বিশ্বব্যাংকের সাথে বাংলাদেশের অংশীদারীত্বের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ১ মে ওয়াশিংটন ডিসি'র সদর দপ্তরে আয়োজিত অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওই অনুষ্ঠানে যোগদান বিশ্বব্যাংকের জন্য একটি বিশেষ অর্থবহন করে। কারণ, এই বিশ্বব্যাংকই কথা দিয়ে শেষ পর্যন্ত পদ্মা সেতু থেকে প্রতিশ্রুত সহায়তা প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। এরপর নিজের দৃঢ় মনোবল দিয়ে দেশের নিজস্ব অর্থায়নে স্বপ্নের সেই পদ্মা সেতু নির্মাণ করেছেন শেখ হাসিনা।
সেতুটি নির্মাণ করে এটির উদ্বোধনের ১১ মাসের মাথায় ওয়াশিংটনের ওই অনুষ্ঠান যোগদান করলেন শেখ হাসিনা। এটি যেনো বিশ্বব্যাংককে মোক্ষম একটি জবাবও শেখ হাসিনার। বিশ্লেষকদের অনেকে বলছেন, শেখ হাসিনা ওই অনুষ্ঠানে গেলেন, সবার করতালির মধ্য দিয়ে সবকিছু জয় করলেন আর বীরের বেশে যেন বিশ্বব্যাংক সদর দপ্তর থেকে ফিরে এলেন।
গোটা অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনার হাস্যোজ্জ্বল ওই উপস্হিতি দেশবাসী ও প্রবাসীদের মনেও দাগ কেটেছে।
এদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট ডেভিড ম্যালপাসকে নির্মাণ সম্পন্ন হওয়া পদ্মা সেতুর একটি রেপ্লিকা ও স্থিরচিত্র উপহার দেন।
প্রধানমন্ত্রীর প্রাইভেট সেক্টর বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান তাৎক্ষণিক এক প্রতিক্রিয়ায় সংবাদমাধ্যমকে বলেন, এটিই আমাদের বড় আনন্দ ও বৃহৎ অর্জন যে আমরা পদ্মা সেতু নির্মাণ করে তার ছবি বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্টকে উপহার দিয়েছি।
ওই সময় বিশ্বব্যাংকের বাইরে প্রবাসী বাংলাদেশীদের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতেও দেখা গেছে।
এদিকে, বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) এর নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, "আমি মনে করি বিশ্বব্যাংকের চলে যাওয়াটা ভূল সিদ্ধান্ত ছিলো এবং সরকারপ্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তটা যথেষ্ট কারেক্ট এবং কারেজাস (সৎসাহসী) ছিলো। আমরা তার সুফল পাচ্ছি।"
তিনি পরামর্শ দিয়ে বলেন, "তবে, এখন অতীত ভুলে যেতে হবে এবং বিষয়টাকে পলিটিসাইজড্ না করা ভালো। কারণ আমাদের অনেক প্রজেক্ট আছে। ফাইনান্স দরকার। এই যে এখন একধরনের দুঃসময়ে আমরা বিশ্বব্যাংককে পেলাম। সুতরাং আমাদের বিশ্বব্যাংককে দরকার আছে।"
পিআরআই এর এই নির্বাহী পরিচালক আরও বলেন, "উই শুড জাস্ট ফরগেট এন্ড কন্টিনিউ ওয়ার্ক উইথ দেম। সো, নো পলিটিক্যাল রেটোরিকস্। উই সোড রিডিউস বরোয়িং ফ্রম চায়না এন্ড আদার নন-কনসেশনাল সোর্সেস। উই সোড ইনক্রিজ রিলেশনস উইথ ওয়ার্ল্ড ব্যাংক।"
এদিন বিশ্বব্যাংক কর্মকর্তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামনেই একদিন আগে (২৯ এপ্রিল) স্বাক্ষরিত ঋণচুক্তিসমূহের সব দলিলাদি বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের কাছে হস্তান্তর করেন।
পাঁচ প্রকল্পে অর্থায়ন ও বাজেট সহায়তা হিসেবে বিশ্বব্যাংকের ২২৫ কোটি মার্কিন ডলার ঋণের মধ্যে ১২ বছরের স্বল্পমেয়াদে পরিশোধযোগ্য সুদবিহীন অংশ ৩২ কোটি ৪০ লাখ ডলার। টাকার অংকে এর পরিমান তিন হাজার চারশ তিরাশি কোটি টাকা (১০৭ টাকা হিসেবে)। এ ঋণ পরিশোধে বাংলাদেশ ৬ বছর গ্রেস পিরিয়ড বা কিস্তি অব্যাহতি পাবে। পরবর্তী ছয় বছরে ঋণের টাকা পরিশোধ করতে হবে।
গত ২৯ এপ্রিল বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের পাঁচ প্রকল্পে অর্থায়ন হিসেবে মোট ২২৫ কোটি ৩৪ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার ঋণচুক্তি স্বাক্ষর করে। টাকার অংকে মোট এ ঋণের পরিমান দাঁড়ায় ২৪ হাজার ২২৪ কোটি ৫৮ লাখ ৭৫ হাজার টাকা।
এ ঋণের জন্য বাংলাদেশকে সার্ভিস চার্জ দিতে হবে শুন্য দশমিক ৭৫ শতাংশ হারে। আর সুদ ১ দশমিক ২৫ শতাংশ। উত্তোলিত না করা ঋণের স্থিতির ওপর বছরে শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশ কমিটমেন্ট ফি দিতে হবে। ঋণের গ্রেস পিরিয়ড বা কিস্তি অব্যাহতি পাঁচ বছর। আর পরিশোধ করতে হবে ৩০ বছরে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব শরিফা খান এবং বাংলাদেশে নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকরে কান্ট্রি ডিরেক্টর আবদুলায়ে শেক এসব চুক্তি স্বাক্ষর করেন।
মঙ্গলবার (২ মে) ইআরডির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, পাঁচটি ঋণের মধ্যে চারটি প্রকল্পে ১৭২ কোটি ৫০ লাখ ডলারে ঋণ সম্পূর্ণ আইডিএ সহায়তা হিসেবে পাওয়া যাবে। অন্যদিকে বাজেট সহায়তার ৫০ কোটি ডলারে মধ্যে ১৭ কোটি ডলার আইডিএ সহায়তার মধ্যে থাকবে। বাকি ৩২ কোটি ৪০ লাখ ডলার স্বল্পমেয়াদি ঋণ, যা ৬ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ১২ বছরে পরিশোধ করতে হবে। ঋণের এ অংশে কোনো সার্ভিস চার্জ বা সুদ নেই।
আইডিএ বা ইন্টারন্যাশনাল ডেভলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন হলো কম সুদে নমনীয় ঋণ প্রদান করতে বিশ্বব্যাংকের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান বা লেন্ডিং আর্ম।
বাংলাদেশ ১৯৭২ সালে বিশ্বব্যাংকের সদস্যপদ লাভ করে। এ পর্যন্ত বাংলাদেশ চার হাজার কোটি ডলারের বেশি আইডিএ ঋণ নিয়েছে। বর্তমানে দেশে ৫৬ টি চলমান প্রকল্পে আইডিএ ঋণ আছে ১৬শ' ৩০ কোটি ডলার।
বাংলাদেশ নিম্ম মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে উন্নীত হবার আগে আইডিএ ঋণে শুধু শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশ সার্ভিস চার্জ ছিল। আর ঋণ পরিশোধে ১০ বছরে গ্রেস পিরিয়ডসহ ৪০ বছর সময় পেতো।