কোরবানীর ঈদের পরপরই শুরু হয় আড়তদার এবং ট্যানারি ব্যবসায়ীদের সংগৃহিত কাঁচা চামড়া লবণ দিয়ে সংরক্ষণের দৌড়ঝাঁপ। কারখানার বা আড়তের নিয়মিত শ্রমিকদের সাথে চামড়া লবণজাত করার কাজে বদলি শ্রমিকরাও যোগ দেয়।
গতকাল বৃহস্পতিবার (২২জুলাই) আনুমানিক রাত ৯টা বাজে তখন। হেমায়েতপুর বিসিক ট্যানারি শিল্পাঞ্চল থেকে হেমায়েতপুর বাসস্ট্যান্ডের দিকে যাচ্ছি ঢাকার বাস ধরবো। হেমায়েতপুর ট্যানারি শিল্পাঞ্চল থেকে অটোতে উঠতেই দেখা পাওয়া গেলে এমন তিন তরুণের। এই তিন তরুণের মাঝে দুইজন গার্মেন্টস শ্রমিক আরেকজন উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী।
প্রথমবারের মতো ট্যানারিতে বদলি লবণজাত শ্রমিকের কাজ করতে এসেছেন তারা। বাড়ি যাওয়ার আগে একটু বাড়তি আয়ের আশায় ঈদের দিন বিকেল থেকে ঈদের দ্বিতীয় দিন বিকেল পর্যন্ত কাজ করেছেন তারা। বাড়তি পরিশ্রম করে প্রত্যাশিত বাড়তি আয়ের টাকা সাথে নিয়ে বাড়ি যাচ্ছেন, সেই আনন্দের ঢেউ চোখে-মুখেও।
বয়স হবে ১৬-১৮ বছর,বাড়ি নোয়াখালির শান্তির হাট সদরে। তিনজনের কাঁধে কাপড় বোঝাই ব্যাগ,চেহারায় ক্লান্তির ছায়া। দেখেই বোঝা যাচ্ছে,পরিপাটি হয়ে কোন লম্বা যাত্রার উদ্দেশ্যে বের হয়েছেন তারা। জিজ্ঞেস করতেই জানালো ঈদের ছুটিতে গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছেন তিনবন্ধু।
গার্মেন্টস শ্রমিক দুইজনের মাঝে, একজনের নাম মোহাম্মদ রাকিব। রাজধানীর এয়ারপোর্ট এলাকার কোন এক গার্মেন্টসে অফ ওর্ডারে কাজ করেন তিনি। ঈদের দিনে গার্মেন্টস ছুটি হলে এয়ারপোর্ট থেকে হেমায়েতপুর চলে এসেছেন চামড়া লবণজাত করতে। এক রাতেই উপার্জ ন হয়েছে নগদ চার হাজার টাকা। রাকিবের ভাষ্যমতে, ‘আমি এয়ারপোর্ট থাইকতাম। এয়ারপোর্টেত্যে হেমায়েতপুর আছছি চামড়ার কাজ কইত্যাম। একরাত চামড়ার কাজ কইচ্ছি, এইবার দেশে যাইতাম। আবার দেশেত্যে ঈদের পর এয়ারপোর্ট যামু। বুঝেনতো একরাইতের চাইর হাজার টাকা ইনকাম এই সময়ে অনেককিছু।’
তিনবন্ধুর মাঝে একজন উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী, নাম মোহাম্মদ রিয়াজ হোসেন ট্যানারিতে কন্ট্রাক্টরির কাজ করেন। এক বড় ভাইয়ের মাধ্যমে লবণজাত কাজ করতে এসেছে সে। রিয়াজ লবণজাত চামড়া হিসেব রাখার কাজ করেছেন ঈদের দিন রাতে। রিয়াজের সাথে কথা বললে সে জানায়, ‘করোনায়তো সবার অবস্থা খারাপ, একরাত কাজ করছি। লকডাউন না থাকলে তিন-চার দিন করতাম। আজকে না গেলেতো আর যাওয়া হবে না।একদিন কাজ করেই মাসের হাতখরচটা হয়ে গেলো আরকি এইটাই আনন্দ। দুইদিন পরে না হয় ঈদ করলাম আমরা।’
এছাড়া হেমায়েতপুর ট্যানারিতে চামড়া সংরক্ষণে দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন ট্যানারি শ্রমিকরা। বাংলাদেশের মোট চামড়ার অর্ধেকের বেশি আসে কোরবানীর মৌসুমে। ফলে ট্যানারি আড়ত এবং কারখানায় বিপুল পরিমাণ বাড়তি শ্রমিকের প্রয়োজন হয়।
শ্রমিকদের অনেকেই রাত জেগে কয়েক শিফটে ভাগ হয়ে করছে কাঁচা চামড়া লবণজাত, ট্রাক থেকে লোড-আনলোডের কাজ৷ একাধিক শ্রমিকের সাথে কথা বলে জানা যায় রক্তমাখা কাঁচা চামড়া লবণজাত, পরিবহণ এবং লোড-আনলোডের লাগাতার কাজে তারা দম ফেলার সময় পাচ্ছে না।
এই অপেশাদার মৌসুমি বদলি শ্রমিকদের অধিকাংশই গার্মেন্টস শ্রমিক,রিক্সা চালক, স্থানীয় কৃষক এবং স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী। যারা রোজ বা ঘন্টা হিসেবে কাজ করে একদিনে ৪-৬ হাজার টাকা আয় করে এই সময়ে। রাজধানীর পোস্তাগোলা,আমিনবাজার,হাজারিবাগ এবং হেমায়েতপুর ট্যানারিতে ঈদের পর বাড়তি চামড়া সংগ্রহ এবং সংরক্ষণের এই মৌসুমে তাদের সন্ধান মেলে।