বন্যার কবলে কুমিল্লা, প্রাণ হারালেন ৪ জন

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

আগস্ট ২৬, ২০২৪, ০১:০৩ পিএম

বন্যার কবলে কুমিল্লা, প্রাণ হারালেন ৪ জন

ছবি: সংগৃহীত

বন্যার কবলে পড়েছে কুমিল্লার ১৪ উপজেলা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত চারটি উপজেলা হলো বুড়িচং, নাঙ্গলকোট, চৌদ্দগ্রাম ও ব্রাহ্মণপাড়া। গোমতী ও সালদা নদী ভাঙনের কবলে পড়ে বুড়িচং ও ব্রাহ্মণপাড়াবাসী এখন পানিবন্দি। সেই সঙ্গে দেবিদ্বারও ডুবেছে। বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে লাকসাম, মনোহরগঞ্জ, তিতাসেও। এ ছাড়া কুমিল্লায় এখনও পর্যন্ত চারজনের প্রাণহানি হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

সোমবার (২৬ আগস্ট) সকাল ১১টা ৪৬ মিনিটে দেশের শীর্ষস্থানীয় টেলিভিশন চ্যানেল ইনডিপেনডেন্ট টিভির প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়েছে।

বন্যা পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গে কুমিল্লায় প্রাণহানির সংখ্যাও বাড়ছে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী এখন পর্যন্ত কুমিল্লায় দুই শিশুসহ চারজনের প্রাণহানি হয়েছে। এর মধ্যে বুড়িচংয়ের গোপীনাথপুরের ফরিদ মিয়া (৬০), তিতাসের জিয়ারকান্দি ইউনিয়নের বাঘাইরামপুর গ্রামের মোক্তার হোসেনের মেয়ে আয়েশা আক্তার (১০) ও মনির হোসেনের মেয়ে সামিয়া আক্তার (১০) অন্যতম। এ ছাড়া আগানগর এলাকা থেকে ভেসে আসা একটি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। যার নাম-পরিচয় উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। তবে বেসরকারি হিসাবে প্রাণহানির এই সংখ্যা আরও অনেক দূর ছাড়াতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে।

বিআইডব্লিউটিএ’র উপসহকারী পরিচালক ফরিদুল এরশাদ জানান, রোববার দুপুরে বুড়িচংয়ের গোপীনাথপুরে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) লোকজন ফরিদ মিয়াকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করে। এ ছাড়া আগানগর এলাকা থেকেও ভাসমান একটি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।

তিতাস উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুমাইয়া মুমিন জানান, কুমিল্লার তিতাস উপজেলার বাঘাইরামপুর গ্রামে সড়ক ভেঙে বন্যার পানির স্রোতে ভেসে গিয়ে মাদ্রাসায় পড়ুয়া দুই চাচাতো বোন নিহত হয়েছে। রোববার বেলা ১১টায় উপজেলার জিয়ারকান্দি ইউনিয়ন বাঘাইরামপুর গ্রামে এ ঘটনা ঘটে।

স্থাপনা ও সড়কের ক্ষয়ক্ষতি জানা যাবে পানি নামার পর
এদিকে বন্যাকবলিত এলাকার লোকজন বলছেন, স্থাপনা ও সড়কের ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে পানি নেমে যাওয়ার পর জানা যাবে। তবে এই ক্ষতি অন্য যেকোনও সময়ের সব রেকর্ড ভাঙবে বলেও জানিয়েছেন স্থানীয়রা। শনিবার থেকে আজ সোমবার পর্যন্ত গত তিনদিনে বন্যাকবলিত এলাকার চিত্র বর্ণনা করে ইনডিপেনডেন্ট টিভি অনলাইনে বলা হয়েছে, এই তিনদিনে বন্যাকবলিত বিভিন্ন এলাকার চিত্র হলো- দলে দলে মানুষ প্লাবিত এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন। হাঁটু বা কোমর সমান পানিতে ভিজেই কোনও রকমে নিরাপদে যাচ্ছেন তারা। তবে যারা আটকা পড়েছেন, তারা ঘরবাড়ির মায়ায় যেতে না চেয়ে এখন জীবন হুমকির মুখে ফেলেছেন বলে জানিয়েছেন উদ্ধারকারীরা। এ ছাড়া বিদ্যুৎ না থাকায় মোবাইল সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে বিভিন্ন এলাকায়। মোবাইল নেটওয়ার্ক ব্যাহত হওয়ায় দুর্গত এলাকাগুলোর খোঁজও নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী এবারের বন্যায় ৬০ হেক্টর কৃষি জমি আক্রান্ত হয়েছে। পানিতে তলিয়ে যাওয়া সবজির আবাদ সবই বিনষ্ট হবে। রোপা আমনের ফলন একদিকে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অন্যদিকে তেমন আগাম মৌসুমের চারা উৎপাদনের বীজ নিয়েও সংকট তৈরির আশঙ্কা রয়েছে।

ত্রাণ দিতে গিয়ে বেকায়দায়
ইনডিপেনডেন্ট টিভির খবরে বলা হয়, ধানমন্ডি থেকে ৩ ট্রাক ত্রাণ নিয়ে কুমিল্লার বুড়িচংয়ের ভরসার এলাকায় এসেছেন পপুলার মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা। ত্রাণ দিতে এসে পড়েছেন বেকায়দায়। নৌকা বা স্পিডবোট না থাকায় প্রত্যন্ত অঞ্চলের বানভাসিদের ত্রাণ দেওয়া সম্ভব হয়নি উল্লেখ করে পপুলার মেডিকেলের পঞ্চম বর্ষের শিক্ষার্থী সুজন আহম্মেদ রনি ইনডিপেনডেন্ট টিভিকে বলেন, “পানির গভীরতায় নৌকা বা স্পিডবোট ছাড়া যাওয়া সম্ভব না। আমরা তো নৌকা বা স্পিডবোট আনিনি। এখানেও কোনও ব্যবস্থা নেই। প্রত্যন্ত অঞ্চলের বানভাসিদের ত্রাণ দিতে পারিনি। বাধ্য হয়ে ডাঙায় যারা তাঁবুতে ছিল তাদের ত্রাণ দিয়ে চলে আসতে হলো।”

এদিকে বুড়িচংয়ের বুড়বুড়িয়া এলাকার গোমতী নদীর ভাঙন সংলগ্ন এলাকায় গিয়ে ইনডিপেনডেন্ট টিভির প্রতিবেদক জানতে পেরেছেন, বেড়িবাঁধের ওপরেই গত তিনদিন ধরে মানবেতর জীবনযাপন করছে ঘরবাড়ি হারা মানুষ। ত্রাণের খাবারই এখন তাদের ভরসা। ভাঙনের পর থেকে ত্রিপলের ছাউনির নিচে কেউ কেউ এক কাপড়েই দিনাতিপাত করছেন। খোলা আকাশের নিচেই রাখা অবশিষ্ট কিছু আসবাবপত্র বৃষ্টিতে ভিজে নষ্ট হচ্ছে।

বাঁধে আশ্রয় নেওয়া গৃহবধূ নয়ন মনি ইনডিপেনডেন্ট টিভিকে বলেন, “বাঁধ ভাঙনের পর কিছু নিয়া আসতে পারিনি। শুধু সন্তান-শ্বশুর-শ্বাশুড়িকে নিয়ে বাঁধে উঠেছি। আমাদের সব শেষ। এক সপ্তাহ আগেও সব ছিল।”

ইনডিপেনডেন্ট টিভির প্রতিবেদনে বলা হয়, সময় যত গড়াচ্ছে বাঁধের ভাঙন তত বড় হচ্ছে। নদীর পানি উচ্চতা কমলেও প্রচণ্ড গতি নিয়ে লোকালয়ে প্রবেশ করছে পানি। সর্বনিম্ন ৩ ফুট থেকে সর্বোচ্চ ১৫ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট পানি বিভিন্ন এলাকায় প্রবাহিত হচ্ছে। একতলা সমান তলিয়ে যাওয়ায় অনেকেই আশ্রয় নিয়েছে দোতলার ওপর, চালের ওপর। বুড়িচংয়ের দুর্গত এলাকাগুলো থেকে সামাজিক মাধ্যম ও মুঠোফোনে খবর আসছে, পানিবন্দি মানুষের চরম বিশুদ্ধ পানি ও ওষুধ সংকট সৃষ্টি হয়েছে। নিরাপদে যাওয়ার জন্য আকুল আবেদন জানাচ্ছেন অনেকে। একই অবস্থার দিকে যাচ্ছে ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলাও।

বুড়িচং উপজেলার বন্যাকবলিত বিভিন্ন ইউনিয়নের সচিত্র বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ইনডিপেনডেন্ট টিভির প্রতিবেদনে বলা হয়, একের পর এক ট্রাক, পিকআপ ভ্যান, কাভার্ড ভ্যান, রিকশা, ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে বন্যা কবলিতদের সাহায্যার্থে ছুটে আসছেন। তবে নৌকা বা স্পিডবোট না থাকায় সেগুলো প্রত্যন্ত অঞ্চলের বানভাসিদের দিতে পারছেন না। সুপেয় পানির ব্যবস্থা ও পয়ঃনিষ্কাশন না থাকায় চরম দুর্বিপাকে পড়েছে দুর্গত এলাকাবাসী।

নাঙ্গলকোটের ৩ ইউনিয়নের বন্যা পরিস্থিতি বেশি খারাপ
এদিকে নাঙ্গলকোট উপজেলার সাতবাড়িয়া, বক্সগঞ্জ, ঢালুয়া ইউনিয়নের বন্যা পরিস্থিতি বেশি খারাপ। এসব এলাকার বেশির ভাগ মানুষই পানিবন্দি। অর্ধাহারে অনাহারে কাটছে নাঙ্গলকোট চৌদ্দগ্রামের বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষের জীবন। মনোহরগঞ্জ এবং লাকসাম এলাকায়ও বন্যার্তদের ত্রাণ সহযোগিতার প্রয়োজন বলে জানিয়েছে স্থানীয়রা। মোট কথা যেসব এলাকা প্লাবিত হচ্ছে সেসব এলাকায়ই ত্রাণের জন্য আহ্বান করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্বেচ্ছাসেবকরা।

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবেদ আলী ইনডিপেনডেন্ট টিভিকে বলেন, “জেলার ১৭টি উপজেলায় সরকারিভাবে ৬০০ মেট্রিক টন চাল এবং ৩৩ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। পারিপার্শ্বিক কারণে বুড়িচং উপজেলায় প্রত্যন্ত অঞ্চলে নৌযানের অভাবে ত্রাণ পৌঁছাতে সমস্যা হয়েছিল, এখন বিভিন্নভাবে নৌযানের ব্যবস্থা হচ্ছে। যে সংকট তৈরি হয়েছে তা সমাধান হচ্ছে। এখন সবাই ত্রাণ পাচ্ছে।”

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো), কুমিল্লার নির্বাহী প্রকৌশলী খান মোহাম্মদ ওয়ালিউজ্জামান ইনডিপেনডেন্ট টিভিকে বলেন, “গেল কয়েকদিন থেকে গোমতির পানি কমেছে। সর্বশেষ রোববার সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত গোমতী নদীর পানি বিপদসীমার ৬৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।”

Link copied!