আমেরিকায় মানুষের চেয়ে যে কারণে বন্দুক বেশি!

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

মে ২৬, ২০২২, ০৩:৩৭ পিএম

আমেরিকায় মানুষের চেয়ে যে কারণে বন্দুক বেশি!

পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই লাইসেন্সকৃত অস্ত্র রাখা যায়। এমনকি বাংলাদেশেও রাখা যায়। অনেকেই রাখেন, কারও আসলেই আত্মরক্ষার প্রয়োজনে রাখতে হয়, কেউ কেউ রাখেন নিতান্ত শখে; এটা একটি স্ট্যাটাস সিম্বল কিংবা আত্ম প্রশান্তি। তবে এসবের কোনটিও স্বয়ংক্রিয় কিংবা আধা স্বয়ংক্রিয় নয়। এধরনের অস্ত্র রাখা রীতিমত ফৌজদারি অপরাধ।

যুক্তরাষ্ট্রে কিছুকাল আগে পর্যন্তও পূর্ন স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র সিভিলিয়ায়নারা রাখতে পারত। এখন তারা আধা স্বয়ংক্রিয় রাখতে পারেন। তাতেও দেশটিতে অস্ত্রসহিংসতা ঠেকানো যাচ্ছে না। তবে অঙ্গরাজ্যভেদে আইনের পার্থক্য আছে। এরইমধ্যে ২৪ মে টেক্সাসের একটি স্কুলে এক তরুণ বন্দুকধারীর গুলিতে ১৯ শিশু শিক্ষার্থী এবং ২ শিক্ষক নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় পুলিশের গুলিতে ১৮ বছর বয়সী ওই তরুণও নিহত হয়।

২০১৫ সালে আমেরিকায় এক বছরেই এমন অস্ত্র সহিংসতায় নিহত হয় দশ হাজারেরও বেশি মানুষ। ২০১৭ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে হ্যান্ডগান, শটগান ও রাইফেলের সংখ্যা তার আগের দুই দশকের চেয়ে তিন গুণ বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে আগ্নেয়াস্ত্রের সংখ্যা দেশটির মোট জনসংখ্যার চাইতে বেশি। বন্দুক হামলায় মৃতের সংখ্যায়ও আমেরিকাই শীর্ষস্থানে। আর অস্ত্র ব্যবসার বিনিয়োগও এখানে সবচেয়ে লাভজনক।

কেন ব্যক্তিগত অস্ত্র রাখার এই প্রবণতা?

যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন পুলিশ বিভাগের গঠনের উপর, স্থানীয়ভাবে অপরাধ দমনের প্রবণতা এবং অস্ত্র সংস্কৃতির ধারণা পাওয়া যায়। বিশ্বের সবচাইতে বেশি স্বাধীন পুলিশ বিভাগ আছে যুক্তরাষ্ট্রে, ৪০০০ এরও বেশি; প্রতিটি এলাকা যেমন স্টেট, সিটি, কাউন্টি কিংবা টাউন এমনকি পার্কের জন্যও আলাদা পুলিশ ডিপার্টমেন্ট। যার সবচাইতে ছোটটির সদস্য ৫০ জন থেকেও কম থেকে বৃহত্তমগুলোর সদস্য প্রায় ৩৪০০০ এরও অধিক। প্রধান প্রধান কেন্দ্রীয় পুলিশ কিংবা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা যেমন এফবিআই, ডিইএ, এটিএফ একেবারে নতুন সৃষ্টি, বিংশ শতাব্দীতে এদের যাত্রা শুরু। অন্যান্য দেশের মত যুক্তরাষ্ট্রে কেন্দ্রীয়ভাবে কোন ইউনিফর্মড পুলিশ সার্ভিস নেই। তাছাড়া ঐতিহ্যবাহী “শেরিফ বিভাগ” বিভিন্ন জেলা আকৃতির কাউন্টিতে স্থানীয় পুলিশ বিভাগের সাথে কাজ করে; লোকাল শেরিফ সাধারণত কোন এলাকার প্রধান আইন প্রয়োগকারী ব্যক্তি যিনি ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হন। এত কিছুর পরও এলাকার নিরাপত্তা বিধান সম্ভব হয়ে উঠে না। যার কারণেই ব্যক্তিগত আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।

অনুভূতি যখন ভোতা

আমেরিকানরা এখন আর বন্দুকধারীর গুলিতে মানুষ হত্যার খবর শুনে চমকে ওঠে না। অনেকটা তাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে এটি। ঘরে-বাইরে, উপাসনালয়ে, স্কুলে, নাইটক্লাবে, বারে কিংবা বড় কোনো উৎসবে একের পর এক বন্দুক হামলায় সাধারণ নাগরিক নিহতের খবর মার্কিনিদের অসাড়-অনুভূতিহীন করে তুলেছে। ২০১৪ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার ইসলা ভিস্তাতে বন্দুকধারীর গুলিতে নিহতের ঘটনার পর দ্য ওনিয়ন লিখেছিল, 'এটা প্রতিরোধের কোনো উপায় নেই এবং আমেরিকাই একমাত্র দেশ যেখানে রুটিনমাফিক প্রতিনিয়ত এ ধরনের হত্যাকাণ্ড ঘটছে!'

