ভোরের আজান পড়ার সাথে সাথে কর্মঘন্টা শুরু হয় একজন ক্যান্টিন বয়ের। হলের প্রত্যেক সদস্য ঘুমোতে যাওয়ার পর তার কাজ শেষ হয় মাঝরাতে। কখনো রাত আরো গভীর হয়। দীর্ঘ ১৭-১৮ খাটুনির পর বিশ্রাম মিলে মাত্র ৩/৪ ঘন্টা ।
১২ বছরের রকি (ছদ্মনাম) কাজ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ক্যান্টিনে। দ্য রিপোর্ট ডটলাইভের এই প্রতিবেদকের সঙ্গে সে শেযার করে তার জীবনের করুণ অধ্যায়।
রকি বলে, তার ক্যান্টিন ম্যানেজার এবং তার আগে থেকে কাজ করে আসা কর্মচারীরা তাকে সামান্য কারণে, অনেক ক্ষেত্রে কোনো অজুহাত ছাড়াই প্রায়ই মারধোর করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থীই আমাদের সাথে অমানবিক আচরণ করে।
রকি জানায়, মাত্র ৫ হাজার টাকার বিনিময়ে আমার মতো অনেকের জীবন এখানে মাসিক চুক্তিতে বন্ধক রাখা হয়েছে। পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা ভাল না থাকার কারণে আমার মতো অনেকেরই এমন মানবেতর জীবন-যাপন সহ্য করতে হচ্ছে। আমি এই অবস্থা থেকে মুক্তি চাই, আমার শৈশব ফেরত চাই।
রকি আরও জানায়, আমার বয়সী অন্যদের মতো আমিও স্কুলে যেতে চাই। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে আরো বলে, ‘যদি আমি পড়ালেখা চালিয়ে যেতাম তাহলে হয়তো আমি এখন ক্লাস সেভেনে থাকতাম’।
এই গল্পটি মাত্র একজন রকির গল্প। রকির মতো প্রায় ৪০ জন শিশুশ্রমিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার বিভিন্ন ক্যান্টিনে কাজ করে। তাদের দেখেও যেন না দেখার ভান করছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কাজ করা এসব শিশু শ্রমিকের বেশিরভাগই চাঁদপুর ও কুমিল্লার।
করোনা মহামারির শুরুর দিকে ২০২০ সালের ১৮ মার্চ থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে সরকার। তবে সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় খোলার তোড়জোড় শুরু হয়েছে। হলসহ বিশ্ববিদ্যালয় খোলা হলে শিশুশ্রম আবার চালু হবে ব্যাপকভাবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এ এফ রহমান হলের ক্যান্টিন ম্যানেজার বাবুল হোসাইন বলেন, কম দামে খাবার বিক্রি করতে হয় বলে খরচ কমানোর বিষয়টি আমাদের লক্ষ্য রাখতে হয়। ফলে আমরা শিশুদের কম মজুরিতে কাজে নেই এবং তারা সেটা মেনে নিতে বাধ্য। এছাড়াও কম বয়সীরা অল্প মজুরিতে কাজ করলেও বয়স্করা বেশি মজুরি দাবী করে। তাই আমার শিশুদের কাজে নেই বেশি।
শিশু কল্যাণে নিয়োজিত আর্ন্তজাতিক বেসরকারী সংস্থা সেভ দ্যা চিলড্রেনের কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, আমার সরাসরি শিশুদের নিয়ে কাজ করিনা। তবে আমরা বিভিন্ন আঞ্চলিক সংস্থার কাজে কাজ করি। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই বিষয় নিয়ে আমাদের সরাসরি তেমন কোন করণীয় নেই। বরং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী এবং ছাত্রনেতাদের এই সমস্যা দূর করতে এগিয়ে আসতে হবে।
তিনি আরও বলেন, শিশুরাই আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ। তারা যদি অবহেলার শিকার হয় কেবল সরকার নয় বরং সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে যাতে এই সমস্যাকে প্রতিরোধ করা যায়।
আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, আমাদের দেশের আইন অনুসারে ১৪ বছরের নিচের কাউকে দিয়ে করানো যে কোন কাজই শিশুশ্রম বলে গণ্য হবে। এছাড়া ১৪ থেকে ১৮ বছর বয়েসিদের দিয়ে কাজ করানোকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছে। তাই যেকোন পরিস্থিতিতে খেয়াল রাখতে হবে যেন শিশুদের মানসিক বিকাশ ব্যহত না হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিশুশ্রমিকেরা কাজ করে এটি অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা। এখানে গণমাধ্যমের কাজ হলো এই ইস্যুতে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা। আমরা সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন কাজে শিশুদের নিযুক্ত করি না। কিন্তু ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে শিশুরা কাজ করছে এটা সত্য। তিনি আরও বলেন, এই বিষয়টি নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। আমরা ইতোমধ্যে এই বিষয়টির সমাদান নিয়ে চিন্তাভাবনা করছি।