পদ্মা সেতু নির্মাণে প্রকৌশলীদের প্রতিবন্ধকতা, নদী শাসন ঠিক রাখার পাশাপাশি লড়তে হয়েছে অনেক বাধা বিপত্তির বিরুদ্ধে। শুরুতে সেতুর অর্থায়নে বিশ্বব্যাংকের ‘না’ ও বিভিন্ন মহলের ষড়যন্ত্র সেতুর নির্মাণযজ্ঞকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করেছে বারবার। ফলে পদ্মা সেতুর নির্মাণ বাংলাদেশের জন্য এক সম্মান রক্ষার লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে। তবে সবচেয়ে ভয়াবহ হয়েছিল পদ্মা সেতুকে নিয়ে গুজব।
সেতুর পিলারে মানুষের মাথা লাগবে
পদ্মা সেতুকে লড়তে হয়েছে গুজবের সঙ্গেও। আর সেই গুজবের বলি হয়ে প্রাণ দিয়েছেন অনেকেই। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই তথ্য প্রচার করা হচ্ছিল। ২০১৯ সালে ‘ছেলেধরা’ গুজবে সারা দেশে ২১টি গণপিটুনির ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় প্রাণ হারান পাঁচজন। ছেলেধরা সন্দেহে ঢাকার মোহাম্মদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে দুজনকে পিটিয়ে হত্যা করে এলাকাবাসী। মোহাম্মদপুরে এক নারীকে একই সন্দেহে বেদম মারধর করা হয়। পুলিশ গিয়ে তাঁকে উদ্ধার করে।
এ ছাড়া লক্ষ্মীপুর জেলার দালাল বাজারে এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে পুলিশে দেয় জনতা। নেত্রকোনায় এক শিশুকে গলা কেটে হত্যা করে ব্যাগে করে মাথা নিয়ে যাওয়ার সময় সন্দেহভাজন যুবককে পিটিয়ে হত্যা করে স্থানীয়রা। আর এই খবর গণমাধ্যমে আসার পর নতুন করে শুরু হয় অপপ্রচার।
২০১৯ সালের ২০ জুলাই রাজধানীর বাড্ডা এলাকায় এক নারীকে ‘ছেলেধরা’ সন্দেহে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। ওই দিন সকালে রাজধানীর উত্তর বাড্ডায় মেয়েকে ভর্তি করানোর তথ্য জানতে স্থানীয় একটি স্কুলে যান তাসলিমা বেগম রেনু (৪০)। এ সময় তাঁকে ছেলেধরা সন্দেহে প্রধান শিক্ষকের রুম থেকে টেনে বের করে গণপিটুনিতে হত্যা করা হয়।
একই সময়ে কেরানীগঞ্জের হজরতপুর ইউনিয়নের রসুলপুর গ্রামে ‘ছেলেধরা’ সন্দেহে অজ্ঞাতপরিচয় দুই যুবককে গণপিটুনি দেওয়া হয়। এ ঘটনায় একজনের মৃত্যু হয়। পুলিশের ভাষ্য, রসুলপুর গ্রামে শরীফ মিয়ার বাড়ির সামনে দুই যুবক ঘোরাফেরা করতে থাকেন। এলাকাবাসীর সন্দেহ হলে তাঁদের ঘোরাফেরার কারণ জিজ্ঞাসা করা হয়। দুই যুবক ঠিকঠাক উত্তর দিতে না পারায় এলাকাবাসী ক্ষিপ্ত হয়ে তাঁদের পিটুনি দেয়। তাঁদের একজন মারা যান।
যেভাবে গুজব ছড়ায়
২০১৫ সালের ১ মার্চ নদীতে পশুর রক্ত ঢেলে পদ্মা সেতুর ভিত্তি স্থাপনকাজের উদ্বোধন করে চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি। মুন্সীগঞ্জের মাওয়ায় মূল সেতুর পরীক্ষামূলক ভিত্তি স্থাপনের সময় নদীতে গরু ও খাসির রক্ত ঢালতে দেখা যায় চাইনিজ ওই প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের। ভাসিয়ে দেওয়া হয় কয়েকটি মুরগিও। তাদের বিশ্বাস, বড় কাজের শুরুতে পশু উৎসর্গের মাধ্যমে স্রষ্টার সন্তুষ্টি লাভ করা যায়, এড়ানো যায় বড় দুর্ঘটনা।
