পাঁচ মাস আগে বিয়ে হয় রবিন আর জিয়াসমিনের। ইচ্ছা ছিল আসন্ন ঈদের পর বেতন বাড়লে লাল শাড়ি পরিয়ে ধুমধাম করে বউকে আনা হবে শ্বশুরবাড়িতে। কিন্তু সেই স্বপ্ন অপূর্ণ রেখেই বউকে শ্বশুরবাড়ি পা রাখতে হলো স্বামীর দাফন কার্যে অংশ নিতে।
গত মঙ্গলবার (৭ মার্চ) রাজধানীর গুলিস্তানের সিদ্দিকবাজারে ভয়াবহ বিস্ফোরণে মৃত্যুবরণ করেন শরীয়তপুরের গোসাইরহাট উপজেলার রবিন হোসেন শান্ত (২৩)। একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে পাগলপ্রায় রবিনের বৃদ্ধ বাবা-মা। স্বামীকে হারিয়ে বিহ্বল নববধূ জিয়াসমিন (১৮)।
বুধবার শরীয়তপুরের গোসাইরহাট উপজেলার নাগেরপাড়া ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্ব নাগেরপাড়া গ্রামে দাফন করা হয় রবিন হোসেন শান্তকে।
কাঁদতে কাঁদতে রবিনের বাবা সোহরাব সরদার বলতে থাকেন, ‘আমরা বুড়া-বুড়ি কখন যে মরে যাই তা কি বলতে পারি। তাই ছেলের বউ দেখব বলে পাঁচ মাস আগে তাকে বিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু অভাবের সংসারে অনুষ্ঠান করতে পারিনি। তাই এখনও পোলা বউরে বাড়িতে নাইয়র (ওঠানো) আনা হয় নাই। ছেলের দোকান মালিক বলেছিলেন, রমজানের ঈদের পরে শান্তর (ছেলে) বেতন বাড়াবে। আশা ছিল, কোরবানির ঈদের পর গ্রামের মুরব্বিদের নিয়ে লাল শাড়ি পরাইয়া বউ আনব। কিন্তু তা আর হলো না। নতুন বউ আইলো স্বামীরে দাফন করতে।’
একমাত্র ছেলের মৃত্যুতে দিশেহারা বাবা বলেন, ‘একটা মাত্র ছেলে ছিল আমার। অনেক কষ্টে ছেলেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করিয়েছিলাম। দুই বছর আগে আমার ব্রেইন স্ট্রোক হয়। পরে সে পড়াশোনা ছেড়ে রাজধানীর সিদ্দিক বাজারে একটি সিরামিকের দোকানে কাজ শুরু করে। তার সাত হাজার টাকা বেতনের চাকরিতে আমাদের সংসার চলছিল। ওর টাকায় আমাদের ওষুধ কিনতে হতো। এখন কে আমাকে ওষুধ কিনে দেবে? কে আমাদের মুখে খাবার দেবে?’
সন্তানহারা মা তাসলিমা (৪৫) বলেন, ‘আমি এখন এই ছেলের বউকে কী করব? আমার তো আরেকটা ছেলেও নাই যে তার জন্য রেখে দেব। কে আমার অসুস্থ স্বামীরে দেখবে? আমি কাল সকালে কী রাধব? আল্লাহ আমারে এ কোন পরীক্ষায় ফালাইল?’
মাত্র ৫ মাস আগে বিয়ে হয়ে রবিনের স্ত্রীর পরিচয় পাওয়া জিয়াসমিনের কান্নার বাঁধ ভেঙে একাকার। স্বামীর দাফনে অংশ নিতে স্বামীর বাড়িতে পা পড়লো তার। কাঁদতে কাঁদতেই জিয়াসমিন বলেন, ‘আমি স্বামীর ঘর করার আগেই বিধবা হইলাম। আমি এখন কী করব? আমার কী হইব? আমার শ্বশুর বৃদ্ধ মানুষ, তিনি নিজেই এখন খেতে পাবেন না, আমাকে খাওয়াবেন কোথা থেকে?’
শান্তর চাচি নাছিমা আক্তার বলেন, ‘শান্তর মতো ভদ্র ছেলে আমি আর দেখি নাই। অল্প বয়সে সংসারের হাল ধরেছিল। বৃদ্ধ বাবাকে দেখাশোনা করত। এখন আর কেউ রইল না দেখাশোনা করার জন্য।’
সোহরাব সরদারের প্রতিবেশী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, সোহরাবের কোনো জমি নেই। জমানো টাকা দিয়ে ৫ শতক জমি কিনেছিলেন। সেখানে বাড়ি করবেন। কিন্তু সেই জমিতে ছেলেকে দাফন করতে হলো। বংশের ধারাবাহিকতা রক্ষার মতো কেউ রইল না আর সোহরাব সরদারের।
নারায়ণগঞ্জের সরকারি তোলারাম কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে গুলিস্তানের সিদ্দিক বাজারের একটি সিরামিকের দোকানে চাকরি নিয়েছিলেন রবিন হোসেন শান্ত। বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়ে যাওয়া সেই দোকান থেকে দোকান মালিক মমিন উদ্দিন সুমনের মরদেহ উদ্ধারের আধাঘণ্টা পরই রবিন হোসেন শান্তর মরদেহ উদ্ধার করেন ফায়ার সার্ভিসকর্মীরা।
এদিকে অসহায় এই পরিবারটির পাশে দাঁড়ানোর আশ্বাস দিয়েছেন শাহাদাত হোসেন নামে এক যুবক। তিনি সোহরাব সরদারের পালক পুত্র। ঢাকায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন।
শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘আল্লাহ বুঝি মানুষের ভাগ্য আগেই লিখে রাখেন। তা না হলে সোহরাব চাচা কেন আমাকে ছোটবেলা থেকে লালন-পালন করবেন? তার মৃত্যু পর্যন্ত তাকে আমি দেখে রাখব। আমি বুঝি বাবা-মায়ের কষ্ট কী! আমি ডাল-ভাত খেলে সোহরাব চাচা আর তাসলিমা চাচিরেও খাওয়াব। আমি না খাইলে তারাও না খেয়ে থাকবেন।’
শাহাদাত বলেন, দুর্ঘটনার পরেরদিন মরদেহ আমরা হাতে পাই। দাফনের জন্য ১০ হাজার টাকা দিয়েছে আমাদের। আমাদের গ্রামের বাড়িতেই দাফন করেছি শান্তকে।
গুলিস্তানের সিদ্দিকবাজারে নর্থ-সাউথ রোডের ১৮০/১ হোল্ডিংয়ে সাততলা ভবনে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনায় শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ২৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন শতাধিক। এখনো চিকিৎসাধীন আছেন অনেকে।