ডিসেম্বর ১৯, ২০২৪, ০৪:৫০ পিএম
ভারত সরকারের কাছ থেকে পাওয়া কর ছাড় সুবিধার কথা গোপন করে দেশটির বিদ্যুৎ সরবরাহকারী কোম্পানি আদানি পাওয়ার চুক্তি লঙ্ঘন করেছে বলে অভিযোগ করেছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার।
পিডিবি কর্মকর্তাদের বরাতে রয়টার্স লিখেছে, কর সুবিধা পাওয়ার বিষয়টি ‘দ্রুত সময়ের মধ্যে’ বাংলাদেশকে জানানোর কথা থাকলেও তা করেনি আদানি। ভারতীয় ওই কোম্পানি তাদের দেশে যে কর ছাড় পেয়েছে, সে অনুযায়ী বিদ্যুতের দাম ধরা হলে বাংলাদেশের ২৮.৬ মিলিয়ন ডলার সাশ্রয় হওয়ার কথা।
বিদ্যুৎ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান রয়টার্সকে বলেছেন, এই সাশ্রয়ের বিষয়টিই ভবিষ্যত আদানি পাওয়ারের সঙ্গে আলোচনার মূল বিষয়বস্তু হবে।
ধনকুবের গৌতম আদানির এই কোম্পানি ভারতের পূর্বাঞ্চলে ঝাড়খণ্ডের কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য ২০১৭ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) নথিপত্র এবং দুই পক্ষের চিঠি চালাচালি এবং পিডিবির ছয় কর্মকর্তার সাক্ষাৎকার পর্যালোচনা করে রয়টার্স এক প্রতিবেদনে বলেছে, কোনো ধরনের দরপত্র প্রক্রিয়া ছাড়াই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে চুক্তি করেছিলেন, তার ব্যয় কয়লা বিদ্যুতের অন্যান্য চুক্তির তুলনায় অনেক বেশি। ওই চুক্তি নিয়ে পুনরায় আলোচনার বিষয়ে এখন আশাবাদী বাংলাদেশ।
বিদ্যুৎ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান রয়টার্সকে বলেছেন, আদানির সরবরাহ ছাড়াই বাংলাদেশের এখন যথেষ্ট উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে, যদিও সব দেশীয় বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু নেই।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হন, যার বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের ‘কণ্ঠরোধ’ এবং অর্থনৈতিক ‘অব্যবস্থাপনার’ অভিযোগ উঠেছে। তিনি গত দুই দশকের বেশির ভাগ সময় বাংলাদেশ শাসন করেছেন এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ‘ঘনিষ্ঠ মিত্র’ ছিলেন। তার ক্ষমতাচ্যুতির পর শান্তিতে নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শাসনভার নিয়েছে।
কর ছাড় নিয়ে আদানি যে চুক্তি লঙ্ঘন করেছে, সে বিষয়টি প্রথম সামনে আনে রয়টার্স। ২৫ বছরের ওই বিদ্যুৎ চুক্তি পর্যালোচনার বিষয়ে বাংলাদেশের পরিকল্পনা সম্পর্কেও বিশদ তথ্য প্রকাশ করার কথা জানিয়ে বার্তা সংস্থাটি লিখেছে, গত নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রে সাড়ে ২৬ কোটি ডলার ঘুষ দেওয়ার মামলায় আদানি ও তার সাত নির্বাহীকে অভিযুক্ত করার ঘটনা তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের করা চুক্তি পর্যালোচনায় চাপ তৈরি করতে পারে।
রয়টার্সের প্রশ্নের জবাবে আদানি পাওয়ারের একজন মুখপাত্র বলেছেন, তারা চুক্তির সব বাধ্যবাধকতা ‘রক্ষা’ করেছেন এবং ঢাকা চুক্তি পর্যালোচনা করছে এমন কোনো ইঙ্গিত তারা পাননি।
কর সুবিধা ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে বাংলাদেশ যেসব অভিযোগ তুলেছে, তার উত্তর দেয়নি আদানি গ্রুপ। অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগকে তারা ‘ভিত্তিহীন’ বলে উড়িয়ে দিচ্ছে।
কর ছাড়
