বৈশ্বিক মহামারী করোনাসহ উন্নয়ন প্রকল্পের কাজে ধীরগতির কারণে উন্নয়ন বাজেট কাটছাঁটের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। মূল বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) থেকে কমে যাচ্ছে প্রায় সাড়ে ১৯ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের মূল উন্নয়ন বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ২ লাখ ৩৬ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। কাটছাঁটের পর শেষ পর্যন্ত ২ লাখ ১৭ হাজার ১৬৩ কোটি টাকা দাঁড়াচ্ছে সংশোধিত এডিপির আকার। পরিকল্পনা কমিশনে আজ বুধবার এ সংক্রান্ত জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সভায় সংশোধিত এডিপি অনুমোদন হতে পারে বলে সূত্রে জানা গেছে।
জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, ‘বাস্তবতার নিরিখে সংশোধিত উন্নয়ন কর্মসূচিতে (আরএডিপি) প্রকল্পের বরাদ্দ কাটছাঁট করতে হচ্ছে। পৃথিবীর সব দেশেই এমনটি হয়।’ তিনি বলেন, ‘বাজেট করা হয় বছরের শুরুতে। তখন হিসাব থাকে একটা। বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে বছর শেষে আমরা বুঝতে পেরেছি, যারা খরচ করতে পারেনি, তাদের বরাদ্দ যদি অন্যদের দিই তা হলে এডিপি বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। প্রতিবছরই এমন কাটছাঁট হয়।’ এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘করোনার কারণে এ বাজেটে তেমন একটা ক্ষতি হয়নি। কারণ প্রতিটি সূচক প্রমাণ করে, সার্বিকভাবে এ অঞ্চলে বাংলাদেশ সবচেয়ে কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ হিসাব আমাদের নয়, বিশ্বব্যাংকের।’
জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের সংশোধিত এডিপিতে বৈদেশিক অর্থায়ন কমছে ১৭ হাজার ৭৭৪ কোটি টাকা। মূল এডিপিতে ছিল ৮৮ হাজার ২৪ কোটি টাকা। বর্তমানে দাঁড়াচ্ছে ৭০ হাজার ২৫০ কোটি টাকা। তবে সংশোধিত এডিপিতে কমছে না দেশীয় অর্থায়ন। অর্থাৎ মূল এডিপির ১ লাখ ৩৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকাই থাকছে। এর সঙ্গে খাতওয়ারি ও উন্নয়ন সহায়তা খাতওয়ারি বরাদ্দ বিভাজন এবং স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার নিজস্ব অর্থায়নের ৯ হাজার ৬৯৩ কোটি টাকা রয়েছে।
সংশোধিত এডিপিতে সর্বোচ্চ বরাদ্দপ্রাপ্ত ১০টি খাতের মধ্যে প্রথম অবস্থানে রয়েছে পরিবহন ও যোগাযোগ। এ খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৫ হাজার ৮২৭ কোটি টাকা। যেখানে এ খাতে মূল এডিপিতে বরাদ্দ ছিল ৬১ হাজার ৬৩১ কোটি টাকা। অর্থাৎ বরাদ্দ কমছে ৫ হাজার ৮০৪ কোটি টাকা। এর পরই সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে, সংশোধিত এডিপিতে ৩৯ হাজার ২১৪ কোটি টাকা। এ খাতে কোনো অর্থ কমেনি। গৃহায়ণ ও কমিউনিটি সুবিধাবলি সেক্টরে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২৩ হাজার ৫৯৫ কোটি টাকা, শিক্ষায় ২০ হাজার ৮২৪ কোটি টাকা, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন খাতে ১৫ হাজার ৫২০ কোটি টাকা। আর স্বাস্থ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১৩ হাজার ৭৯৭ কোটি টাকা, যেখানে মূল এডিপিতে বরাদ্দ ছিল ১৭ হাজার ৩০৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ জনগুরুত্বপূর্ণ এই খাতে বরাদ্দ কমছে ৩ হাজার ৫০৯ কোটি টাকা। পরিবেশ জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৯ হাজার ৮৪ কোটি টাকা, কৃষি খাতে ৭ হাজার ২৭৯ কোটি টাকা, শিল্প ও অর্থনৈতিক সেবা খাতে ৪ হাজার ৫৩৭ কোটি টাকা এবং শৃঙ্খলা ও সুরক্ষা খাতে ৩ হাজার ৪৭৮ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে সংশোধিত এডিপিতে সর্বোচ্চ বরাদ্দপ্রাপ্ত ১০ প্রকল্প হচ্ছে- রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। যেখানে মোট এডিপিতে বরাদ্দ ছিল ১৮ হাজার ৪২৬ কোটি ১৬ লাখ টাকা। এডিপির তুলনায় ৩ হাজার ৫৯০ কোটি টাকা ব্যয় কমছে। প্রকল্পটিতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১৪ হাজার ৮৩৬ কোটি টাকা। মাতারবাড়ী ২ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কোল পাওয়ার প্রজেক্ট প্রকল্পে সংশোধিত এডিপিতে কোনো পরিবর্তন হয়নি। প্রকল্পটিতে বরাদ্দ রয়েছে ৬ হাজার ১৬২ কোটি টাকা। এর পর তৃতীয় অবস্থানে চতুর্থ প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি (পিইডিপি-৪) প্রকল্পে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৬ হাজার ১৩৮ কোটি টাকা। এখানে মূল এডিপির তুলনায় বরাদ্দ বেড়েছে প্রায় ১ হাজার ৮৫ কোটি টাকা। পদ্মা সেতু রেল সংযোগ সংশোধিত প্রকল্পটিতে এডিপিতে ৬ হাজার ১৩৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। যেখানে মূল এডিপিতে বরাদ্দ ছিল ৩ হাজার ৮২৩ কোটি টাকা। এখানে বরাদ্দ বেড়েছে ২ হাজার ৩১৪ কোটি টাকা। এর পর ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (লাইন-৬) প্রকল্পে সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৪ হাজার ২৩৩ কোটি টাকা। এখানে মূল এডিপিতে বরাদ্দ ছিল ৪ হাজার ৮০০ কোটি টাকা।
এ ছাড়া হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রথম পর্যায়ে প্রথম সংশোধিত প্রকল্পে ৩ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। যেখানে মূল এডিপিতে ছিল ২ হাজার ৮২৭ কোটি টাকা। পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ প্রকল্পটিতে সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। যেখানে মূল এডিপিতে বরাদ্দ ছিল ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
সাসেক সড়ক সংযোগ প্রকল্প : এলেঙ্গা-হাঁটিকুমরুল-রংপুর মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ প্রথম সংশোধিত প্রকল্পটিতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২ হাজার ৩৪৪ কোটি টাকা। যেখানে মূল এডিপিতে বরাদ্দ ছিল ২ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতু নির্মাণ প্রকল্পের সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২ হাজার ১৭৭ কোটি টাকা। যেখানে মূল প্রকল্পে এডিপিতে বরাদ্দ ছিল ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। আর ভূমি অধিগ্রহণ ও ইউটিলিটি স্থানান্তর প্রকল্প সাপোর্ট টু ঢাকা সিলেট-তামাবিল মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ এবং উভয় পাশে পৃথক সার্ভিস নির্মাণ প্রকল্পে সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২ হাজার ১৫০ কোটি টাকা, যেখানে মূল এডিপিতে বরাদ্দ ছিল ১ হাজার ৬৭৫ কোটি টাকা।
২০২১-২২ অর্থবছরের মূল এডিপিতে অন্তর্ভুক্ত ১ হাজার ৫৩৪টি প্রকল্প, নতুন অনুমোদিত ১৯৯টি প্রকল্প এবং চলতি অর্থবছরের মূল এডিপিতে অন্তর্ভুক্ত নেই এমন বাদ পড়া ২১টি প্রকল্পসহ সংশোধিত এডিপিতে মোট ১ হাজার ৭৫৪টি প্রকল্প বরাদ্দসহ এনইসির অনুমোদনের জন্য তোলা হবে।
এ ছাড়া ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত সংশোধিত এডিপিতে বৈদেশিক সাহায্য প্রাপ্তির সুবিধার্থে বরাদ্দবিহীন অননুমোদিত নতুন ১৩২টি, আন্তঃমন্ত্রণালয় প্রোগ্রামিং কমিটি কর্তৃক সুপারিশকৃত নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তাবিত ১২টি, পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) প্রকল্পের আওতায় বাস্তবায়নের জন্য ৭৮টি, ২০২১-২২ অর্থবছরের এডিপি হতে বিভিন্ন কারণে বাদ পড়া ২১টি, ২০২০-২১ অর্থবছরের সংশোধিত এডিপিতে সমাপ্তির জন্য নির্ধারিত ছিল এমন ৭৪টি এবং ২০২১-২২ অর্থবছরের এডিপি হতে বাদ পড়া ২১টি প্রকল্পসহ ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত সংশোধিত এডিপিতে ৩৭৮টি প্রকল্প জুন ২০২২-এর মধ্যে সমাপ্তির এবং এসব প্রকল্পের মেয়াদ আর বৃদ্ধি না করার নির্দেশনা প্রদান করে এনইসির অনুমোদনের জন্য তোলা হবে।