জেলায় জেলায় মুখোমুখি ‘পদযাত্রা’ ও ‘শান্তি সমাবেশ’

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

ফেব্রুয়ারি ১২, ২০২৩, ০১:৩৪ এএম

জেলায় জেলায় মুখোমুখি ‘পদযাত্রা’ ও ‘শান্তি সমাবেশ’

সরকার হটানোর আন্দোলনে তৃণমূলের মানুষকে সম্পৃক্ত করতে ১১ ফেব্রুয়ারি দেশজুড়ে ইউনিয়ন পর্যায়ে ‘পদযাত্রা’ কর্মসূচি করেছে বিএনপি। যুগপৎ আন্দোলনের অংশ হিসেবে গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, এলডিপি, গণফোরাম-পিপলস পার্টি, বাম গণতান্ত্রিক ঐক্য রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে একই কর্মসূচি পালন করে।

একই দিনে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের সক্রিয় করতে কর্মসূচির ডাক দিয়ে আওয়ামী লীগও ‘শান্তি সমাবেশ’ করেছে।

এই ‘পাল্টা কর্মসূচি’র কারণে দেশের বিভিন্ন এলাকায় দুটি দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। যদিও নিজেদের কর্মসূচিকে বিএনপির কর্মসূচির বিপরীতে করা কর্মসূচি হিসেবে মানতে নারাজ আওয়ামী লীগ। দুটি দলই একে অন্যের ওপর সংঘর্ষ ও হামলার দায় চাপাচ্ছে।

আওয়ামী লীগের কর্মীরা ‘বিনা উসকানি’তে হামলা করেছে, তাদের মঞ্চ দখল করে সমাবেশ করেছে বলে বিএনপি অভিযোগ করছে। এছাড়াও পুলিশও বাধা দিয়েছে বলে অভিযোগ করে তারা। ‘বিনা কারণে’ পুলিশ তাদের ওপর হামলা করেছে বলে দাবি করছে দলটির নেতারা।

অন্যদিকে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বিএনপির কর্মসূচিতে ‘নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছেন' বলে দাবি করছে ক্ষমতাসীন দলের কর্মীরা। 

দেশজুড়ে এই কর্মসূচিগুলোতে নেতা-কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষের কারণে সহিংসতা সৃষ্টি হয়। কয়েকশ নেতাকর্মী আহত হয়েছে বলে বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে।

সিরাজগঞ্জ

সিরাজগঞ্জের সদর উপজেলার কালিয়া হরিপুর ইউনিয়নের পাইকপাড়া মোড়ে শান্তি সমাবেশের প্রস্তুতির জন্য সকাল ১১টার দিকে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা জমায়েত হয়। এ সময় পদযাত্রা কর্মসূচিতে অংশ গ্রহণ করতে যাচ্ছিলেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। পাইকপাড়া মোড়ে উভয় দলের নেতাকর্মীরা মুখোমুখি হলে তাদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও ইট পাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে।

এ ঘটনায় ১১টি মোটরসাইকেল ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। পরে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয় বলে সদর থানার ওসি হুমায়ুন কবির জানান।

ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে সিরাজগঞ্জ-২ আসনের এমপি অধ্যাপক হাবিবে মিল্লাত জানান, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সড়কের উপর ছিল। এ সময় বিএনপির নেতাকর্মীরা এসে অতর্কিত হামলা করে এবং মোটরসাইকেল ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে।

জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাইদুর রহমান বাচ্চু অভিযোগ করে বলেন, “শান্তিপূর্ণ পদযাত্রা কর্মসূচিকে বিঘ্ন ঘটাতে পরিকল্পিতভাবে আওয়ামী লীগ এ হামলার ঘটনা ঘটিয়ে আমাদের ওপর দোষ চাপাচ্ছে।”

ভোলা

ভোলায় কর্মসূচির দিনে দুপুর বেলায় ভোলা সদর ও বোরহানউদ্দিন উপজেলায় হামলা হয় বলে জানান জেলা বিএনপির সদস্য সচিব রাইসুল আলম। এতে অন্তত ৮০ জন নেতা-কর্মী আহত হয়েছেন বলে দাবি করেন এই নেতা।

জেলার ভেলুমিয়া ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক দলের সহসভাপতি ফারুক গাজীর অভিযোগ, সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতাকর্মী তাকে ভেলমিয়া বাজারে মারধর করেন। এতে তিনি গুরুতর আহত হন। পরে স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে ভোলা সদর হাসপাতালে নিয়ে যায়।

অন্যদিকে বোরহানউদ্দিন উপজেলার পক্ষিয়া ইউনিয়ন বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জসীমউদ্দিন ফরিদ জানান, তাকে কুপিয়ে জখম করা হয়েছে। এতে মাথায় ৪৮টি সেলাই দিতে হয়েছে।