আদানি পাওয়ারের গড্ডা কেন্দ্রটি চলে আমদানি করা কয়লা দিয়ে, আর এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করাই হয়েছিল বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য।
কোম্পানিটি বলছে, বাংলাদেশের সঙ্গে যে চুক্তি হয়েছে, তা ভারতের ‘পররাষ্ট্র নীতির লক্ষ্যগুলোকে’ আরও এগিয়ে নিতে সহায়তা করেছে।
দিল্লি ২০১৯ সালে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রকে একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের অংশ ঘোষণা করে। সেই সুবাদে আয়কর এবং অন্যান্য শুল্কের ক্ষেত্রে ছাড় পাচ্ছে আদানি পাওয়ার।
রয়টার্স লিখেছে, আদানি পাওয়ার ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) মধ্যে ২০১৭ সালের ৫ নভেম্বর যে চুক্তি ও বাস্তবায়ন চুক্তি হয়, সে অনুযায়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রের করহার পরিবর্তন হলে তা বাংলাদেশকে দ্রুত অবহিত করার কথা এবং ভারত সরকারের কাছ থেকে ‘কর ছাড়ের সুবিধা’ পাস করিয়ে নেওয়ার কথা।
কিন্তু আদানি পাওয়ার তা করেনি বলে গত ১৭ সেপ্টেম্বর ও ২২ অক্টোবর চিঠি দিয়ে পিডিবি বলেছে, আদানি যে কর সুবিধা ভারত সরকারের কাছ থেকে পেয়েছে, তা যেন বাংলাদেশের বিদ্যুতের দামের ক্ষেত্রে সমন্বয় করা হয়।
এসব চুক্তি ও চিঠি প্রকাশ্যে না এলেও সেসব দেখার কথা জানিয়েছে রয়টার্স। পিডিবির দুজন কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেছেন, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে দেওয়া চিঠির বিষয়ে তারা এখনো আদানির সাড়া পাননি।
পিডিবির হিসাব অনুযায়ী, আদানি তাদের দেশে যে কর ছাড় পেয়েছে, সে অনুযায়ী বিদ্যুতের দাম ধরা হলে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দামে বাংলাদেশের সাশ্রয় হবে প্রায় শূন্য দশমিক ৩৫ সেন্ট।
বাংলাদেশ সরকারের বিদ্যুৎ কেনার একটি সারসংক্ষেপও দেখার কথা লিখেছে রয়টার্স। সেই তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত গড্ডা কেন্দ্র ৮.১৬ বিলিয়ন ইউনিট বিদ্যুৎ সরবরাহ করেছে। তাতে কর ছাড়ের বিষয়টি সমন্বয় করলে বাংলাদেশের প্রায় ২৮.৬ মিলিয়ন ডলার সাশ্রয় হওয়ার কথা।
‘তাড়াহুড়োর চুক্তি’
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিদ্যুৎ সংকট দ্রুত সমাধানের লক্ষ্যে বেশ কয়েকটি ভাড়া ও দ্রুত ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দেওয়া হয়। তবে এসব কেন্দ্র থেকে উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ কিনতে সরকারকে অনেক টাকা ভর্তুকি দিতে হয়, যা আসে করদাতাদের পকেট থেকে। ফলে বিষয়টি নিয়ে সমালোচনাও রয়েছে।
এসব ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রকে বৈধতা দিতে ২০১০ সালে প্রণয়ন করা হয় ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন’। শুরুতে দুই বছরের জন্য এ আইন করা হলেও পরে কয়েক দফায় সময় বাড়ানো হয়। আদালতের আদেশে গত ৩০ নভেম্বর আইনটি বাতিল করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।
অস্ট্রেলিয়ার গবেষণা সংস্থা ক্লাইমেট এনার্জি ফাইন্যান্সের পরিচালক টিম বাকলে বলেন, আদানির সঙ্গে চুক্তির ক্ষেত্রে দরপত্র প্রক্রিয়া না থাকাটা অস্বাভাবিক। সাধারণত নিলাম ‘বাস্তবিক সেরা দাম’ নিশ্চিত করে।
শেখ হাসিনার আমলে স্বাক্ষরিত বড় বড় জ্বালানি চুক্তি পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য গত সেপ্টেম্বরে বিশেষজ্ঞদের প্যানেল গঠন করে ইউনূস সরকার। এর বাইরে বাংলাদেশের উচ্চ আদালত আদানি চুক্তি খতিয়ে দেখার নির্দেশ দিয়েছে।
