ছাগল পালনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে পাঁঠা সংকট বলে জানিয়েছেন খামারিরা। সামাজিক ও ধর্মীয় ভুল ধারণার কারণে মূলত খামারিরা পাঁঠা পালন করতে চান না। আবার চাহিদা বেশি থাকায় মর্দা ছাগলকে জন্মের কয়েক দিন পরই খাসি করিয়ে দেয়া হয়। সামাজিক অবজ্ঞা আর নানা কটুকথা উপেক্ষা করে কেউ কেউ পাঁঠা পালন করলেও বেশির ভাগই নিম্নমানের। তার পরও বিকল্প না থাকায় অনেক দূর-দূরান্ত থেকে এসব পাঁঠার কাছেই ছাগল নিয়ে ছুটতে হয় খামারিদের।
বনিক বার্তার প্রতিবেদনেরে তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে ছাগল উৎপাদন করা হলেও বাংলাদেশে সরকারিভাবে এ ব্যবস্থা নেই। লাভজনক না হওয়ায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও তেমন এগিয়ে আসছে না। এসব কারণে ছাগল উৎপাদনে দীর্ঘমেয়াদি সংকট তৈরি হচ্ছে বলে মনে করছেন প্রাণী বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) জেনেটিকস অ্যান্ড অ্যানিমেল ব্রিডিং বিভাগের অধ্যাপক ড. এ কে ফজলুল হক ভূঁইয়া বলেন, ‘ছাগল উৎপাদনে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো দেশে গুণগত মানসম্পন্ন ও অধিক উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন পাঁঠা তৈরির কোনো উদ্যোগ নেই। বছরে বছরে বিজ্ঞানসম্মতভাবে পাঁঠার জাত উন্নয়ন করতে হয়। কিন্তু এ বিষয়েও সরকারি-বেসরকারি কোনো কার্যক্রম দেশে নেই। দ্বিতীয় সমস্যা হলো এক পাঁঠা দিয়ে যদি কোনো বাড়িতে বা এলাকায় এক বছরের বেশি প্রজনন করানো হয় তাহলে ইনব্রিডিং (অন্তঃপ্রজনন) হয়। অর্থাৎ রক্তের সম্পর্কের মধ্যে প্রজননের ফলে যে বাচ্চা জন্ম নিচ্ছে সেটাই ইনব্রিডিং। এতে বাচ্চার মৃত্যুহার বেড়ে যায়।
ড. ফজলুল হক বলেন, ‘সংখ্যা কমে আসায় এখন খামারিরা একই পাঁঠা দিয়ে সব ছাগলকে প্রজনন করাচ্ছেন। এতে অন্তঃপ্রজননের মাধ্যমে জন্ম নেয়া ছাগল রোগাক্রান্ত ও দুর্বল হয়ে পড়ছে। ফলে মাংস উৎপাদন কমে আসার পাশাপাশি ধীরে ধীরে জাতও অনুন্নত হতে থাকে।’
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাবে দেশে এক দশক আগে ছাগলের সংখ্যা ছিল ২ কোটি ৫৪ লাখ। বর্তমানে রয়েছে প্রায় ২ কোটি ৭০ লাখ। এর মধ্যে ছাগলের নিবন্ধিত খামার রয়েছে ৫ হাজার ৪৭৯টি, যেখানে প্রায় পুরোটাই প্রাকৃতিক প্রজননের মাধ্যমে ছাগল উৎপাদন হয়।
দেশে ছাগলের সবচেয়ে জনপ্রিয় জাত ব্ল্যাক বেঙ্গল। জাতটিকে ভৌগোলিক নিদর্শন (জিআই) হিসেবে চলতি বছর স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। এছাড়া যমুনাপাড়ি, হরিয়ানা, ব্রিটল, বারবারি, শিরোহীসহ বিভিন্ন জাতের ছাগল পালন করেন খামারিরা। যদিও ২০০৭ সালের প্রাণিসম্পদ নীতিমালা অনুযায়ী, ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাড়া অন্য কোনো জাতের ছাগল প্রজননের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি নেই।
ঢাকা, চুয়াডাঙ্গা, রাজশাহী, ঝিনাইদহ, সিলেট, চট্টগ্রাম ও বরিশাল—এ সাত জেলায় সরকারি ছাগল উন্নয়ন খামার রয়েছে। যদিও এ খামারগুলো ছাগলের জাত উন্নয়নে কিংবা সম্প্রসারণে খুব বেশি ভূমিকা রাখতে পারছে না। বর্তমানে ছাগলের কৃত্রিম প্রজনন নিয়ে কাজ করে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট ও বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক। তবে সরকারিভাবে ছাগলের কৃত্রিম প্রজনন কার্যক্রমটি খামারিদের মধ্যে বিস্তৃত নয়। আবার বেসরকারিভাবে সিমেন উৎপাদন করলেও লাভজনক না হওয়ায় তার পরিমাণ খুবই সামান্য। সাধারণত নতুন জাত বা জাতবিষয়ক যেকোনো বিষয়ে অনুমোদন দেয় জাতীয় কারিগরি নিয়ন্ত্রণ কমিটি (এনটিআরসি)। সংস্থাটির পক্ষ থেকে শুধু ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগলের সিমেন উৎপাদনের অনুমোদন রয়েছে।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, পাঁঠা সংকট ও ইনব্রিডিং ঠেকাতে সরকারিভাবে ছাগলের কৃত্রিম প্রজনন কার্যক্রম শুরু করতে হবে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর অবশ্য ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের কৃত্রিম প্রজনন ও জাত উন্নয়নে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। যদিও তা এখনো পরিকল্পনা কমিশনের অনুমোদন মেলেনি। প্রকল্পটির মাধ্যমে সারা দেশ থেকে পাঁঠা সংগ্রহ ও জাত উন্নয়নে কাজ করতে চায় এ অধিদপ্তর।
অধ্যাপক ড. এ কে ফজলুল হক বলেন, ‘বর্তমানে বিদেশী বিভিন্ন জাতের মাধ্যমে প্রজনন করানোর কারণে এসব জাত এখন পুরো বাংলাদেশ ছেয়ে যাচ্ছে। অথচ এগুলো সরকারিভাবে নিষিদ্ধ। এসব কারণে প্রাণিসম্পদ খাতের প্রচুর সম্ভাবনা থাকলেও এখন মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। সরকারিভাবে যদি কোনো প্রকল্প নেয়া হয় সেক্ষেত্রে বিজ্ঞানসম্মতভাবে জাত উন্নয়ন করতে হবে। আবার কৃত্রিম প্রজননের পদক্ষেপ নেয়া হলে বিশেষ করে নারীদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া জরুরি।’