গ, বিদ্রোহী প্রার্থী, দলীয় কোন্দল সৃষ্টির মতো নানা কারণে দলের দায়িত্বশীল বেশ কয়েকজন নেতা, সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীকে দল থেকে বহিষ্কার করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।

দেখা যায়, বহিষ্কৃত হয়েছিলেন এমন অনেক নেতাদের ফিরিয়ে আনা হচ্ছে দলে এমনকি দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে বিভিন্ন পর্যায়ে নির্বাচনে অংশ নিয়ে বহিষ্কৃতরাও পেয়েছেন সাধারণ ক্ষমা।

আবার ক্ষমা পেলেন জাহাঙ্গীর

এবার দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমা পেলেন পরপর দুবার আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত গাজীপুরের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম।

শর্তসাপেক্ষে (ভবিষ্যতে দলের শৃঙ্খলা পরিপন্থি কাজ করলে তা ক্ষমার অযোগ্য বলে বিবেচনা করা হবে) প্রথমবার ক্ষমা পাওয়ার পর একই শর্তে দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমা পেলেন জাহাঙ্গীর আলম।

আওয়ামী লীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা জানান, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি ও অন্যান্য সমমনা দলের সরকারবিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক ভারসাম্য ঠিক রাখতেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে আওয়ামী লীগ।

আওয়ামী লীগ সূত্র বলছে, আসন্ন নির্বাচনে গাজীপুরের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থানে জাহাঙ্গীরের বিকল্প নেই, আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকটি সমাবেশেও মিলেছে তার প্রমাণ। উল্লেখ্য, ঢাকায় অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের এক শান্তি ও উন্নয়ন সমাবেশ ও কাওলায় সিভিল এভিয়েশন মাঠের সমাবেশে বিপুলসংখ্যক জনবলের উপস্থিতি নিশ্চিত করেন জাহাঙ্গীর যা রাজনৈতিক অঙ্গনে জন্ম দিয়েছে আলোচনার।

শনিবার (২১ অক্টোবর) দ্বিতীয়বার জাহাঙ্গীর আলমকে ক্ষমা করার চিঠি দেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

তবে, জাহাঙ্গীরের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁকে ক্ষমা করা হয়েছে বলে জানান, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম। তিনি বলেন, ভবিষ্যতে একই অপরাধের পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে সেই শর্তে জাহাঙ্গীরের  আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁকে ক্ষমা করা হয়েছে।

দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে বিভিন্ন পর্যায়ে নির্বাচনে অংশ নিয়ে যাঁরা বহিষ্কৃত হয়েছিলেন, তাঁদের অনেকেও ফিরিয়ে আনা হয়েছে দলে।

১৯২ নেতাকর্মীকে দলের পক্ষ থেকে ক্ষমার ঘোষণা

আওয়ামী লীগের যেসব নেতাকর্মী দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে গিয়ে নির্বাচন বা বিদ্রোহী প্রার্থীকে সহায়তা করেছিলেন তাদের বহিষ্কার বা শাস্তি নিয়ে স্বস্তির বার্তা দিয়েছিল দলটি।

গত ২১ অক্টোবর ২০১৯ (সোমবার) বিদ্রোহী নেতাদের কাছে পাঠানো হয় চিঠি। তাতে বলা হয়, ভবিষ্যতে সংগঠনের স্বার্থ পরিপন্থি কার্যক্রম ও সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গ না করার শর্তে তাদের ক্ষমা করা হয়েছে।

তবে, ১৯২ জন সংগঠনবিরোধী কর্মকাণ্ডের কথা স্বীকার করে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার কাছে ক্ষমা চেয়ে চিঠি দেন। তারা ভবিষ্যতে সংগঠনের গঠনতন্ত্র, নীতি ও আদর্শ পরিপন্থি কোনো কার্যক্রমে সম্পৃক্ত না হওয়ারও অঙ্গীকার করেন।