তার দাবি, ইউপি চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন সর্দারের লোকজন সকাল ১০টার দিকে নয়া মিয়ার হাট বাজারে ওষুধের ফার্মেসিতে হামলা চালিয়ে তাকে ও তার ছেলেকে বেধড়ক মারধর করে।

এসব হামলার ঘটনা অস্বীকার করে ভেলুমিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ক্ষমতাসীন দলের নেতা আব্দুস সালাম মাস্টার জানান, “বিএনপির উপর কোনো হামলার ঘটনা ঘটেনি।”

হামলার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জহুরুল ইসলাম নকিবও।

ভোলা সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. শাহীন ফকির বলেন, “দুপুর আড়াইটার পর্যন্ত সদর উপজেলার কোথাও কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।”

লক্ষ্মীপুর

চট্টগ্রাম বিভাগের জেলাটির সদর উপজেলার মান্দারি, হাজিরপাড়া, চরশাহী, কুশাখালী ও কমলনগর উপজেলার চরকাদিরা ও পাটোয়ারীরহাটসহ বিভিন্ন ইউনিয়নে দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত সংঘাতের খবর এসেছে। এতে ‘শতাধিক নেতাকর্মী’ আহত হওয়ার দাবি করেছে বিএনপি। এদের মধ্যে সাতজনকে হাসপাতালে পাঠানোর কথা জানিয়েছেন নেতারা।

অন্যদিকে এই এলাকার আওয়ামী লীগ নেতারা দাবি করেছেন তাদের ‘শান্তি সমাবেশে’ বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের হামলার কারণে ১০ জনেরও বেশি আহত হয়েছে। 

দলটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, কমলনগরের চর কাদিরা ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান সোহেল বাঙালির অবস্থা আশঙ্কাজনক। ধারালো অস্ত্রের আঘাতে তার মাথা কেটে গেছে। তিনি সদর হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। 

সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন জানান, বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত ৬০ জনেরও বেশি নেতাকর্মী চিকিৎসা নিয়েছেন। আঘাত গুরুতর হওয়ায় কমলনগরের মিজানুর রহমান সোহেল ও বিএনপির ৭ জন নেতাকর্মীকে ভর্তি দেওয়া হয়েছে। 

জামালপুর

জামালপুর সদর উপজেলার তিতপল্লা ইউনিয়ন পরিষদের সামনে দুই দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ায় ঘটনা ঘটে। পুলিশ এসে ফাঁকা গুলি ও কাঁদুনে গ্যাস ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ওয়ারেছ আলী মামুন অভিযোগ করেন, পদযাত্রা কর্মসূচিতে যাওয়ার সময় বিএনপির নেতাকর্মীদের ওপর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও পুলিশ হামলা চালায়। এ সময় পুলিশ বিএনপির নেতাকর্মীদের লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ ও কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করে।

হামলায় বিএনপি নেতা জয়নাল আবেদীন, শরিফ উদ্দিন আকন্দ, আকবর আলী, চান মিয়া, সোহেল তানভীরসহ অন্তত ১৮ জন আহত হন বলে অভিযোগ তার।

সদর উপজেলার ঘোড়াধাপ, দিগপাইত ও বাঁশচড়া ইউনিয়নে হামলায় আরও ২০ থেকে ২৫ জন আহত হয় বলে দাবি তার। এরপর পুলিশ বিএনপির নেতাকর্মীদের বাড়িতে হানা দিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।

তবে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বিজন কুমার চন্দ সাংবাদিকদের বলেন, “আমাদের কোনো নেতাকর্মী বিএনপির নেতাকর্মীদের ওপর হামলা করেনি। বরং তারাই আমাদের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চালিয়েছে। এটা জামায়াত-বিএনপির পুরাতন চরিত্র।”

পুলিশ বলেছে, বিএনপির নেতা-কর্মীরাই হামলা করেছে আওয়ামী লীগের ওপর।

জামালপুর সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কাজী শাহনেওয়াজ বলেন, “শান্তি সমাবেশের জন্য আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা কামালখান মোড়ে জড়ো হলে সেখানে বিএনপির নেতাকর্মীরা হামলা করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ শটগানের ৩৪টি ফাঁকা গুলি এবং ছয়টি কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করে।”

নারায়ণগঞ্জ

নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে বিএনপি ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষে অন্তত ১০ জন নেতাকর্মী আহত হয়েছেন বলে অভিযোগ বিএনপির।

