জ্বালানিসহ আর্থিক সংকট মোকাবিলায় আরবমুখী বাংলাদেশ

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

অক্টোবর ৩০, ২০২২, ০৩:১০ এএম

জ্বালানিসহ আর্থিক সংকট মোকাবিলায় আরবমুখী বাংলাদেশ

দেশে চলমান জ্বালানি সংকট ও খাদ্য ঝুঁকি মোকাবিলায় মধ্যপ্রাচ্যমুখী হচ্ছে বাংলাদেশ। যার ফলে মোট ১২ টি খাতের জন্য সহযোগিতা ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। বিশ্বের দেশে দেশে চলছে অর্থনৈতিক মন্দার ঢেউ। বাংলাদেশের পরিস্থিতিও শংকার সৃষ্টি করছে। এরকম একটি সময়ে আজ রবিবার সৌদি আরবের রিয়াদে বাংলাদেশ-সৌদি আরব যৌথ কমিশন (জেসি) বৈঠকে বসতে যাচ্ছে। 

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সর্বোচ্চ জোর

আগামী ৩০-৩১ অক্টোবর সৌদি আরবের রিয়াদে অনুষ্ঠিতব্য ১৪ তম জেসি বৈঠকে যোগদানের প্রস্তুতি নিয়েছে সরকার। ওই বৈঠকে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করবেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিরা। বৈঠকে যোগদানের আগে অর্থ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে এ সংক্রান্ত কয়েকটি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা করে ইআরডি। বৈঠকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সর্বোচ্চ জোর দেওয়া হবে।

এসব সভায় সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার এবং দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বাড়ানোর তাগিদ দেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে সংশ্লিষ্ট সূত্র। এছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের কাছে ১২ খাতে সহযোগিতা চাওয়া হবে। এর মধ্যে দ্বিপক্ষীয় অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক উন্নয়ন, জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও কনস্যুলার, বেসরকারি বিমান চলাচল, পর্যটন ও সাংস্কৃতিক, বিনিয়োগ, আবুধাবি উন্নয়ন ফান্ড, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাত, শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাত, সামুদ্রিক পরিবেশ উন্নয়ন, কৃষি, স্বাস্থ্যসেবা ও স্বাস্থ্যশিক্ষা খাত এবং মানবিক ও দাতব্য সহায়তা সংক্রান্ত সহযোগিতা অন্যতম।

সৌদি আরব ইতিমধ্যে বাংলাদেশে সহযোগিতা বাড়ানোর ব্যাপারে তাঁদের ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেছে। শুধু তাই নয়, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে কয়েকটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই করেছে বাংলাদেশ-সৌদি আরব। এছাড়া সৌদি আরবের মতো দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়ানো হবে সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, বাহরাইন, ওমান, ইরাক, কুয়েত, লেবানন, মিসর এবং তুরস্কের সঙ্গে।

মধ্যপ্রাচ্যের বিনিয়োগ ও দেশীয় প্রতিষ্ঠান

দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও জনশক্তি রফতানি বাড়াতে বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাসের কমার্সিয়াল কাউন্সিলরের পক্ষ থেকে এসব দেশকে আনুষ্ঠানিক চিঠি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) মধ্যপ্রাচ্য শাখা-১ থেকে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সরকার। সৌদি আরবের সাথে অনুষ্ঠিতব্য জেসি বৈঠকেও এ সংক্রান্ত একটি রূপরেখা তুলে ধরা হবে। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) আলাদা কর্মসূচি রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যকে ঘিরে।

ইতিমধ্যে বিডার পক্ষ থেকে ওয়ান স্টপ সার্ভিস নিশ্চিত করার কথা সৌদি আরবকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। আরব বিশ্বের শীর্ষদেশ সৌদি আরবের সাথে পারস্পরিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি পেলে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশের সাথেও দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বাড়বে বলে মনে করছে ইআরডি।

আর এ কারণেই ১৪তম জেসি বৈঠক সামনে রেখে এবার জোরেশোরে প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। ওই বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দলের অংশগ্রহণের কথা রয়েছে। এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশে বিনিয়োগের চমৎকার পরিবেশ বিরাজ করছে। বিশেষ করে বড় অবকাঠামো, তথ্যপ্রযুক্তি,  যোগাযোগ, কৃষি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, চিকিৎসা খাতে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের (পিপিপি) ভিত্তিতে বিনিয়োগের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।

বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী আরব দেশগুলো

সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন তেল কোম্পানি আরামকো ইতিমধ্যে একটি তেল শোধনাগার নির্মাণ, পরিচালনা এবং রক্ষণাবেক্ষণে আগ্রহ দেখিয়েছে। এর জন্য খরচ হবে দেড় থেকে ২ বিলিয়ন ডলার। সৌদি প্রতিষ্ঠান ইঞ্জিনিয়ারিং ডাইমেনশন এলএলসি বাংলাদেশে বিনিয়োগের বিষয়ে অনেক বেশি উৎসাহী।

