৭ মার্চের ভাষণ ছিল সার্বজনীন মুক্তির বার্তা

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

মার্চ ৭, ২০২১, ১২:০৭ পিএম

৭ মার্চের ভাষণ ছিল সার্বজনীন মুক্তির বার্তা

বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের মূল কয়েকটি দিক হলো-সামগ্রিক পরিণতির পর্যালোচনা, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ওপর পাকিস্তান সরকারের অত্যাচার, নির্যাতন, অধিকার খর্ব করার বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর নিজের ভূমিকা ও অবস্থান ব্যাখ্যা, পশ্চিম পাকিস্তানি রাজনীতিকদের ভূমিকার ওপর আলোকপাত, সামরিক আইন প্রত্যাহারের আহবান, অত্যাচার ও সামরিক  আগ্রাসন  মোকাবেলার হুমকি, স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে সার্বিক হরতাল চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হামলা প্রতিরোধের আহবান।

২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা-ইউনেস্কো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণটিকে ‘ডকুমেন্টারি হেরিটেজ’ (বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য) হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।  

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ নিয়ে সম্প্রতি ফ্রান্সে বাংলাদেশ দূতাবাস ও ইউনেস্কোতে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশন যে গ্রন্থ প্রকাশ করেছে, জাতিসংঘের ছয়টি দাপ্তরিক ভাষায় তার মোড়ক উন্মোচন হয়েছে।

স্থানীয় সময় গত শুক্রবার (৫ মার্চ, ২০২১) ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে ইউনেস্কো সদর দপ্তরে মোড়ক উন্মোচনের ওই অনুষ্ঠান হয়। ইংরেজি, ফরাসি, স্প্যানিশ, আরবি, রুশ ও চীনা ভাষাভাষী ১২ জন রাষ্ট্রদূত ও ইউনেস্কোতে স্থায়ী প্রতিনিধি ‘The Historic 7th March Speech of Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman: A World Documentary Heritage’ গ্রন্থটির মোড়ক উন্মোচন করেন।

গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে ইউনেস্কোতে নিযুক্ত অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, আইভরি কোস্ট, সেনেগাল, স্পেন, কিউবা, সৌদি আরব, মৌরিতানিয়া, কুয়েত, রাশিয়া, চীন ও বাংলাদেশের এর রাষ্ট্রদূত ও স্থায়ী প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত সব রাষ্ট্রদূত ও স্থায়ী প্রতিনিধিরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সফল নেতৃত্ব দেওয়া এবং বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর অবদান স্মরণ করার পাশাপাশি তার ভাষণের ভূয়সী প্রশংসা করেন।

বঙ্গবন্ধুর অমর মহাকাব্য-৭ মার্চের ভাষণে অবহেলিত মানুষের মুক্তির বাণী, অত্যাচারের বিরুদ্ধে অত্যাচারীতের দাঁতভাঙ্গা জবাব, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর প্রতিফলিত হয়েছে।একটি জাতিকে পরাধীনতার শৃঙ্খলা থেকে মুক্ত করতে যা যা করণীয় তার সব উপদান রয়েছে বঙ্গবন্ধুর ভাষণে।

https://www.youtube.com/watch?v=wgdfYfDjaWo

রাজনীতিবিদ ও সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর ভাষণের মূল্যায়ন করতে গিয়ে দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ দেশকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। সমগ্র দেশকে একটি ভয়ংকর রক্তপিপাসু পাকিস্তানের জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে মোকাবেলা করার জন্য তৈরি করেছিল। কিন্তু যতদিন যাবে ততদিন এই ভাষণটি  শুধু বাংলাদেশের ভৌগলিক সীমানার ভেতরে সীমাবদ্ধ থাকবে না। পৃতিবীর  প্রতিটি দেশেই তা ছড়িয়ে যাবে এবং যাচ্ছে। আর এ্ই কারণে জাতিসংঘের সব দাপ্তরিক ভাষায় ভাষণটি  স্থান পেয়েছে। এটি বাংলাদেশের জনগণের একটি বিরাট সাফল্য।’

বঙ্গন্ধুর ভাষণে অবহেলিত মানুষের অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার আহবান জানানো হয়েছে উল্লেখ করে বাংলাদেশের সাবেক এই পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন ‘পৃথিবীর যে প্রান্তের মানুষ, যে অঞ্চলের মানুষ, যে জনগোষ্ঠীর মানুষ, যে দেশের মানুষ যেখানে যখন যে মুহুর্তে অত্যাচারিত ও নির্যাতিত হবে, ঠিক তখনই বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ওই জনগোষ্ঠীর, ওই দেশের ওই অঞ্চলের জনগণকে অত্যাচার ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে মোকাবেলার জন্য অনুপ্রাণিত করবে।’

তিনি বলেন,‘পৃথিবীর ইতিহাসে কেবলমাত্র আমাদের দেশের নয়, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ। এটি এখন সর্বজনস্বীকৃত ও সার্বজনীন ভাষণ।’