কিন্তু সত্যিই কি এই নির্বিচারে হতাকাণ্ড প্রতিরোধের কোনো উপায় নেই? কারণ ২০২২ সালের এসেও আমেরিকাবাসীকে দেখতে হচ্ছে সেই একই চিত্র। 'এডউইক' নামের এক শিক্ষা গবেষণার তথ্যমতে, গত বছর যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে এমন হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ২৬টি। ফলে দেশের নীতিনির্ধারকদের কপালে চিন্তার ভাঁজ তো পড়েছেই, সাথে জনমনে আতঙ্কও বেড়েছে।

ধনী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের সংখ্যায়ও আমেরিকাই শীর্ষস্থানে। শুধু অন্যের গুলিতেই নয়, নিজেরা নিজেদের মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে আত্মহত্যার দিক থেকে বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আগে শুধু গ্রিনল্যান্ডের অবস্থান।

বিশ্বব্যাংক এবং ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিকস অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশন এর গ্লোবাল বার্ডেন অব ডিজিস সার্ভের ডেটা অনুযায়ী, ধনী দেশগুলোর মধ্যে জাপান, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর ও দক্ষিণ কোরিয়ায় আগ্নেয়াস্ত্রের গুলিতে মৃত্যর হার শূন্য।

আগ্নেয়াস্ত্রের গুলিতে মৃত্যুর সংখ্যার সাথে আগ্নেয়াস্ত্র মজুদ থাকার সম্পর্ক রয়েছে। মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতি বছর লাখ লাখ আগ্নেয়াস্ত্র উৎপাদন করছে এবং তার চেয়েও বেশি আমদানি করছে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার শাসনামলের প্রথম মেয়াদে দেশীয় আগ্নেয়াস্ত্র উৎপাদন নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পায় যুক্তরাষ্ট্রে। কারণ অনেকেরই ভয় ছিল যে, আট বছরের রিপাবলিকান হোয়াইট হাউজের অবসানের পর আগ্নেয়াস্ত্র-নিয়ন্ত্রণে বিশ্বাসী প্রেসিডেন্ট ওবামা দেশের জনগণের অস্ত্র রাখার অধিকার কেড়ে নিবেন।

কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। ২০১৭ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে হ্যান্ডগান, শটগান ও রাইফেলের সংখ্যা তার আগের দুই দশকের চেয়ে তিন গুণ বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে আগ্নেয়াস্ত্রের সংখ্যা দেশটির মোট জনসংখ্যার চাইতে বেশি।

বিভিন্ন দেশের হিসাবে আগ্নেয়াস্ত্রের সংখ্যার দিক থেকে কানাডার নামও চলে আসে। কিন্তু তা সত্ত্বেও, কানাডায় বন্দুকের গুলিতে মৃত্যুর সংখ্যা বেশ কম। আগ্নেয়াস্ত্রের গুলিতে মৃত্যুহারের দিক থেকে কানাডার অবস্থান বিশ্বে ৭২তম। এমনকি কানাডায় প্রতি তিনজন নাগরিকের মধ্যে একজনের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র থাকলেও, দেশটিতে অস্ত্র সহিংসতার হার যুক্তরাষ্ট্রের ১০ ভাগের ১ ভাগ।

কানাডায় বন্দুক কিনতে হলে আগে একটি সুপারিশনামা দেখাতে হয়, আগ্রহী ক্রেতার ব্যক্তিগত ইতিহাস খতিয়ে দেখা হয় এবং লাইসেন্স দেওয়ার আগে গান-সেফটি কোর্স করানো হয়। নতুন অস্ত্রের লাইসেন্স পেতেও ২৮ দিন অপেক্ষা করতে হয় কানাডিয়ানদের। স্কুলে বন্দুক হামলার ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময়ই এআর-১৫ রাইফেল ব্যবহৃত হয়, যা মঙ্গলবার টেক্সাসের ঘটনায়ও দেখা গেছে। ফ্লোরিডা, পার্কল্যান্ড, অরোরা, কলোরাডোর বিভিন্ন উপাসনালয়ে বা সিনেমা দর্শকদের উপর এই বন্দুক দিয়ে হামলা চালাতে দেখা গেছে যুক্তরাষ্ট্রে। কিন্তু এই এআর-১৫ বন্দুকটি কানাডায় একটি 'নিয়ন্ত্রিত' অস্ত্র। সেখানে এই অস্ত্র কিনতে চাইলে ক্রেতাকে অবশ্যই বাড়তি একটি পরীক্ষায় পাস করতে হবে এবং বিশেষ লাইসেন্স নিতে হবে।

কিন্তু বারাক ওবামা যদি বন্দুক ক্রয়ের ক্ষেত্রে আরো কঠোর আইন প্রয়োগ করতেন, তাহলে কি যুক্তরাষ্ট্র উপকৃত হতো? উত্তর হবে, হয়তোবা! কারণ বিভিন্ন দেশের পরিপ্রেক্ষিতে দেখা গেছে, অস্ত্র ক্রয়ের আইনের উপর ভিত্তি করে বন্দুক হামলায় মৃত্যুর হার কমবেশি হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে এক জায়গা থেকে অন্যত্র আগ্নেয়াস্ত্র পরিবহন করা যতদিন পর্যন্ত সহজ হবে, যতদিন পর্যন্ত আইনপ্রণেতারা কঠোর নীতি বাস্তবায়নে ব্যর্থ হবেন এবং মানসিকভাবে অসুস্থদের কাছে অস্ত্র বিক্রি বন্ধ করবেন, যতদিন পর্যন্ত রাজনীতিবিদরা বন্দুক শিল্প থেকে টাকা নেওয়া চালিয়ে যাবেন, যতদিন পর্যন্ত গান লবির মাধ্যমে ডাক্তারদের চাপ দেওয়া হবে রোগীদের সঠিক পরামর্শ দিতে এবং যতদিন পর্যন্ত এআর-১৫ বন্দুকের এক বক্স গুলির দাম মাত্র ২০-৫০ ডলার থাকবে, ততদিন পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বন্দুক হামলার সমস্যা চলতেই থাকবে।

আগুন নিয়ে খেলবেন আর একবারও ঘর পুড়বে না, এটা আপনি নিশ্চিত করে বলতে পারবেন না।

Link copied!