হঠাৎ করেই দুর্ভিক্ষ নিয়ে কেন এত সতর্কতা?

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

অক্টোবর ১৫, ২০২২, ০৭:৪০ পিএম

হঠাৎ করেই দুর্ভিক্ষ নিয়ে কেন এত সতর্কতা?

গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বিভিন্ন বক্তব্যে দুর্ভিক্ষের আশংকার কথা বলছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বৈশ্বিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে দুর্ভিক্ষের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেছেন, বাংলাদেশে যাতে এ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি না হয় সেজন্য এখন থেকে প্রস্তুতি নিতে হবে।

গত বৃহস্পতিবার সেনাবাহিনীর এক অনুষ্ঠানে দুর্ভিক্ষের প্রসঙ্গটি আবারও উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ যাতে দুর্ভিক্ষের শিকার না হয় সেজন্য খাদ্য উৎপাদনের জন্য প্রতি ইঞ্চি জমি উৎপাদনের কাজে ব্যবহার করতে হবে।

স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে দেশের প্রধানমন্ত্রী নিজে থেকেই দুর্ভিক্ষের কথা বলছেন কেন? সত্যিই কি দুর্ভিক্ষ হতে চলেছে?

দুর্ভিক্ষ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে আশংকা প্রকাশ করেছেন সেটি একেবারে অমূলক নয় জানিয়ে বিশ্ব ব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ খাদ্য রপ্তানি বন্ধ করেছে কিংবা রপ্তানি নিরুৎসাহিত করার জন্য শুল্ক আরোপ করেছে। বিশ্বজুড়ে খাদ্য সংকট দেখা দিলে বিভিন্ন দেশ রপ্তানির উপর নিষেধাজ্ঞা আরও জোরালো করতে পারে।

তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী আগে থেকেই উৎপাদন বাড়ানোর যে কথা বলছেন সেটি বাস্তবসম্মত। কারণ, খাদ্যের জন্য আন্তর্জাতিক বাজারের উপর নির্ভর করা ঠিক হবে না। খাদ্য সংকট দেখা দিলেই দুর্ভিক্ষের মতো পরিস্থিতি হবার জোরালো সম্ভাবনা তৈরি হয়। খাদ্যমূল্য যদি অনেক বেড়ে যায় তখন দরিদ্র মানুষ খাবার কিনতে পারে না। লাগামছাড়া মূল্যস্ফীতি দরিদ্র মানুষের জন্য বড় ধরনের সংকট তৈরি করেছে বাংলাদেশে।

ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশে এবার বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় আমন ধানের ফলন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে সেটি এখনও বলা যাচ্ছে না। অন্যদিকে বিশ্ববাজারেও খাদ্যের সংকট আছে। এ দুটো পরিস্থিতি বাংলাদেশের জন্য নাজুক পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। 

বাংলাদেশ যদি উৎপাদন বাড়াতে পারে এবং দরিদ্র মানুষকে খাদ্য সহায়তা দিতে পারে তাহলে দেশটি পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে বিশ্বজুড়ে মানুষের অবস্থা দিশেহারা। এ অবস্থায় দুর্ভিক্ষের সম্ভাবনার সতর্কবার্তা মানুষকে করছে আতঙ্কিত। ২০২৩ সালে সম্ভাব্য খাদ্য ঘাটতির আশংকায় এখনই উচ্চারিত হচ্ছে নানা ধরনের সতর্কবাণী। 

খাদ্য সংকট জোরালো হওয়ার আভাস পাওয়া যাচ্ছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলোতেও। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) এরই মধ্যে সতর্ক করে বলেছে যে ২০২৩ সালে বিশ্বের ৪৫টি দেশে তীব্র খাদ্য ঘাটতি দেখা দিতে পারে। ২০ কোটি মানুষের জন্য জরুরি সহায়তার প্রয়োজন হতে পারে। 

এফএও এবং ডব্লিউএফপির যৌথ প্রতিবেদনে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে দুর্ভিক্ষের প্রবল আশংকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- ইথিওপিয়া, নাইজেরিয়া, সোমালিয়া এবং সাউথ সুদান। এছাড়া ইয়েমেন এবং আফগানিস্তানেরও একই দশা।

এর পাশাপাশি এশিয়া ও আফ্রিকার আরও কিছু দেশ আছে যেখানে তীব্র খাদ্য ঘাটতি হতে পারে বলেও প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

