ছিলো মহল্লার মাঠ হয়ে গেল প্লট, এবার হচ্ছে মার্কেট!

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

জুন ২, ২০২২, ১২:০২ এএম

ছিলো মহল্লার মাঠ হয়ে গেল প্লট, এবার হচ্ছে মার্কেট!

”স্বাধীনতার পর থেকে যেটাকে মাঠ হিসেবে চিনি এখন শুনতাছি এটা মাঠ নয়, এটা নাকি প্লট। আমার বড় ভাইয়ের আমল থেকে এখানে আমরা খেলাধুলা করি। প্রায় চার প্রজন্ম ধরে আমরা এখানে খেলাধুলা করছি। এখন সেই মাঠ প্লট দাবি করে দখলদাররা বিল্ডিং করে ফেলতাছে।”এভাবেই মাঠ হারানোর কথা জানালেন মিরপুর-১২ এর অগ্রদূত মাঠের বাসিন্দা জসিমউদ্দিন চৌধুরী।

জসিমউদ্দিনদ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে আরও বলেন, “৪৯ বছর ধরে এ স্থানকে মাঠ হিসেবে ব্যবহার করেছি। পুরো মাঠটা ছিলো ৩০ কাঠা জমির উপর। সেখানে আমরা আমাদের ছেলে-মেয়েদের পড়াশুনার জন্য ১০ কাঠা জমির উপর একটি স্কুল নির্মাণ করি। তারপর এলাকার পানির স্বল্পতার কারণে আরো ১০ কাঠার উপর একটি পানির পাম্প তৈরি করি। অন্য ১০ কাঠা জমিতে আমরা ১৯৭৭ সালে ‘অগ্রদূত সমাজ কল্যাণ ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অঙ্গন’ নামে একটি ক্লাব তৈরি করি। এই ক্লাবের মাধ্যমে আমরা মাঠটাকে রক্ষণাবেক্ষণ করি। ঈদের নামাজ, ওয়াজ মাহফিল, জানাজাসহ বিভিন্ন ধরনের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো এই মাঠে”।

কোন ধরনের বার্তা ছাড়াই বিনা নোটিশে মাঠটি দখল করার অভিযোগ তোলেন এলাকাবাসি। ছোট বেলা থেকে ওই মাঠে খেলাধুলা করেছেন কাজি দিপু। দিপুর ভাষ্যমতে, দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, ”কোনো ধরনের নোটিশ ছাড়াই ৩০শে মার্চ দুপুরে দুইটা বুলডোজার ও শতাধিক পুলিশ এবং গুণ্ডাবাহিনী নিয়ে দখলদার মান্নান শেখ ও গণপুর্তের লোকজন এসে আমাদের ক্লাব, শহীদ মিনারসহ সব স্থাপনা ভেঙ্গে দেয়। স্থানীয়রা বাধা দিতে আসলে তাদের বিপদের ভয় দেখানো হয়। বেশ কয়েকজন ভিডিও করতে গেলে তাদের ক্যামেরাও ভেঙ্গে ফেলে। দখলের এক সপ্তাহ পর এখানে পুলিশি পাহারা বসানো হয়েছে”।

মাঠটি ফিরে পাওয়ার জন্য স্থানীয় জনগণ আদালতে যান। দায়ের করা হয় মামলা। ওই মামলায় হাইকোর্ট দখলদারদের বিপক্ষে স্টে অর্ডার দেন।  

এ ব্যাপারে অগ্রদূত মাঠের বাসিন্দা জাকারিয়া হাফিজ বাপ্পি দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, “আমরা ১৮ই এপ্রিল দখলদারদের বিরুদ্ধে মামলা করলে আদালত আমাদের পক্ষে রায় দেন। মাঠে দখলদারদের বিরুদ্ধে স্টে অর্ডার সংক্রান্ত সাইনবোর্ড বসালে মধ্যরাতে এক-দেড়শ পোলাপাইন(লোকজন) এসে তা  ভেঙ্গে ফেলে এবং প্রতিবাদকারীদের ওপর হামলা চালায়।”

জাকারিয়া হাফিজ বাপ্পি আরও বলেন, “হামলা করার পরও দখলদাররা শান্ত হননি।  প্রতিবাদে সরব থাকা ওই এলাকার বাসিন্দা মোস্তফা শহীদ খান, ফরিদা ইয়াসমিন রিনা, মাসুদুর রহমান খান, রাকিবুল ইসলাম হিরা ও জাকারিয়া হাফিজ বাপ্পিসহ প্রায় ৩০ জনের বিরুদ্ধে চাদাঁবাজির মামলা দেয়।”

