আগস্ট ১৮, ২০২২, ১২:২৫ এএম
রাজধানীতে অগ্নিকাণ্ডে বছরে শত শত মানুষ মারা যাচ্ছেন। এই অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে নিরাপদ ও কার্যকর ব্যবস্থার নাম 'ফায়ার হাইড্রেন্ট'। রাস্তার পাশে ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপনের সুপারিশ করে আসছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর। কিন্তু আজও নগরীর কোথাও ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপন হয়নি। এর জন্য ফায়ার সার্ভিস দুষছে সিটি করপোরেশনকে। আবার সিটি করপোরেশন দায়ী করছে ঢাকা ওয়াসাকে। এমতাবস্থায় রাজধানীতে আগুন নেভানোর দায় কার? ফায়ার সার্ভিস, সিটি করপোরেশনের নাকি ওয়াসা কর্তৃপক্ষের।
'ফায়ার হাইড্রেন্ট' হচ্ছে অগ্নি দুর্ঘটনার হাত থেকে নিরাপদ ও কার্যকর ব্যবস্থার নাম। এটি মূলত রাস্তার ধারে স্থাপন করা এক ধরনের পানির কল। আর এই কল থেকে অগ্নিকান্ড ঘটলে জরুরি পানি সরবরাহ করা যায়। বিশ্বের প্রায় সব শহরে অগ্নি দুর্ঘটনা রোধে এ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীতে ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপনের দায়-দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। তবে প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেও এটি ব্যয়বহুল হওয়ায় স্থাপনে কালক্ষেপণ করে চলেছে সিটি করপোরেশন। বিপুল অর্থ খরচ হবে অথচ রাজস্ব আয় আসবে না-মূলত এ চিন্তাধারা থেকেই ‘ফায়ার হাইড্রেন্ট’ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে না সিটি করপোরেশন। তাই এতে একে অপরের ওপর বিভিন্নভাবে দায় চাপিয়ে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে।
ফায়ার সার্ভিস সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজধানীতে অগ্নিকাণ্ডে প্রতিবছর শত শত মানুষ মারা গেলেও সুষ্ঠু সমাধান আসছে না। অগ্নিকাণ্ডে প্রাণহানির পর নড়েচড়ে বসেন সরকারের ঊদ্ধর্তন কর্মকর্তা থেকে সংশ্লিষ্ট সংস্থা। ফায়ার সার্ভিস গঠন করে তদন্ত কমিটি। বেরিয়ে আসে নানান ত্রুটি-বিচ্যুতি। কিন্তু এসব ত্রুটি-বিচ্যুতির কোনো সুরাহ হচ্ছে না। আগুন লাগার ঘটনা কমাতে ফায়ার সার্ভিস যেসব সুপারিশ করছে সেগুলো কোনোভাবেই আলোর মুখ দেখছে না। এভাবে চলতে থাকলে পুরান ঢাকায় চুড়িহাট্টা কিংবা নিমতলীর মতো ঘটনা বারবার হতে পারে।
জানা গেছে, ২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলী আগুনে ১২৪ জনের মৃত্যু হয়। নিমতলীর দুই বছর পর তাজরীন ফ্যাশনে আগুনে পুড়ে মারা যায় ১১৭ জন। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের হাসেম ফুড কারখানায় ৫১ জন। ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ৭১ জন, একই বছরের ২৮ মার্চ বনানী এফআর টাওয়ারে ২৭ জন, চট্টগ্রাম সীতাকণ্ডে বিএম কন্টেইনার ডিপোতে ৪৯ জন, গাজীপুরে ট্যাম্পকো ফয়েলস প্যাকেজিং কারখানায় ৩১ জন, কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়া প্লাস্টিক খারখানায় ১৭ জন, মগবাজার দোকানে ১২ জন এবং সর্বশেষ চলতি বছরের ১৫ আগস্টে লালবাগ পলিথিন কারাখায় অগ্নিকাণ্ডে ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। মাত্র কয়েক বছরে এসব অগ্নিকাণ্ডে মোট ৫০৫ জন মারা গেলেও হাজার হাজার মানুষ দগ্ধ হয়েছেন।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় আগুন লাগার ঘটনায় ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ কমানো সম্ভব এমন মন্তব্য করে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের ঢাকার উপ-পরিচালক দিনমনি শর্মা দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, “পুরান ঢাকা ঘনবসতি এলাকা সরু রাস্তা। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে সরু রাস্তা দিয়ে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি দ্রুত যেতে পারে না। সেজন্য এখানকার সব রাস্তা ও গলিপথে নির্দিষ্ট দূরত্বে স্ট্রিট হাইড্রেন্ট বসানোর সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু কোনো সুপারিশ কাজ হয়নি।”