১৯২ জনের মধ্যে উপজেলা নির্বাচনে বিদ্রোহীদের মধ্যে ১২৬ জন চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হয়েছেন। এই চেয়ারম্যানরাসহ ওই নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার শঙ্কা ছিল বেশ জোরালো।

জানা যায়, দলের পক্ষ থেকে ক্ষমাপ্রাপ্ত নেতারা আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যায়ের সম্মেলন কার্যক্রমে অংশ নিতে পারবেন। এমনকি নেতা নির্বাচনেরও সুযোগ পাবেন।

আরও শতাধিক নেতাকর্মী পেলেন ক্ষমা

দ্বিতীয় ধাপে দলের শতাধিক নেতাকর্মীকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে আওয়ামী লীগ। ২০২২ সালের ১৭ ডিসেম্বর (শনিবার) প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনার সরকারি বাসভবনে দলের জাতীয় কমিটির বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, প্রায় শতাধিক আবেদন জাতীয় কমিটির কাছে উপস্থাপন করা হয়েছে।

জাতীয় কমিটি বরাবর সর্বসম্মতিক্রমে যারা আবেদন করেছিল তাদের দলের সভাপতি ক্ষমা করে দিয়েছেন।

অন্য যারা আছে তারা যদি দলের সাধারণ সম্পাদকের মাধ্যমে সভাপতির কাছে আবেদন করে, তাহলে জাতীয় কমিটি আমাদের এই ক্ষমতা দিয়েছে যে, তিনি (শেখ হাসিনা) আবেদন গ্রহণ করে ক্ষমা করে দিতে পারবেন। জাতীয় কমিটি তাঁর উপর দায়িত্ব অর্পণ করেছে বলে জানিয়েছেন ওবায়দুল কাদের।

গঠনতন্ত্র সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যে কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কার্যনির্বাহী সংসদ কর্তৃক গৃহীত শাস্তিমূলক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আপিল বিবেচনা ও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে ক্ষমতা দেওয়া আছে আওয়ামী লীগের জাতীয় কমিটিকে। সেই কমিটির বৈঠকে বিভিন্ন নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া বিদ্রোহীদের ক্ষমা করার সিদ্ধান্ত আসে।

আবারও দলে ফেরার আবেদন কয়েক শতাধিক

আওয়ামী লীগের জাতীয় পরিষদের বৈঠকে দলের বহিষ্কৃতদের সাধারণ ক্ষমা করার সিদ্ধান্তের পরপরই প্রায় কয়েক শ আবেদনের ফাইল জমা পড়ে আওয়ামী লীগের দপ্তরে। অনেকের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার হলেও ফিরতে পারেননি অনেক হেভিওয়েট নেতারা।

দল থেকে বহিস্কৃত হওয়ায় অনেকে দলীয় পদ হারিয়েছেন। এই তালিকায় আছেন বেশ কয়েকজন নেতা, সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী।

আওয়ামী লীগের আলোচিত বহিস্কৃতরা

১. লতিফ সিদ্দিকী (সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী)

২০১৪ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে জ্যাকসন হাইটসের একটি হোটেলে পবিত্র হজ্জ ও তাবলিগ জামায়াত নিয়ে কটুক্তি করেন এই সাবেক মন্ত্রী। এ নিয়ে সারাদেশে তার বিরুদ্ধে মামলা হয়। পরে জাতীয় সংসদ থেকে পদত্যাগ করেন তিনি। এর পরপরই আওয়ামী লীগের সকল পদ থেকে তাকে বহিস্কার করা হয়। এমনকি আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং সাধারণ সদস্যপদ হারান লতিফ সিদ্দিকী। 

২. মুরাদ হাসান (সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী)

বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে মুরাদ হাসানের ‘অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ’ মন্তব্য সংবলিত একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। এরই মধ্যে এক চিত্রনায়িকার সাথে তার টেলিফোন কথোপকথনের একটি অডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এসব ঘটনার জের ধরে প্রতিমন্ত্রীর পদ থেকে মুরাদ হাসানকে অব্যাহতি দেওয়ার দাবি ওঠে। তারপর প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগের পর দল থেকেও বহিস্কার করা হয়।

