গাজার ৫০ শতাংশ ইসরায়েলের দখলে, নিজ ভূমিতে পরবাসী ফিলিস্তিনিরা

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

এপ্রিল ৭, ২০২৫, ০৩:২০ পিএম

গাজার ৫০ শতাংশ ইসরায়েলের দখলে, নিজ ভূমিতে পরবাসী ফিলিস্তিনিরা

ছবি: সংগৃহীত

গত মার্চ মাসে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে গাজা উপত্যকায় হামলা শুরুর পর ক্রমাগতভাবে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ সম্প্রসারণ করে চলেছে দখলদার ইসরায়েল। এখন পর্যন্ত উপত্যকাটির ৫০ শতাংশ অংশ দখলে নিয়েছে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী-আইডিএফ। এতে নিজ ভূমিতে অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছেন ফিলিস্তিনিরা।

ইসরায়েলি সেনা ও মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলোর মতে, গাজা সীমান্তের আশপাশে সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকা সবচেয়ে বড় এলাকায় ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘর, কৃষিজমি এবং অবকাঠামো ধ্বংস করে দিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। এসব এলাকা এখন বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে এই সামরিক বাফার জোনের পরিধি দ্বিগুণ করা হয়েছে। খবর ইউএনবি

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর যুদ্ধ শুরুর পর থেকে সাময়িক যুদ্ধবিরতের মাধ্যমে বেশ কিছু জিম্মিকে মুক্তি দেয় হামাস। অবশিষ্ট জিম্মিদের মুক্তি দিতে হামাসকে চাপ দেওয়ার সাময়িক প্রয়োজনের অজুহাতে হামলা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি গাজার ভূমির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কড়াকড়ি আরোপ করে ইসরায়েল।

তবে মানবাধিকার গোষ্ঠী ও গাজা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইসরায়েলের দখলে থাকা অঞ্চলটির উত্তর-দক্ষিণের ভূমিকে বিভক্ত করা করিডোরটি দীর্ঘমেয়াদি নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে।

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গত সপ্তাহে বলেছেন, হামাস পরাজিত হওয়ার পরও ইসরায়েল গাজায় নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখবে এবং ফিলিস্তিনিদের সেখান থেকে চলে যেতে বাধ্য করা হবে।

পাঁচ ইসরায়েলি সেনা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসকে (এপি) জানিয়েছেন, ইসরায়েলি সীমান্তের কাছে ধ্বংসযজ্ঞ এবং বাফার জোনের ধারাবাহিক সম্প্রসারণ ১৮ মাস আগে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে চলমান।

গাজায় ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর যে দলটি ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে, তাদের সুরক্ষায় মোতায়েন করা ট্যাংক স্কোয়াডের এক সদস্য বলেন, ‘তারা যা কিছু পেয়েছে, তাই ধ্বংস করেছে। তাদের সামনে যা কিছু কার্যকর মনে করছে, তারা সেখানেও তারা গুলি করেছে ...যাতে (ফিলিস্তিনিদের) ফিরে আসার কিছুই না থাকে। তারা আর ফিরতে পারবে না, কখনই না।’ নিরাপত্তার স্বার্থে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি এবং আরও চার সেনা এপিকে এসব কথা বলেন।

সোমবার, ৭ এপ্রিল বাফার জোনে থাকা সেনাদের বিবরণ নথিভুক্ত করে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে দখলদারবিরোধী ভেটেরান্স গ্রুপ ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স। হাতেগোনা কয়েকজন সেনাদের মধ্যে কয়েকজন এপির সঙ্গে আলাপও করেছেন। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী ওই অঞ্চলটিকে একটি বিশাল পতিতভূমিতে পরিণত করছে বলে জানিয়েছেন।

গোষ্ঠীটি বলেছে, ‘ব্যাপক, পরিকল্পিত ধ্বংসযজ্ঞের মাধ্যমে সামরিক বাহিনী ভবিষ্যতে ওই এলাকায় ইসরায়েলি নিয়ন্ত্রণের ভিত্তি তৈরি করেছে।’

সৈন্যদের বিষয়ে জানতে চাইলে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী বলেছে, তারা তার দেশকে রক্ষার জন্য এবং বিশেষত ৭ অক্টোবরের হামলায় বিধ্বস্ত দক্ষিণাঞ্চলীয় সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা উন্নত করতে কাজ করছে। ওই হামলায় প্রায় ১ হাজার ২০০ জন ইসরায়েলি নিহত হন। এছাড়া ২৫১ জনকে জিম্মি করে নিয়ে যায় হামাস।