তিনি বলেন, রাজধানীতে রাস্তার ওপর ফায়ার হাইড্রেন্ট বসানোর দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। এটি ফায়ার সার্ভিস অধিদপ্তর করতে পারে না। কিন্তু সিটি করপোরেশন হাইড্রেন্ট বসানোর কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না। আমাদের পাশের দেশ ভারতে রাস্তার মোড়ে মোড়ে ফায়ার হাইড্রেন্ট বসানো রয়েছে। অথচ আমাদের দেশে রাস্তার কোথাও ফায়ার হাইড্রেন্ট নেই। কোনো এলাকায় আগুন লাগলে স্থানীয় ভবনের রির্জাভ টাংকি থেকে পানি নিয়ে আগুন নেভাতে হয়। পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ নিয়ে ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের মাঝে এক ধরনের সংশয় কাজ করে। এতে কাজের ক্ষেত্রে চাপের মুখে থাকতে হয় আমাদের। কারণ ফায়ার সার্ভিসের তো পানি দরকার।
অগ্নিকাণ্ডে ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনতে ফায়ার হাইড্রেন্ট বসাতে ফায়ার সার্ভিস বহুবার সুপারিশ করেছে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কাছে। কিন্তু কোনো সুপারিশ আলোর মুখ দেখেনি বলে মনে করেন
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ সিরাজুল ইসলাম বলেন, “অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ কমাতে রাস্তায় ফায়ার হাইড্রেন্ট বসাতে হবে এমন সুপারিশ ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে কখনই পরিকল্পনা দপ্তরে আসেনি। পরিকল্পনা বিভাগে সুপারিশ এলে ফায়ার হাইড্রেন্ট নিয়ে চিন্তাভাবনা করা হতো। তবে আগামীতে পুরো ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নিয়ে মহাপরিকল্পনা চলছে। যা চলতি বছরের ডিসেম্বর নাগাদ প্রকাশ পেতে পারে। তখন ফায়ার হাইড্রেন্টের ইস্যু নিয়ে আলোচনা করা হবে।”
নিমতলী ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর ফায়ার সার্ভিস থেকে বেশকিছু সুপারিশ করা হয়। এসব সুপারিশের মধ্যে বলা হয়েছে- আবাসিক এলাকায় কেমিক্যালের দোকান ও কারখানা বা গুদাম করা যাবে না, পুরান ঢাকায় গাড়ী চলাচলে ১৮ ফুট রাস্তা প্রসস্থ করতে হবে, স্বেচ্ছাসেবক কর্মী গঠন করতে হবে। প্রতিটি ভবনে পানির রির্জাভ ফায়ার সার্ভিস ব্যবহারের উপযোগী করে নির্মাণ করতে হবে।
নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, রাজধানী ঢাকা পরিকল্পিতভাগে গড়ে উঠেনি। ফলে একই এলাকায় বাণিজ্যিক ও আবাসিক ভবন গড়ে উঠেছে। বাণিজ্যিক ভবনে কেমিক্যাল গোডাউন করা হচ্ছে। এতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা বাড়ার সঙ্গে মানুষের প্রাণহানি ঘটছে। তবে রাস্তায় ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপন করা হলে আগুনে ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ কমানো যেত। কিন্তু যেসব সংস্থা ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপন করবে সেসব সংস্থার ভেতরে দুর্নীতির আখড়া। এ কারণে ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপনের পরিকল্পনা করলেও সেটা বাস্তবায়ন হচ্ছে না।”
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মুখপাত্র মকবুল হোসেন দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, রাস্তার ওপর ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপনের পরিকল্পনা নেই সিটি করপোরেশনের। কারণ ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপন করলেই হবে না, পানির চাপ থাকতে হবে। ফায়ার হাইড্রেন্টের জন্য ঢাকা ওয়াসা পানি সরবরাহ করতে পারবে না। আর পানির সরবরাহ কিংবা পানির চাপ বাড়ানোর এখতিয়ারও সিটি করপোরেশনের নেই। সুতরাং হাইড্রেন্টের প্রয়োজনীয়তা থাকলেও দুটি সংস্থার সাংঘর্ষিক ইস্যু রয়েছে।
তবে ঢাকা ওয়াসার উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ) এ কে এম সহিদ উদ্দিন দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলছেন, সিটি করপোরেশন রাস্তার ওপর ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপন করতে পারলে ঢাকা ওয়াসা পানি সরবরাহের চেষ্টা করবে। তবে এ নিয়ে সংস্থাগুলোকে একত্রে বসতে হবে। কারণ পানি সরবরাহ কিভাবে করা হবে সেটির দীর্ঘ পরিকল্পনার দরকার রয়েছে।