করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় শিল্প ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন ধাপে প্রণোদনা দেয়া হয়েছে। প্রণোদনা প্যাকেজের অর্থ ব্যয় হওয়ার কথা কোম্পানির চলতি মূলধন হিসাবে। কিন্তু প্রণোধনার অর্থ চলতি মূলধনে ব্যয় না হয়ে অনুৎপাদনশীল খাতে চলে যাচ্ছে। জমি,গাড়ি-বাড়ি ক্রয় সহ প্রণোদনা অর্থের বড় একটি অংশ চলে যাচ্ছে পুঁজিবাজারে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ‘অফ-সাইট সুপারভিশন’ বিভাগের পর্যবেক্ষণে প্রণোদনার ঋণের অপব্যবহারের এমন চিত্র উঠে এসেছে।
কঠোর হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক
প্রণোধনার ঋণের অর্থের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিতে কঠোর হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে দু-একদিনের মধ্যেই এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে। বৃহৎ শিল্প ও সেবা খাতের জন্য ঘোষিত ৪০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজের অর্থের অপব্যবহার বেশি হচ্ছে। চলতি মূলধন খাতে ব্যয় করবেন—এমন শর্ত মেনেই ব্যাংক থেকে গ্রাহকরা সাড়ে ৪ শতাংশ সুদের এ ঋণ নিচ্ছেন। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ, বিভিন্ন ধরনের ইউটিলিটি বিল, শিল্পের কাঁচামাল ক্রয়সহ উৎপাদন সচল রাখতে নৈমিত্তিক ব্যয় চলতি মূলধন হিসেবে বিবেচিত হয়।
প্রণোদনার অর্থে পুঁজিবাজারে সূচক বৃদ্ধি
সাম্প্রতিক সময়ে পুঁজিবাজারে বড় উল্লম্ফনের পেছনে প্রণোদনা প্যাকেজের অর্থ বিনিয়োগের প্রমাণ পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রণোদনার ঋণ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ হওয়ায় ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচকে বড় উল্লম্ফন হয়েছে। ঋণ বিতরণকারী ব্যাংকের গাফিলতির কারণেই এমনটি হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্ণর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রণোদনার অর্থ মূলত প্রতিষ্ঠান চালানো বিশেষ করে শ্রমিকদের বেতন নিশ্চিতকরার কাজে ব্যবহার করার কথা। কিন্তু বিতরণে গাফলতির কারনে অনুৎপাদিতশীল খাতে এই বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেয়েছে। এক্ষেত্রে সরাসরি প্রণোদনা না দিয়ে শ্রমিকদের বেতনসহ গুচ্ছ আকারে একাউন্ট করে অর্থ প্রদান করলে এমন সমস্যা হত না।
করোনায় শুরুতে বেহাল অবস্থায় ছিল পুঁজিবাজার
মহামারি করোনাভাইরাসের প্রভাবে গত বছরের প্রথমার্ধে বেহাল অবস্থায় ছিল দেশের পুঁজিবাজার। বেশির ভাগ শেয়ারের ধারাবাহিক দরপতনে প্রতিদিনই সূচক হারাচ্ছিল ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স। দরপতন ঠেকাতে তালিকাভুক্ত কোম্পানির ফ্লোরপ্রাইস নির্ধারণ করে দেয় পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
মহামারিতেও হঠাৎ চাঙ্গা পুঁজিবাজার
গত তিন মাস ধরে দেশের পুঁজিবাজারে সূচক ও শেয়ারের দামে উত্থান চলছে। এমনকি অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে নতুন উচ্চতায় উঠেছে ডিএসইর বাজার মূলধন ও প্রধান সূচক।
পুঁজিবাজারের তথ্য বলছে, পুঁজিবাজারে সবচেয়ে বড় উল্লম্ফন হয়েছে গত তিন মাসে। চলতি বছরের ১৯ এপ্রিল ডিএসইর বাজার মূলধন ছিল ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা। মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে ১৯ জুলাই ডিএসইর বাজার মূলধন ৫ লাখ ৩৫ হাজার ১৮৫ কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। এ তিন মাসে বাজার মূলধন বেড়েছে ৭০ হাজার ৮৬৯ কোটি টাকা।
গত ১৯ এপ্রিল ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ছিল ৫ হাজার ৩৪৯ পয়েন্ট। গত তিন মাসে ডিএসইএক্সে ১ হাজার ৫৬ পয়েন্ট যুক্ত হয়েছে। ১৯ জুলাই ডিএসইএক্সের সূচক দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৪০৫ পয়েন্টে। তবে পুঁজিবাজারের সাম্প্রতিক উত্থানের সময় দুর্বল কোম্পানির শেয়ারে সবচেয়ে বেশি রিটার্ন এসেছে।
২৮ টি প্রণোদনার প্যাকেজ
মহামারি করোনাভাইরাসে সৃষ্ট আর্থিক দুর্যোগ থেকে পরিত্রাণ দিতে এখন পর্যন্ত ২৮টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে সরকার। অর্থের পরিমাপে প্রণোদনা প্যাকেজের আকার ১ লাখ ৩১ হাজার কোটি টাকার বেশি। বিশাল অংকের এ প্রণোদনার মধ্যে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকাই ঋণ হিসেবে বিতরণের নেতৃত্ব দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে রয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত বৃহৎ শিল্প ও সেবা খাতের জন্য ৪০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ। ক্ষতিগ্রস্ত সিএসএমই খাতের জন্যও ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়।
ব্যাংকঋণ হিসেবে দেয়া বৃহৎ শিল্প ও সেবা খাতের প্রণোদনা প্যাকেজের সুদহার নির্ধারণ করা হয় ৪ দশমিক ৫০ শতাংশ। আর সিএসএমই খাতের প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে নেয়া ঋণের জন্য গ্রাহকরা ৪ শতাংশ সুদ পরিশোধ করছেন। ২০২০ সালের এপ্রিলেই এ দুটি প্যাকেজের আওতায় ঋণ বিতরণের জন্য নীতিমালা ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
ঋণ বিতরণের নীতিমালায় বলা হয়েছিল, প্রণোদনা প্যাকেজগুলোর মেয়াদ হবে তিন বছর। তবে একজন উদ্যোক্তা কেবল এক বছরের জন্য স্বল্প সুদের ঋণ সুবিধা ভোগ করবেন। ঋণ বিতরণের দিন থেকে এক বছর পার হলে সে ঋণের বিপরীতে সরকার থেকে কোনো সুদ ভর্তুকি দেয়া হবে না। ঋণটি আদায় না হলে সেটি বিতরণকারী ব্যাংকগুলোর স্বাভাবিক ঋণ বলে গণ্য হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জারীকৃত নীতিমালার আওতায় এরই মধ্যে বৃহৎ শিল্প ও সেবা খাতের জন্য ঘোষিত ৪০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে বিতরণকৃত বেশির ভাগ ঋণের এক বছর পূর্ণ হয়েছে। ১ জুলাই দ্বিতীয় মেয়াদে এ প্যাকেজ থেকে ঋণ বিতরণ শুরু করেছে ব্যাংকগুলো। পাশাপাশি সিএসএমই খাতের ২০ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ থেকেও দ্বিতীয় মেয়াদে ঋণ বিতরণ শুরু হয়েছে। প্রথম মেয়াদে ঋণ বিতরণ শেষ হওয়ার পর প্রণোদনা প্যাকেজের ঋণের অপব্যবহারের প্রমাণ পেল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।