আজ ২৮ সেপ্টেম্বর, বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবস। ‘জলাতঙ্ক : ভয় নয়, সচেতনতায় জয়’ প্রতিপাদ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ পালন করছে দিবসটি। বাংলাদেশেও দিবসটি পালিত হচ্ছে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ একটু উন্নতির দিকে যাওয়ায় দেশে এখন আর লকডাউন বা বিধিনিষেধ নেই। বেড়েছে মানুষের যাতায়াত। আর এরই সুবাদে কুকুরের হামলার শিকার ও জলাতঙ্কে আক্রান্ত হওয়া রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেছে। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত সময়ে ৩০ জন জলাতঙ্ক রোগে মারা গেছেন। ২০২০ সালে এই সংখ্যা ছিল মাত্র ২৬ ।
বছরে কুকুরের হামলার শিকার ২ লাখের বেশি লোক
প্রাচীনকাল হতে সংঘটিত সর্বাপেক্ষা ভয়ংকর সংক্রামক রোগ হচ্ছে জলাতঙ্ক। প্রধানত: কুকুর হতে (৯৫% এর অধিক ক্ষেত্রে) জলাতঙ্ক রোগের সংক্রমণ ঘটে। তবে শিয়াল, বিড়াল, বেজী, বানর এমনকি আক্রান্ত গবাদি প্রাণী হতেও এ রোগ মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীতে সংক্রমিত হতে পারে। জলাতঙ্ক শতভাগ বিপজ্জনক।
দেশে প্রতি বছর কুকুরে কামড়ানো রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। কুকুর মানুষকে সহজে কামড়ায় না। প্রয়োজন ছাড়া আঘাত করাসহ ভয় পাওয়ার কারণেই কুকুরের আক্রমণের সংখ্যা বাড়ছে বলে জানায় সংশ্লিষ্টরা।
কুকুরের আক্রমণের শিকার ও জলাতঙ্কে আক্রান্ত রোগীর চিত্র।
চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত ৮ মাসেই ১ লাখ ৮৫ হাজার ৭৪৯ জন কুকুরের হামলার শিকার হয়েছেন। ২০২০ সালে লকডাউন থাকার প্রভাবে ১ লাখ ৫২ হাজার ১৪ জন আক্রমণের শিকার হয়। ২০১৯ সালে ২ লাখ ৫৩ হাজার ৮৬১ জন, ২০১৮ সালে ২ লাখ ৫৩ হাজার ৪০৯ জন, ২০১৭ সালে ২ লাখ ৫৮ হাজার ৪৪৫ জন কুকুরের কামড়ের শিকার হয়েছেন। তবে কুকুরের হামলার সর্বোচ্চ রেকর্ড হয় ২০১৬ সালে। ওই ব্যছর সর্বোচ্চ ২ লাখ ৯৮ হাজার ৭৭২ জন কুকুরের হামলার শিকার হন।
মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে
জলাতঙ্ক মরণব্যাধী। এই রোগ হলে মৃত্যু অবধারিত। তবে কুকুর বা জলাতঙ্কবাহী প্রাণীর আক্রমণের শিকার হলে দ্রুত প্রতিষেধক নিলে এই রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। করোনা মহামারীকালে কঠোর বিধিনিষেধে জলাতঙ্কে মৃত্যুর সংখ্যা কমে ২৬ জন হয়েছিল। কিন্তু চলতি বছর থেকেই এই সংখ্যা আবারও বাড়তে শুরু করে। চলতে বছরের আগস্ট পর্যন্ত ৮ মাসেই প্রায় ৩০ জন জলাতঙ্কে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। গত কয়েক বছরের পরিসংখ্যান ঘেটে দেখা যায়, জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত হয়ে ২০১৮ সালে ৫৪ জন মারা গেছেন। ২০১৯ সালে ৫৭ জনে এসে দাঁড়ায়। তবে আগের তুলনায় জলাতঙ্কে মৃত্যুর সংখ্যা কমেছে। ২০১১ সালে ১২৮ জন মারা গেলেও ২০১২ সালে মৃত্যু হয় ৮২ জনের। তবে ২০১৪ সালে মৃত্যুর সংখ্যা কিছুটা বেড়ে যায়, ১০৬ জন। এরপর ধীরে ধীরে আবার কমিয়ে আনা সম্ভব হয়।
২১ লাখ কুকুরকে দেয়া হয়েছে টিকা
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা(এসডিজি) ৩.৩ নম্বর লক্ষ্য অনুসারে, আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে জলাতঙ্ক মুক্ত বিশ্ব গড়ার কথা। কিন্তু এখনো দেশে বছরে ৫০ জনেরও বেশি লোক মারা যাচ্ছে এই রোগে। এ ছাড়া জলাতঙ্ক রোগীর সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ায় তৃতীয় সর্বোচ্চ।
রাজধানীর মহাখালীর সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের জুনিয়র কনসালটেন্ট (মেডিসিন) সুলতান মাহমুদ সুমন বলেন, ‘জলাতঙ্ক হলে মৃত্যু অবধারিত এবং তার থেকেও রোগ ছড়াতে পারে। এ ধরনের রোগী এলে আইসোলেশনে রেখে শান্তিপূর্ণ মৃত্যু নিশ্চিত করা ছাড়া আমাদের অন্য উপায় নেই। তবে কুকুরের হামলার শিকার রোগীকে দ্রুত টিকা প্রদান করা হয়।’
জেলায় কুকুরদের টিকা প্রদানের পর্যায়ের চিত্র।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দেশে ইতোমধ্যে ২১ লাখ ৩৮ হাজার ৬৩৯ টি কুকুরকে প্রথম ডোজ জলাতঙ্ক নিরোধক টিকার প্রথম রাউন্ড প্রদান করা হয়েছে। ৬৪ টি জেলায় প্রথম রাউন্ড দেয়া হলেও দ্বিতীয় রাউন্ড দেয়া হয়েছে মাত্র ১৬ জেলায়। আর তৃতীয় রাউন্ড দেয়া হয়েছে ৬ জেলায়।
কুকুর নিধন বা অপসারণ নিষেধ
২০৩০ সালের মধ্যে জলাতঙ্ক মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে সিডিসি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ও স্থানীয় সরকার বিভাগসহ সব দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সহযোগী সংস্থা কাজ করছে। তবে ২০১২ সালে উচ্চ আদালত নির্বিচারে কুকুর নিধনকে অমানবিক উল্লেখ করে তা বন্ধের নির্দেশ দেন। ওই বছরের ২৩ নভেম্বর) বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম ও বিচারপতি মোহাম্মদ আলীর হাইকোর্ট বেঞ্চ এই আদেশ দেন। এরপর বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে সরকারের পক্ষ থেকে কুকুরকে বন্ধ্যা (প্রজননক্ষমতা নষ্ট করে দেওয়া) করে তাদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ঘোষণা দেওয়া হয়। ২০১৯ সালের প্রাণিকল্যাণ আইনের সপ্তম ধারায়ও বলা হয়েছে, মালিকবিহীন কোনো প্রাণীকে নিধন বা অপসারণ করা যাবে না।