সম্প্রতি এক বক্তব্যে বিশ্বজুড়ে খাদ্য ঘাটতির আশংকা প্রকাশ করেছেন বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির নির্বাহী পরিচালক ডেভিড বেসলে। পৃথিবীর ৪৫টি দেশ এখন 'দুর্ভিক্ষের দরজায় কড়া' নাড়ছে এমন মন্তব্য করে তিনি খাদ্য ঘাটতির কারণ হিসেবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অস্থিরতা এবং যুদ্ধ বিগ্রহকে দায়ী করেছেন।

ডব্লিউএফপি নির্বাহী পরিচালক বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে খাদ্য উৎপাদন কমে যাবে এবং এর একটি বড় কারণ হবে যুদ্ধ এবং সারের সংকট। তিনি বলেন, এটা এমন এক ধরনের সংকট হতে যাচ্ছে যা আমরা জীবদ্দশায় দেখিনি।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর আফ্রিকান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক তাদের রিপোর্টে বলেছে, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে সারের ব্যাপক সংকট তৈরি হয়েছে। এই অবস্থা অব্যাহত থাকলে আফ্রিকা মহাদেশে খাদ্য উৎপাদন ২০ শতাংশ কমে যাবে।

চলতি বছরের জুন মাসে জাতিসংঘ মহাসচিব এন্টোনিও গুতেরেস সতর্ক করে বলেছেন, ২০২২ সালে কয়েকটি দুর্ভিক্ষ ঘোষণার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে এবং ২০২৩ সালে সেটি আরও খারাপ হতে পারে।

বিশ্বজুড়ে খাদ্যমূল্য কিছুটা কমেছে। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে সংকট শেষ হয়ে যাচ্ছে। যেসব কারণে খাদ্যদ্রব্যের ঊর্ধ্বগতি হয়েছে সেগুলো এখনো বিদ্যমান আছে।  

চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি এবং জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি বিষয়ক সংস্থা তাদের যৌথ প্রতিবেদনে দুর্ভিক্ষ হওয়ার আশংকার কয়েকটি কারণ তুলে ধরেছে-

খাদ্য ঘাটতির জন্য একটি বড় কারণ হয়ে দাঁড়াবে যুদ্ধ এবং নানাবিধ সংঘাত। পৃথিবীতে যত মানুষ খাদ্য সংকটে ভুগছে তার মধ্যে ৬০ শতাংশ বসবাস করে যুদ্ধ-বিগ্রহ কবলিত এলাকায়। ইউক্রেন যুদ্ধ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে যুদ্ধের কারণে খাদ্য ঘাটতি কতটা খারাপ হতে পারে। এই যুদ্ধ চলতে থাকলে পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে।

জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে পৃথিবীর অনেক দেশ বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে নয়তো খরায় ভুগছে। এর ফলে খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশংকা তৈরি হচ্ছে। 

বিগত কিছু বছরে মহামারি করোনাভাইরাস বিশ্ব অর্থনীতিতে যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে সেটি এখনো কাটিয়ে উঠা সম্ভব হয়নি। এর মধ্যে জীবনযাত্রার ব্যয় ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার বিষয়টিও খাদ্য ঘাটতির কারণ হতে পারে।

বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালের তুলনায় এখন তাদের পরিচালনা ব্যয় যতটা বেড়েছে সেটি দিয়ে তারা প্রতিমাসে ৪০ লাখ মানুষকে খাওয়াতে পারত। 

খাদ্য উৎপাদন কমে যাওয়ার যে আশংকা করা হচ্ছে, তার পেছনে আরেকটি কারণ হচ্ছে কৃষি উৎপাদনের জন্য সার ও ডিজেলের মতো উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়া। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির প্রধান অর্থনীতিবিদ আরিফ হুসেইন বলেন, এখন সারের দাম বেশি এবং অনেকে কিনতে পারছেন না। এ বিষয়ে এখন থেকে সাবধান না হলে আগামী বছর সার পাওয়াই যাবে না। 

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ সেপ্টেম্বর মাসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলেছে, খাদ্য এবং সারের দাম বেড়ে যাওয়ায় পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ৪৮টি দেশকে অতিরিক্ত নয় বিলিয়ন ডলার খরচ করতে হবে।

বৈশ্বিক এ সংকটময় অবস্থায় আগামী বছর যদি বাংলাদেশে প্রতিকূল আবহাওয়া থাকে এবং বিশ্ববাজারে সংকট অব্যাহত থাকে তাহলে কঠিন সময়ে আসছে বলে অনেকে মনে করেন।

সূত্র: বিবিসি

Link copied!