আগুনে মৃত্যুর সময়ও সন্তানকে বুকে আগলে রেখেছিলেন মা

নিজস্ব প্রতিবেদক

ডিসেম্বর ১৯, ২০২৩, ০৯:০৫ এএম

আগুনে মৃত্যুর সময়ও সন্তানকে বুকে আগলে রেখেছিলেন মা

নাদিরা আক্তার পপি ও শিশু ইয়াসিন।

ছেলেকে বাঁচাতে প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলে মা নাদিরা আক্তার পপি। আদরে সন্তানকে আগুন থেকে বাঁচাতে বুকে জড়িয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু নাশকতার আগুনের কাছে হার মানে মায়ের প্রতিরোধ। আগুনে পুড়ে যান মা এবং তার তিন বছরের আদরের সন্তান। আগুন নেভানোর পর ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা তাদের মরদেহ উদ্ধার করে। তখনও মা জড়িয়ে ধরে রেখেছিল শিশু ইয়াসিনকে।

মা ও সন্তানের এমন মৃত্যু দেখে চোখে পানি ধরে রাখতে পারেনি ফায়ার সার্ভিস ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। বারবার চোখ মুছেছেন তারা। আর স্বজনহারাদের কান্নায় ভারী হয়ে ওঠে অভিশপ্ত তেজগাঁও রেলস্টেশন। প্রশ্ন রাখলেন, কি কারণে তাদের আগুনে পুড়িয়ে মারা হলো?

নিহত নাদিরা আক্তার পপি একই পরিবারের ৯ সদস্যকে নিয়ে সোমবার রাতে নেত্রকোণা থেকে চড়েছিলেন মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে। গ্রামের বাড়ি থেকে ঢাকায় ফিরছিলেন তারা। বিমানবন্দর স্টেশনে নেমে যান তাদের পাঁচজন। গৃহবধূ পপি, স্বামী মিজানুর রহমান এবং তাদের দুই সন্তান নামবেন কমলাপুর স্টেশনে। এরপর বিমানবন্দর স্টেশন থেকে চলতে শুরু করে ট্রেন। কিন্তু হঠাৎ আগুনে হকচকিয়ে যান তারা।

আগুনের ধোঁয়া ভরে যায় ‘জ’ বগি। ‘আগুন’ ‘আগুন’ বলে চিৎকার শুরু হয়। তেজগাঁও স্টেশনে ট্রেন থামতে সবাই হুড়োহুড়ি করে নেমে যান। শুধু নামতে পারেনি চার হতভাগ্য। তাদের মধ্যে ছিলেন নাদিরা আক্তার পপি ও তার তিন বছরের ছেলে ইয়াসিন।

নিহত পপির দেবর মিনহাজুর রহমান বলেন, ‘তার ভাই মিজানুর রহমান কারওয়ান বাজারে হার্ডওয়্যার ব্যবসায়ী। তেজতুরী বাজার এলাকায় তারা থাকেন। সোমবার গ্রামের বাড়ি থেকে অন্য স্বজনের সঙ্গে তারা ঢাকায় ফিরছিলেন। ট্রেনে আগুন লাগার পর পপির বড় ছেলে মাহিন (৯) ও মিজানুর রহমান ট্রেন থেকে নামতে পারেন। পরে তারা লক্ষ্য করেন পপি ও ইয়াসিন নেই। তবে ততক্ষণে ট্রেনের ওই কোচটিতে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। ফলে কিছুই করার ছিল না। ফায়ার সার্ভিস আগুন নেভানোর পর চারজনের লাশ উদ্ধার করে। তাদের মধ্যে দুজন পপি ও তার শিশু সন্তান ইয়াসিন।’

মিনহাজুর রহমান বলেন, ‘আমার ভাবি ও তার সন্তান রাজনীতি করে না। কিন্তু হরতালের সময় কেন তাদের আগুনে পুড়িয়ে মারা হলো?’ ট্রেনের নিরাপত্তা নিয়েও প্রশ্ন তুলে বলেন, ‘হরতালের মধ্যে ট্রেনের নিরাপত্তা দিতে না পারলে কেন ট্রেন চালালো সরকার? এই মৃত্যুর দায় কে নেবে?’

মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসের আগুনে পুড়ে যাওয়া তিনটি বগিতে সাক্ষ্য দিচ্ছে আগুনের ভয়াবহতার। পুড়ে যাওয়া বগিতে পড়ে আছে ব্যাগ। আরেকটি বগিতে পড়ে আছে হোমিওবাক্স। তিনি কে, আদৌ বেঁচে আছেন কি না জানা যায়নি। পাশে পড়ে থাকা বইটি হয়তো ট্রেনের কোনো যাত্রীর। পুড়ে যাওয়া বগিতে এভাবেই ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে সব। পড়ে আছে ওষুধ, স্যালাইনের প্যাকেট আর চশমা। এসব জিনিস যাঁর, কী ঘটেছে তাঁর ভাগ্যে, সেটা অজানা।

বিএনপি ও জামায়াতের ডাকা হরতালের শুরুতে মঙ্গলবার ভোরে যাত্রীবাহী এই ট্রেনে আগুন দেওয়া হয়। মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস তেজগাঁও এলাকা বিমানবন্দর স্টেশন পার হয়ে তেজগাঁও এলাকায় এলে ট্রেন আগুন দেখতে পান যাত্রীরা।

ফায়ার সার্ভিসের সিনিয়র স্টেশন অফিসার নাজিমউদ্দিন সরকার জানান, তাদের ধারণা, রেলের বগির ভেতরেই পেট্রোল বা রাসায়নিক ব্যবহার করে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। তবে দুর্ঘটনার কারণ জানতে ইতোমধ্যে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ফায়ার সার্ভিস।

এর আগে গত ১৩ই ডিসেম্বর বিএনপির অবরোধের মধ্যে গাজীপুরের ভাওয়ালে রেল লাইন কেটে ফেলায় এই মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসের সাতটি বগিসহ উল্টে পড়েছিল। সেই ঘটনায় একজন নিহত হয়। রেললাইন কেটে নাশকতার ঘটনায় জড়িত থাকার দায়ে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের ২৮নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও বিএনপি নেতা হাসান আজমল ভূঁইয়াসহ সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

গত ১৬ নভেম্বর টাঙ্গাইলে একটি কমিউটার ট্রেনে আগুন দেওয়া হয়। এতে ট্রেনটির দুটি বগি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর দুদিন পর ১৯ নভেম্বর জামালপুরের সরিষাবাড়িতে ‘যমুনা এক্সপ্রেসে’ আগুন দেওয়া হয়। এতে ট্রেনটির দুটি বগি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ২২ নভেম্বর ‘উপবন এক্সপ্রেস’ সিলেট স্টেশনে থাকা অবস্থায় আগুন দেওয়া হয়। এতে হতাহতের ঘটনা না ঘটলেও একটি বগি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

Link copied!