বিভক্ত গাজা

ব্রেকিং দ্য সাইলেন্সের মতে, যুদ্ধের প্রথমদিকে ইসরায়েলি সেনারা সীমান্তের নিকটবর্তী গাজার এক কিলোমিটারের বেশি এলাকায় বাস করা ফিলিস্তিনিদের জোর করে সরিয়ে একটি বাফার জোন তৈরি করতে সেখানে থাকা সব স্থাপনা ধ্বংস করে দিয়েছে।

ইসরায়েলি সৈন্যরা ‘নেতজারিম করিডোর’ নামে পরিচিত গাজার একটি বিশাল ভূমিও দখল করেছে। এই করিডোরটি গাজা সিটিসহ উত্তরাঞ্চলকে সংকীর্ণ ও উপকূলীয় উপত্যকাটির বাকি অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। গোটা গাজা উপত্যকাটিতে ২০ লাখের বেশি মানুষের আবাসস্থল।  

ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর প্রকাশ করা একটি মানচিত্রে দেখা যায়, গত মাসে ইসরায়েল যখন যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে পুনরায় হামলা শুরু করে, তখন এটি বাফার জোনের আকার দ্বিগুণ করেছে। কিছু জায়গায় এটি গাজার অভ্যন্তরে তিন কিলোমিটার (১.৮ মাইল) পর্যন্ত দখলে নেয়।

বেন গুরিয়ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশগত গবেষণার অধ্যাপক ইয়াকভ গার্ব বলেন, বাফার জোন এবং নেতজারিম করিডোর উপত্যকাটির কমপক্ষে ৫০ শতাংশ এলাকা নিয়ে গঠিত। এই অধ্যাপক কয়েক দশক ধরে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনি ভূমি ব্যবহারের ধরন পরীক্ষা করে আসছেন।  

গত সপ্তাহে নেতানিয়াহু বলেছিলেন, ইসরায়েল দক্ষিণ গাজায় আরেকটি করিডোর তৈরি করতে চায়যা রাফাহ শহরকে অন্যান্য অঞ্চল থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে। গাজায় ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণ আরও বাড়বে। গাজার ওই অঞ্চলে সম্প্রতি পরিকল্পিত হামলার আগে বেসামরিক নাগরিকদের সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে তারা।

বাফার জোন ‘কিল জোন’, দাবি সেনাদের

সৈন্যরা বলেছে, বাফার জোনের কোনো নির্দিষ্ট সীমানা নেই। তবে এসব এলাকায় যে ফিলিস্তিনিরা প্রবেশ করেছিলেন, তাদের গুলি করা হয়েছে।

ট্যাংক স্কোয়াডে থাকা ওই সেনা কর্মকর্তা বলেন, একটি সাঁজোয়া বুলডোজার ভূমি সম্প্রসারণ করে একটি ‘কিল জোন’ তৈরি করেছে। ট্যাংকের ৫০০ মিটারের মধ্যে কেউ এলে, তাকে গুলি করা হয়। যাদের মধ্যে নারী ও শিশুও রয়েছে। 

কম্পিত ও ভীত অবস্থায় তিনি বলেন, ‘অনেক সেনা ৭ অক্টোবরের হামলার প্রতিশোধ নিতে এ কাজ করেছে।’

তিনি বলেন, ‘আমি এখানে এসেছি, কারণ তারা আমাদের হত্যা করেছে। এখন আমরা তাদের হত্যা করতে এসেছি। আমি বুঝতে পারছি যে, আমরা কেবল তাদের হত্যা করছি না, আমরা তাদের স্ত্রী, শিশু, বিড়াল, কুকুরকে হত্যা করছি। ধ্বংস করছি তাদের বাড়িঘর।’

সেনাবাহিনী বলেছে, ‘যতটা সম্ভব বেসামরিক নাগরিকদের ক্ষতি এড়াতে’ গোয়েন্দা তথ্যের উপর ভিত্তি করে তারা আক্রমণগুলো চালাচ্ছেন।

এদিকে ২০২৩ সালের পর থেকে ইসরায়েলি হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন ৫০ হাজার ৬৯৫ জন ফিলিস্তিনি, যাদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু। আর পোলিও টিকার অভাবে গাজার ৬ লাখ ২ হাজার শিশু স্থায়ীভাবে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে।

Link copied!