সমগ্র বিশ্বে মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব হচ্ছে ঈদ। বছরে দুটি ঈদ- একটি ঈদ-উল ফিতর, অন্যটি ঈদ-উল আযহা- যাকে কোরবানীর ঈদও বলা হয়।পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্মে যেসব প্রধান ধর্মীয় উৎসব উদযাপিত হয়ে থাকেম, তার মধ্যে ঈদুল ফিতর হচ্ছে সময়ের মাপে কনিষ্ঠতম, তবে আয়োজনে প্রয়োজনে ব্যাপকতর।
বাংলাদেশের মুসলমানরাও ঈদ-উল ফিতরকে সবচেয়ে বড় উৎসব হিসেবে বিবেচনা করে। এই সময়টিতে বাংলাদেশে ব্যাপক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চলে।ব্যবসায়ীদের তথ্যমতে সারা বছরে যত পণ্য আর সেবা কেনাবেচা হয়, তার বড় অংশটি হয় এই সময়ে।
ইসলামের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব হলেও এই ধর্মের আবির্ভাবের সাথে সাথেই কিন্তু ঈদের প্রচলন শুরু হয়নি। ঈদ-উল আযহা কখন আর কোন প্রেক্ষাপটে চালু হয়েছিল তা ইতিহাস থেকে জানা যায়। কিন্তু ঈদ-উল ফিতর কখন আর কিভাবে প্রচলিত হয়েছিল, সে সম্পর্কে তথ্য কমই জানা যায়।
ইসলাম ধর্মে কখন চালু হয়েছিল ঈদ
আজ থেকে ১ সৌর বছর আগে থেকে প্রায় ১৪০০ সৌর বছর আগে থেকে মহান ও পুণ্যময় ঈদ উৎসবের শুরু হয়।ইসলামের শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (স) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করার পর থেকেই ঈদুল উৎসব শুরু হয়। আরবদের ইহুদি ধ্যানধারণা ও জাহেলি প্রথার পরিবর্তে দুই ঈদ ছিল আল্লাহর রাসূলের পক্ষ থেকে মুসলমানদের ঘোষিত উপহার। এর আগে পৌত্তলিত ভঅবনায় অগ্নিপূজকদের নওরোজ এবং মূর্তিবাদীদের মিহিরজান নামে দুটি উৎসব মদিনাবাসী উদযাপন করতেন। এই দুটি উৎসব সেখানকার বাসিন্দাদের ধর্ম এবং গোত্রের রীতি অনুযায়ী একটি শরতে এবং আরেকটি বসন্তকালে উদযাপিত হত।
ওইসময় আরবরা কুরুচিপূর্ণ ওকাজ মেলায় আদিম উচ্ছ্বলতায় মেতে উঠতো। ওইগুলো ছিলো উচ্চবিত্তের খেয়ালিপনার উৎসব। এর পরিবর্তে জন্ম নিলো শ্রেণিবৈষম্য-বিবর্জিত, পরিঙ্কলতা ও অশালীনতামুক্ত ইবাদতের আমেজমাখা সুনির্মল আনন্দে ভরা ঈদ আনন্দ।
ইসলামের ইতিহাস বিষয়ক গবেষক এবং বিশেষজ্ঞদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ৬২৩ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ঈদ উদযাপন করা হয়েছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের(ঢাবি) ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক মো. আতাউর রহমান মিয়াজী বিবিসি বাংলাকে বলেন, হিজরী দ্বিতীয় সনে ঈদের প্রবর্তন করা হয়েছিল।
হজরাত মুহাম্মদ (স) যখন মক্কা থেকে ৬২২ খ্রিস্টাব্দে হিজরত করে মদিনায় যান, তখন সময়কে ভিত্তি ধরে হিজরী সাল গণনা করা হয়। আনুষ্ঠানিকভাবে অবশ্য হিজরী সাল গণনা শুরু করা হয়েছিল আরও ১৭ বছর পরে, খলিফা উমরের সময়ে।
অধ্যাপক মিয়াজী আরও বলেন, "হিজরী প্রথম বছরের অষ্টম মাস অর্থাৎ শাবান মাসে রোজা বাধ্যতামূলক করার আয়াত নাজিল হয়, এবং তখন নবম মাস অর্থাৎ রমজান মামে একমাস সিয়াম সাধনাকে ফরজ করা হয়।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক আরও বলেন, “এরপর হিজরী দ্বিতীয় সালে এসে বিধান দেয়া হয় যে রমজান মাস-চাঁদের হিসাবে যা ২৯ দিনেও শেষ হতে পারে বা কখনো ৩০ দিনেও শেষ হতে পারে - শেষে শাওয়াল মাসের প্রথম দিন ঈদ উদযাপন করা হবে।ঈদের সামাজিকতা ওই সময় থেকে শুরু হয়।”
মদিনায় হিজরতের সময় নওরোজ এবং মিহিরজান নামে দুটি উৎসব - যেগুলো সেখানকার বাসিন্দাদের ধর্ম এবং গোত্রের রীতি অনুযায়ী একটি শরতে এবং আরেকটি বসন্তকালে উদযাপিত হত।
অধ্যাপক মিয়াজী বলেছেন, তখন ওই দুইটি উৎসবের আদলে মুসলমানদের জন্য বছরে দুইটি ধর্মীয়, সামাজিক এবং জাতীয় উৎসব পালনের রীতি প্রবর্তন করা হয়। েঈদের প্রচলন নিয়ে এর বাইরে আর কোন বক্তব্য বা ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না।
ঈদ উদযাপন মদিনায় শুরু হলেও পরবর্তীতে পুরো দুনিয়ায় মুসলমানদের মধ্যে তা ছড়িয়ে পড়ে এবং প্রচলিত হয়ে যায় ঈদ পালন। কালক্রমে অঞ্চল ভেদে এই উৎসবে ভিন্ন ভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা যুক্ত হয়।
কীভাবে পালন হতো প্রথম যুগের ঈদ?