তখন গণমাধ্যমেও এ নিয়ে সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। সেই সময়ের রক্তের ছবিই ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দিয়েছিল অসাধু ফেসবুক ব্যবহারকারীরা। মূল তথ্য আড়াল করে পুরোনো সেই ছবিকে মানুষের রক্তের ছবি বলে প্রচার করতে থাকে তারা।
ভারতীয়দের পদ্মা সেতু আক্রমন
পদ্মা সেতুর আশেপাশে বিভিন্ন সময়ে ভারতীয়রা আক্রমন করতে পারে বলে গুজব ছড়িয়ে পড়ে। ভারতীয় বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা এ নিয়ে কাজ করছে বলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন গুজব উঠে আসে।
মূলত এটি কয়েকজন ভবঘুরে ভারতীয় নাগরিককে আটককে ঘিরে এমন গুজবের সৃষ্টি হয়। ২০১৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর প্রথম সন্দেহভাজন এক ভারতীয়কে আটক করা হয়। এরপর ২০২০ সালে আটক করা হয় আরও ১১ জনকে। সর্বশেষ ২০২২ সালে ২ জুনকে আটক করা হয়। সবমিলিয়ে পদ্মা সেতুর আশেপাশে সর্বমোট ১৪ জন ভারতীয় নাগরিককে আটক করা হয়। এ নিয়ে ভারতীয় হাই কমিশন কোন মন্তব্য করেনি। তবে আটককৃতদের মধ্যে ৪ জন মানসিক রোগের চিকিৎসা নিয়েছিল। তারা কেন বাংলাদেশে আসলো এর কোন সদুত্তর দিতে পারেনি। অনেকেই ভবঘুরে ও আশে পাশে বিভিন্ন মেলায় ঘুরতে এসেছে বলে জানায় সংশ্লিষ্টরা।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠান বাতিল
গত ৫ ই জুন চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডের বি এম ডিপোতে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের পর গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়েছে। এ দিয়ে অগ্নিকান্ডে ক্ষতিগ্রস্তদের চিকিৎসা করা হবে। এরপর সিলেট ও সুনামগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতি অবনতি ঘটায় এমন গুজব আবারও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তবে মূলত কোন কারনেই পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান বাতিল হয়নি। তবে বন্যা পরিস্থিতি সামাল দিতে উদ্বোধনের পর ৫ দিনব্যাপী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ৩ দিন করা হয়েছে।
গুজব কেন ছড়িয়েছে
পদ্মা সেতু নিয়ে বিভিন্ন সময়ে যেসব গুজব ছড়িয়েছে, সেগুলোর অধিকাংশই বিশ্বাসযোগ্য দলিল ছাড়াই ছড়িয়েছে। এর পেছনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয় একটি মহল উদ্দেশ্যমূলকভাবে কাজ করেছে। তবে এসব গুজব ছড়ানোর জন্য আবহমান কাল ধরে চলে আসা জনশ্রুতি এবং স্থানীয় সংস্কৃতিতে প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন গল্পের ওপর বিশ্বাস করার প্রবণতাও দায়ী।
প্রধানমন্ত্রীর সতর্কবার্তা
পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলেও ভবিষ্যতেও এ রকম গুজব ছড়াতে পারে বলে মনে করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পদ্মা সেতু নিয়ে যেকোনো গুজব ঠেকাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কঠোর নজরদারি করার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। গত ১৪ জুন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে নিরাপত্তাসংক্রান্ত জাতীয় কমিটির বৈঠকে এ নির্দেশনা দেন তিনি।