৭ মার্চ ভাষণের ভিশন ও দর্শন সম্পর্কে এই রাজনীতিবিদ বলেন, প্রায় ১৮ মিনিটের  ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ  মুজিবুর রহমান যে দিক নির্দেশনা দিয়েছেন… তিনি একদিকে যেমন শান্তির কথা বলেছেন, অন্যদিকে, একজন নেতা সাধারণ জনগণের হৃদয়ের মধ্যে প্রবেশ করে তাদের যে জাগিয়ে তুলতে পারেন তাও প্রকাশ পেয়েছে এই ভাষণে।

আবুল হাসান চৌধুরিী বলেন, ‘তিনি (বঙ্গবন্ধু) বলেছেন, আমি যদি আর হুকুম দেবার না পারি…. সেই  মুহুর্তে আমরা আবেগে আপ্লুত হয়েছিলাম,উদ্বেলিত হয়েছিলাম। সমগ্র জাতি ধর্ম, বর্ণ, দলমত নির্বিশেষে-যাদের মধ্যে সামান্যতম বাঙালিত্ববোধ জাগ্রত আছে—তারা এই ভাষণে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল।

সাবেক এই পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, ‘সবচেয়ে বড় কথা বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি এতই সার্বজনীন ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

৭ মার্চের ভাষণটি এপ্রিল মাসের গোড়ার দিকে কলকাতা থেকে ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করে বিখ্যাত রেকর্ড কোম্পানি-হিজ মাস্টর্স ভয়েস (এইচএমভি)। এই কোম্পানি বিনামূল্যে ভাষণের ৩ হাজার অডিও/ভিডিও ক্যাসেট অস্থায়ী মুজিবনগর সরকারকে দেয়। পরে ভাষণের ওইসব  ক্যাসেট বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানের কাছে পাঠানো হয়।

সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী বলেন, ‘তখনকার (মুক্তিযুদ্ধের সময়) দ্বিখণ্ডিত পৃথিবীতে একদিকে ছিল আমেরিকান ব্লক, অন্যদিকে ছিল রাশিয়ান ব্লক। তারপরও দুই ব্লকের অনেক রাষ্ট্রের সমর্থন আমরা পেয়েছি। এর পেছনে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।’

বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ভাষণের ভেতরে এমন জিনিস ছিল, যে আদর্শ ছিল, যে ভিশন ছিল, যে চেতনা ছিল সেটা শুধু একটা দেশের মধ্যে আবদ্ধ থাকেনি। আর এই কারণে দুই ব্লকের অনেক রাষ্ট্রই মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের সাহায্য সহযোগিতা করেছে।’

বঙ্গবন্ধুর ভাষনের ঐতিহাসিক গুরুত্ব সম্পর্কে বিশিষ্ট কথা সাহিত্যিক, সাহিত্য সমালোচক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘পৃথিবীর যে ভাষণগুলো ইতিহাসকে পুনরুজ্জীবিত করেছে সেগুলোর মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি ইতিহাস নির্মাণ করেছে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু যদি ভাষণটি না দিতেন, আমাদের  দিক নির্দেশনা স্পষ্ট হত না, পৃথিবীর মানুষও বুঝতে পারতো না।’

https://www.youtube.com/watch?v=xVwYG-YFEWU

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ছিল তেজোদিপ্ত। একদিকে যেমন আবেগ রয়েছে, অন্যাদকে রয়েছে শরীরে শিহরণ জাগানোর মত উপদান। সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে (তখনকার সময়ে রেককোর্স ময়দান) বঙ্গবন্ধুর জনসভা কাভার করতে এসেছিলেন অনেক বিদেশি সাংবাদিক। তারাও বাকরুদ্ধ হয়ে  শুনছিলেন পোয়েট অব পলিটিক্সের অমর কাব্যকথা। তবে ১১০৮ শব্দের এই ভাষণের মূলমন্ত্র বা সারমর্ম বুঝতে তাদের কোনো অসুবিধা হয়নি।

এমনই এক ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বাংলাদেশের এ্ই স্বনামধন্য কথা সাহিত্যিক বলেন, নামটা মনে করতে পারছিনা। তিনি একটি ব্রিটিশ রেডিওর সাংবাদিক ছিলেন। আমার কাজ ছিল দোভাষীর কাজ। এক মিনিটের মত শোনানোর পর তিনি বললেন,-আর দরকার নেই। (স্টপ ডুইং ট্রান্সলেট)। সেই লোকটি কান খাড়া করে মন্ত্রমুগ্ধ সহকারে ভাষণ শুনলো। আমি পরে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম-আপনি কীভাবে ভাষণটি বুঝলেন, বঙ্গবন্ধুতো বাংলায় বলেছেন।  জবাবে ওই সাংবাদিক বললেন, I understood. Somehow I could read his mind.’

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণই মুক্তিপাগল বাঙালিকে স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে সাহায্য করেছিল, ভিন্নমাত্রা পেয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন-যার প্রধান স্লোগান ছিল-জয় বাংলা।

Link copied!