৩. ইসমাইল হোসেন সম্রাট (সাবেক সভাপতি, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ, যুবলীগ)

অসামাজিক কার্যকলাপ ও শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট যুবলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়। ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। সম্রাটের বিরুদ্ধে অনেক আগে থেকেই ‘ক্যাসিনোকাণ্ডে’ জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ ছিল।

৪. ওমর ফারুক চৌধুরী (সাবেক চেয়ারম্যান, যুবলীগ)

ক্যাসিনো হোতাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়া ও তাদের কাছ থেকে টাকা নেয়া ও কমিটি বাণিজ্য মতো অভিযোগে তাকে বহিস্কৃত করা হয়। আওয়ামী লীগ সরকার টানা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় এসে দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহিষ্ণুতা নীতি গ্রহণ করে। সেই শূন্য সহিষ্ণুতা নীতির অংশ হিসেবেই ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু হয়েছিল গত বছর। সেই অভিযানে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতিসহ আরও কয়েকজন নেতা গ্রেপ্তার হন। এই রকম বিতর্কের মুখেই যুবলীগের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

৫. আদম তমিজী হক (সাবেক কার্যনির্বাহী সদস্য, ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগ)

চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে লাইভে এসে দলীয় শৃঙ্খলাবিরোধী কথাবার্তা বলেন ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সদস্য ও ঢাকা মহানগর উত্তর তাঁতী লীগের এই প্রধান উপদেষ্টা। এ সময় লাইভেই বাংলাদেশের পাসপোর্ট পুড়িয়ে ফেলেন তিনি। এর পরপরই আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার করা হয় এই ব্যবসায়ী নেতাকে।

দলীয় পদ হারানো আলোচিত নেতারা

১. পঙ্কজ নাথ (বরিশালের সংসদ সদস্য)

২০১৯ সালে ক্যাসিনো ব্যবসা এবং নানা অনিয়মে জড়িত থাকার অভিযোগে পদ হারান তৎকালীন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক পঙ্কজ নাথ।

২. ড. আওলাদ হোসেন (ঢাকা-৪ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী - দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন)

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে ঢাকা-৪ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে দাঁড়ান ড. আওলাদ হোসেন। দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করায় সংগঠনের শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ডে দায়ে অভিযুক্ত করে তাঁকে আওয়ামী লীগের প্রাথমিক সদস্যসহ সকল পদ থেকে অব্যাহতি প্রদান করা হয়।

৩. আব্বাস আলী (রাজশাহীর পবা উপজেলার কাটাখালী পৌরসভার মেয়র)

২০২১ সালে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল নির্মাণ নিয়ে কটূক্তি ও বিতর্কিত বক্তব্য দেওয়ায় পৌরসভা আওয়ামী লীগের আহ্বায়কের পদ থেকে কাটাখালি পৌরসভার মেয়র আব্বাস আলীকে বহিষ্কার করা হয়।

আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষের আন্দোলনে সরু ঢাল তৈরি করতে বিভিন্ন সময় বহিষ্কার হওয়া নেতাদের দলে ফেরত আনার বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় আসে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, যে ধরনের দলীয় শৃঙ্খলা পরিপন্থি কাজ করে জাহাঙ্গীর আলম বহিষ্কৃত হয়েছেন, অপরাধের মানদণ্ড বিচারে এর চেয়ে কম অপরাধ করেও দলীয় শাস্তির আওতায় আছেন অনেকে। সেক্ষেত্রে তারাও ক্ষমা আশা করতে পারেন। আগামী নির্বাচনে দলীয় ভারসাম্য ঠিক রাখতে হলে কিছু নেতাদের রাজনীতির মাঠে ফিরিয়ে আনার পরামর্শও দেন তারা।

Link copied!