প্রতিষ্ঠানটি ৭টি প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী এবং গত বছরের নবেম্বরে ঢাকায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ সম্মেলনের সময় প্রায় ১ দশমিক ৬৮৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট  ডেভেলপমেন্ট অথরিটির সাবেক নির্বাহী চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম  বলেন, এ মুহূর্তে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সৌদি আরবের বিনিয়োগ দ্রুত প্রয়োজন। দেশটির সাথে যেকোনো ফোরামে আলোচনায় এ বিষয়টির ওপর সর্বোচ্চ জোর দিতে হবে।

সিরাজুল ইসলাম জানান, ঢাকা ইস্ট-ওয়েস্ট এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে যেসব প্রতিষ্ঠান আগ্রহ দেখিয়েছে তাদের মধ্যে ইঞ্জিনিয়ারিং ডাইমেনশন অন্যতম। কিছু সৌদি বিনিয়োগ ইতোমধ্যে পাইপলাইনে রয়েছে। তাঁরমধ্যে আছে পাবলিক প্র্ইাভেট অংশীদারিত্বে রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল দিয়ে পতেঙ্গা কন্টেনার টার্মিনালের উন্নয়ন। কতটা সফলভাবে পাইপলাইনে থাকা কাজগুলো পরিচালনা করতে পারা যাবে তার ওপর আরও সৌদি বিনিয়োগ অনেকাংশে নির্ভর করবে।

আন্তর্জাতিকভাবে স্বনামধন্য জ্বালানি সংস্থা এসিডব্লিউএ পাওয়ার চট্টগ্রামে একটি ৭৩০ মেগাওয়াটের কম্বাইন্ড সাইকেল পাওয়ার প্ল্যান্ট নির্মাণে প্রায় ৬০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। যৌথ উদ্যোগে ১০০ মেগাওয়াট আইপিপি সৌর প্রকল্প নির্মাণে ১০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে চায় আল-ফানার। আল-বাওয়ানি নির্মাণ ও প্রকৌশল প্রকল্পের জন্য দক্ষ মানব সম্পদের কর্মসংস্থানে প্রায় ১০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগে আগ্রহী।

বিনিয়োগের বিকল্প বাজার

সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশে বাংলাদেশের পোশাক রফতানির সুযোগ রয়েছে। দেশের গার্মেন্টস খাতের উদ্যোক্তারা এ ব্যাপারে তাদের আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। সৌদি আরবের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে করা এ পর্যন্ত যেসব চুক্তি করা হয়েছে সেগুলো দ্রুত বাস্তবায়নে সৌদি আরবকে অনুরোধ করা হবে। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ জানান, বাংলাদেশ-সৌদি আরব যৌথ কমিশন বৈঠকের প্রস্তুতি নিয়েছে বাংলাদেশ।

সৌদি আরবের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বিনিয়োগ সংক্রান্ত একাধিক চুক্তি রয়েছে বাংলাদেশের। এসব চুক্তি এখন বাস্তবায়ন হতে হবে। জানা গেছে, পেট্রোবাংলা এবং আরামকোর মধ্যে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) সংক্রান্ত একটি  চুক্তির বিষয়ে আলোচনা চলছে। এতে দেশের এলএনজি সঙ্কট দূর হবে। এছাড়া ইস্টার্ন রিফাইনারি ইউনিট-২ প্রতিদিন ৩ মিলিয়ন টন ক্রুড পামঅয়েল প্রক্রিয়াজাতকরণে সৌদি আরবের সহযোগিতা চেয়েছে।

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড এবং বিশ্ববিখ্যাত এসিডব্লিউও পাওয়ারের মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হবে। এতে দেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে ব্যাপক অগ্রগতি হবে বলে আশা করা হচ্ছে। সৌদি আরবের সঙ্গে ১০০ মেগাওয়াটের সৌর ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার  প্ল্যান্ট (আইপিপি) নির্মাণ এবং ট্রান্সফর্মার ও বৈদ্যুতিক যন্ত্রাংশ উৎপাদনের একটি চুক্তি রয়েছে।

এসব চুক্তি দ্রুত বাস্তবায়ন হওয়া প্রয়োজন বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। এদিকে সৌদি আরবের আরও ২০ কোম্পানি বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখিয়েছে বলে জানিয়েছেন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি জসিম উদ্দিন। তিনি বলেন, সৌদিসহ বেশ কয়েকটি আরব দেশ বিনিয়োগ করতে আগ্রহ দেখায়। যত ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেয়া দরকার, আমরা তাদের দেব। বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতার ক্ষেত্রে দুই দেশের আরও অনেক কিছু করার আছে।

এছাড়া সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব বা পিপিপির ভিত্তিতেও দেশটি বিনিয়োগে আগ্রহী। মূলত বাংলাদেশের অবকাঠামো, চিকিৎসা, পর্যটনসহ বিভিন্ন খাতে সৌদি আরব বিনিয়োগ করবে। সৌদি আরবের সঙ্গে এ সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। বাংলাদেশের পক্ষে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান কয়েক মাস আগে এ ধরনের একটি সমঝোতা স্মারকে সই করেছেন।

Link copied!