দখলদারদের মামলায় ভুক্তভোগী ফরিদা ইয়াসমিন রিনা দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, ” মাঠটি দখল করার সময় আমি লাইভ করি। এতে তারা আমার নামে এক কোটি টাকা চাদাঁবাজির মামলা দিয়ে হয়রানির মধ্যে রেখেছে। মামলার কারণে আমাদের বাসার একটা লোকও বাসায় ঈদ উদযাপন করতে পারিনি”।

মামলার বিষয় জানতে চাইলে পল্লবী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) পারভেজ ইসলাম দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, “এটা গৃহায়নের একটা প্লট। অগ্রদূতের নাম করে কতিপয় লোক জায়গাটি দখল করে রেখেছিল। পরে গৃহায়নের লোকজন ম্যাজিস্ট্রেট পুলিশ নিয়ে এসে যার প্লট তাকে বুঝিয়ে দেয়।” মামলার এখনও তদন্ত চলছে বলে তিনি জানান।

অগ্রদূত মাঠটা কীভাবে প্লট হলো? এমন প্রশ্নের জবাবে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ২ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. সাজ্জাদ হোসেন দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, ”অগ্রদূত মাঠটা স্বাধীনতার পর থেকে খোলা জায়গা ছিলো। এখানে ছেলেপেলেরা মাঠ হিসেবে ব্যবহার করতো, খেলাধুলা করতো। এটা কবে কীভাবে প্লট হইছে আমরা জানি না। শুনেছি ১৫-২০ বছর আগে প্লট হইছে। তারপর দীর্ঘদিন ক্লাব ছিলো। মাসখানিক আগে এদেরকে সরিয়ে দেওয়া হয়।”

উদ্ধারের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এটা সিটি করপোরেশনের জায়গা নয়। এটা গণপূর্তের জায়গা। গণপূর্ত যদি কাউকে বরাদ্ধ দেয় তবে সে ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনতো কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে না।”

তবে মাঠ দখল করা হয়নি, গৃহায়ন ও গণপূর্ত থেকে তাদেরকে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে বলে দাবি করেন মাঠের জায়গার বর্তমান মালিক মান্নান শেখ।

মান্নান শেখ দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, “ওইখানে কোনো মাঠ ছিলো না। ওই প্লটটা যার নামে ছিলো তাদের থেকে ভাড়া নিয়ে ওখানকার কতিপয় লোক কতগুলো দোকান করে। পাশাপাশি একটা ক্লাব করে। ওই ক্লাবে লোকজন জুয়া খেলতো। আমরা ১৩ জন আগের মালিকের থেকে ২০১৮ সালে জমিটি ক্রয় করি। পরে সরকারি সব বিধিবিধান মেনে আমরা সচিব বরাবর অঅবেদন করি জমিটি অবৈধ দখলদারদের থেকে মুক্ত করার জন্য। এরই পরিপ্রেক্ষিতে মেজিস্ট্রেট এসে জমিটি আমাদেরকে বুঝিয়ে দেয়। আমরা নিজেরা কোনো দখল করি নাই, হাউজিং থেকে এটা আমাদেরকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে।”

এখানে এখন কি হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এখন বিল্ডিং হইতেছে। কি হবে সেটা পরে দেখা যাবে। মার্কেটও হতে পারে থাকার বাসাও হতে পারে।”

মিরপুর এলাকার নকশার মধ্যে এটি মাঠ ছিলো না বলে জানান গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের ঢাকা ডিভিশন-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী জোয়ারদার তাবেদুন নবী। তিনি দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, “যখন মিরপুরের পুরো নকশা করা হয় তখন সে নকশার মধ্যে এটি কখনোই মাঠ ছিলো না। এটি প্লট আকারেই দেখানো হয়েছে। ১৯৮৬ সালে মিরপুরের এক স্বনামধন্য ব্যক্তির নামে এ প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়। পরবর্তীতে ২০১৩ সালে মান্নান শেখসহ ১৩ জনের কাছে এ প্লট তিনি বিক্রি করেন। যার নামজারি ও রেজিষ্ট্রেশন সব কিছু সম্পন্ন করা হয়েছিলো।”

গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের এই নির্বাহী পরিচালক আরও বলেন, “এরপর আমরা যখন জানতে পারলাম ক্লাব ও দোকানের লোকজন ওখান থেকে সরেনি, তখন আমরা তাদের উচ্ছেদ করার সিদ্ধান্ত নেই  এবং তাদের সরে যেতে বলি। তারা সরে না যাওয়ায় আমরা প্রশাসনকে সাথে নিয়ে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করি।”

এর আগে কোন উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়েছিলো কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এ বিষয়ে আমি বলতে পারবো না।”

Link copied!