আরবী ঈদ শব্দের মানে খুশি, আনন্দ বা উৎসব। মুসলমানদের জন্য ঈদ পালন ওয়াজিব অর্থাৎ অবশ্য পালনীয়। ঈদ পালনের কিছু নিয়ম ইসলামে নির্দিষ্ট করা আছে। এর মধ্যে প্রধান হচ্ছে ঈদের দিন সকালে দুই রাকাত নামাজ আদায় করা, যা সব মুসলমানের জন্য অবশ্য পালনীয়।
এছাড়া ঈদ-উল ফিতরে ফিতরা প্রদান করাও একটি অবশ্য পালনীয় রীতি। ফিতরা ঈদের নামাজের আগে অসহায় গরিব-দুঃখীদের দিতে হয়।অধ্যাপক মিয়াজী বলেন, যখন প্রথম ঈদের প্রচলন চালু হয়, তখন এখনকার ঈদের মতো আতিশয্য ছিল না। নবী মুহাম্মদ (স) ঈদের দিনে গোসল করে উত্তম পোশাক পরে নামাজ পড়তে যেতেন। ঈদের নামাজের পর মিষ্টি দ্রব্য খাওয়া এবং আত্মীয় পরিজন, প্রতিবেশী বন্ধুদের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময়ের রেওয়াজ ছিল।
বাংলায় ঈদ উদযাপন
প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেছেন, “দেড়শ' বছর আগেও এ অঞ্চলে সাধারণের মধ্যে ঈদ তেমন বড় কোন উৎসব ছিল না।”
বিবিসি বাংলাকে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, “ফরায়েজী আন্দোলনের নেতা হাজী শরীয়তুল্লাহর সময় বঙ্গে উৎসব করে ঈদ উদযাপনের চল শুরু হয়। তার আগে এখানে মুসলমান ছিলেন অনেক, কিন্তু তাদের রীতি-নীতির মধ্যে লোকায়ত ধর্মের মিল ছিল বেশি। যে কারণে ওই সময়ে ঈদ উদযাপনের তথ্য তেমন পাওয়া যায় না।”
১৬১০ সালে মুঘলরা ঢাকায় এসেছিলেন। তখন তাদের পাঠানো নায়েব-নাজিমরা ঈদ উদযাপন করতেন বলে বিবিসিকে জানান অধ্যাপক মামুন।
অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন আরও বলেন, "ঈদের চাঁদ উঠলে তারা আনন্দ-উৎসব শুরু করতেন। কামান দাগা হত। ঈদের দিন তারা একসঙ্গে নামাজ পড়তেন, নামাজ পড়ে ফেরার পথে হাতি বা ঘোড়ার পিঠ থেকে তারা সাধারণ মানুষের দিকে পয়সা ছুঁড়ে দিতেন। ঈদ তাদের নিজেদের মধ্যেই উদযাপিত হত, সাধারণ মানুষের তার সাথে সংযোগ ছিল না।"
তিনি আরও বলেন, “মুঘলদের তৈরি ঈদের একটা প্রতীক এখনো ঢাকায় আছে, সেটি হচ্ছে ধানমন্ডি ঈদগাহ।”
ঢাকাকেন্দ্রীক ঈদ উৎসব
অদ্যাপক মামুনের মতে, এর আগে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে রোজা বা ঈদ উদযাপনের তেমন চল ছিল না, সেই সাথে তাদের অর্থনৈতিক অবস্থাও ভালো ছিল না।
উনিশ শতকের গোঁড়ার দিকে যখন এ অঞ্চলে মুসলমানের সংখ্যা বাড়তে থাকে, তখন ঈদ পালনও বাড়তে থাকে বলে উল্লেখ করা হয় বিভিন্ন ইতিহাসবিদের লেখায়।
এক সময় দিল্লির মুঘলদের অনুকরণে ঢাকায় ঈদের মিছিল হতো বলেও জানান ঢাবি’র এই অধ্যাপক।
ইতিহাসবিদদের মতে, বর্তমানে ঈদ যেমন ব্যাপক উৎসবের আকার পেয়েছে, তার শুরুটা হয়েছিল। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র হবার পর - যা বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আস্তে আস্তে বিস্তৃত হতে থাকে। তার আগে, ঈদ উদযাপনের কেন্দ্র ছিল ঢাকা। আনুষ্ঠানিকতার প্রায় পুরোটাই ছিল ঢাকা-কেন্দ্রীক, যে কারণে ঐতিহাসিক বর্ণনায় ঢাকার ঈদ সম্পর্কেই জানা যায়।
১৮৮৫ সালে ঐতিহাসিক জেমস ওয়াইজের লেখা উল্লেখ করে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, “সেই সময় গ্রামাঞ্চলে ঈদের উদযাপন একেবারে কম ছিল - এমনকি অনেক জায়গায় ঈদের নামাজ কিভাবে পড়তে হয়, তা-ও অনেকে সঠিকভাবে জানতেন না।মসজিদের সংখ্যাও সে সময়ে কম ছিল।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক আরও বলেন, “এখন ইসলাম সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান যেমন বেড়েছে, তেমনি মুসলমানের সংখ্যাও বেড়েছে, ফলে ঈদ উদযাপনের পরিধিও বেড়েছে। বর্তমানে যেভাবে ঈদ দেশজুড়ে বড় একটি উদযাপনে পরিণত হয়েছে, তার একটা বড় কারণ ঈদকে ঘিরে তৈরি হওয়া অর্থনীতি।”