কেন্দ্রীয় বিএনপির সহ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক নজরুল ইসলাম আজাদ বলেন, নেতাকর্মীরা পাঁচরুখী বাজার থেকে পদযাত্রা শুরু করে। বাজার থেকে কিছুদূর গিয়ে পদযাত্রা শেষ করার পরিকল্পনা ছিল আমাদের। কিন্তু ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে নেতা-কর্মীদের বাধা দিয়ে লাঠিপেটা শুরু করে পুলিশ। পরে রাবার বুলেট ও কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করে। এতে সাতগ্রাম ইউনিয়ন ছাত্রদলের সভাপতি নাহিদ, ছাত্রদল নেতা ফারুক, যুবদল নেতা হাবিবসহ দশজন আহত হন। হাবিবের চোখের নিচে রাবার বুলেট লেগে মারাত্মক জখম হয়েছে।

এদিকে আড়াইহাজার থানার ওসি আজিজুল হক গণমাধ্যমকে জানান, “রাস্তা অবরোধ করে যান চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে কর্মসূচি পালন করছিল বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা। এতে মহাসড়কে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। তাদের সড়ক ছেড়ে দিতে অনুরোধ করা হয়। কিন্তু অনুরোধ না শুনে পুলিশের ওপর চড়াও হয়ে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করতে শুরু করেন তারা। পরে পুলিশ অ্যাকশনে যায়। আত্মরক্ষার্থে পুলিশ কয়েকটি রাবার বুলেট ও কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।”

যশোর

যশোর সদর উপজেলায় পদযাত্রা কর্মসূচিকালে নেতাকর্মীদের লাঠিপেটা করেছে পুলিশ এমন অভিযোগ এনেছে বিএনপি।

বিকেলে উপজেলার ফতেহপুর ইউনিয়নের বাউলিয়ায় এ ঘটনা ঘটে বলে বিএনপির খুলনা বিভাগীয় ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিত।

ঝিকরগাছা উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নেও পদযাত্রায় বাধা দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেন নেতা অমিত। তবে জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বেলাল হোসাইন কিছু জানেন না বলে দাবি করেছেন।

নওগাঁ

নওগাঁ সদর উপজেলার তিলকপুর ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের কর্মীরা হামলা চালায় বলে অভিযোগ করেছেন জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম ধলু।

বেলা ১১টার দিকে ফতেপুর বাজার থেকে তিলকপুর ইউনিয়ন পরিষদ অভিমুখে স্থানীয় বিএনপির পদযাত্রা বের হয়। পদযাত্রাটি ফতেপুর-তিলেকপুর সড়ক হয়ে উপজেলার আদম দুর্গাপুর এলাকায় পৌঁছলে সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ডিএম আওয়াল আতা এবং জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সাব্বির রহমান রিজভীর নেতৃত্বে তাদের নেতাকর্মীরা বাধা দেন। এতে বিএনপি ও এর অঙ্গ-সংগঠনের পাঁচ নেতাকর্মী আহত হন।

তবে আওয়ামী লীগ নেতা ডি এম আউয়াল বলেন, “বিএনপির পদযাত্রাকে ঘিরে যাতে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে, সেজন্য পদযাত্রার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে আমাদের দলের ছেলে-পেলেরা সহায়তা করছিল।”

নাটোর

নাটোরে সদর উপজেলার ছাতনী এলাকায় বিএনপির নেতাকর্মীদের তৈরি মঞ্চে তাদের নেতারা পৌঁছানোর আগেই অন্য রাস্তা দিয়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা স্লোগান দিয়ে সেই মঞ্চ দখল করে নেন বলে অভিযোগ বিএনপির।

এছাড়াও জেলার নলডাঙ্গা উপজেলার মাধনগর ইউনিয়নের মাধনগর রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় বিএনপি নেতাকর্মীদের স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা হামলা করেছে বলেও অভিযোগ ওঠেছে।

যদিও ছাতনী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি দুলাল সরকার এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেন। তার দাবি, এমন কোনো ঘটনাই ঘটেনি।

উপজেলার পিপরুল, সদরের কাফুরিয়া ও সিংড়া উপজেলার কলম, হাতিয়ান্দহ, চৌগ্রাম, রামানন্দ খাজুরা, ইটালী ইউনিয়ন, গুরুদাসপুরের মশিন্দা ও বিয়াঘাট ইউনিয়নে কর্মসূচি চলাকালে হামলায় অন্তত ১২ নেতাকর্মী আহত হয়েছেন বলে জানান জেলা বিএনপির আহ্বায়ক শহিদুল ইসলাম বাচ্চু।

তবে অভিযোগ প্রত্যাখান করেন রামানন্দ খাজুরা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও ইউপি চেয়ারম্যান জাকির হোসেন।

এছাড়া কক্সবাজারের টেকনাফেও দুই পক্ষের সংঘর্ষে অন্তত ২০ জনের আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

Link copied!