অর্থনীতির হাল হকিকত জানাতে গঠিত একটি কমিশন গত ১ ডিসেম্বর অধ্যাপক ইউনূসের কাছে জমা দেওয়া এক শ্বেতপত্রে বলেছে, আদানির বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে অভিযোগ গঠনের অর্থ হচ্ছে, বাংলাদেশেরও উচিত বিদ্যুৎ চুক্তিটি পর্যালোচনা করা।
চুক্তিটি করার সময় ‘তাড়াহুড়া’ করা হয়েছে বলেও মনে করে শ্বেতপত্র কমিটি।
ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান। তারপর আর তাকে প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। তার ছেলে ও উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় রয়টার্সকে বলেছেন, আদানি বিদ্যুৎ চুক্তি সম্পর্কে তিনি ওয়াকিবহাল নন, কিন্তু ‘কোনো দুর্নীতি যে হয়নি’, সে সম্পর্কে তিনি নিশ্চিত।
রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের অভিযোগের জবাবে তিনি বলেন, “আমি কেবল ধরে নিতে পারি যে ভারত সরকার এই চুক্তির জন্য তদবির করেছিল, তাই এটি করা হয়েছিল।”
এ বিষয়ে বক্তব্যের জন্য রয়টার্সের অনুরোধে মোদীর দপ্তর এবং ভারতীয় অন্য কর্মকর্তারা সাড়া দেয়নি।
টানাপড়েন
বকেয়া অর্থ নিয়ে বিরোধের জেরে ৩১ অক্টোবর গড্ডা থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ অর্ধেক করে দেয় আদানি পাওয়ার।
আদানি পাওয়ারের ১ জুলাইয়ের একটি চিঠি দেখেছে রয়টার্স, যাতে বিদ্যুতের মূল্যছাড় অব্যাহত রাখতে পিডিবির অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। আদানি পাওয়ার মে মাস পর্যন্ত ওই মূল্যছাড় সুবিধা বাংলাদেশকে দিয়েছিল, যাতে বাংলাদেশের প্রায় ১৩ মিলিয়ন ডলার সাশ্রয় হয়।
সেই সুবিধা অব্যাহত রাখার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে পিডিবিতে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, বকেয়া অর্থ পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত তারা আর কোনো ডিসকাউন্ট দেবে না।
আদানি পাওয়ারের দাবি, বাংলাদেশের কাছে তাদের পাওনা ৯০ কোটি ডলার। অন্যদিকে পিডিবি বলছে, বকেয়ার পরিমাণ প্রায় ৬৫ কোটি ডলার। বকেয়া পরিশোধের জন্য পর্যাপ্ত ডলার তারা পাচ্ছে না।
পিডিবির চেয়ারম্যান রেজাউল করিম রয়টার্সকে বলেন, আদানি বিদ্যুৎ সরবরাহ কমিয়ে দেওয়ায় বাংলাদেশ ক্ষুব্ধ হয়েছে। কারণ অক্টোবরে আদানি পাওয়ারকে ৯ কোটি ৭০ লাখ ডলার পাঠানো হয়েছে, যা মাসের বিচারে এ বছরের সর্বোচ্চ।
২০১৭ সালের চুক্তিতে গড়ে দুটি সূচকের ওপর ভর করে বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারণের যে ফর্মুলা করা হয়েছে, তা নিয়ে বিতর্ক এখন তুঙ্গে।
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ কেনার সারসংক্ষেপ অনুসারে, গড্ডা থেকে সরবারাহ করা বিদ্যুতের প্রতি ইউনিটের যে দর ধরা হয় তা ভারত থেকে বাংলাদেশে বেচা সব বিদ্যুতের গড়ের চেয়ে ৫৫% বেশি।
পিডিবির তিনটি সূত্র রয়টার্সকে বলেছে, দর নির্ধারণের একটি সূচক গত বছর সংশোধনের পর এখন দাম কমাতে অন্য মানদণ্ড ব্যবহারে আদানি পাওয়ারকে চাপ দিচ্ছে বাংলাদেশ।
তবে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে আদানি পাওয়ার। কোম্পানির একজন রয়টার্সকে বলেছেন, এ নিয়ে শিগগিরই দুই পক্ষ বৈঠকে বসবে।
চুক্তি নিয়ে সিঙ্গাপুরে সালিশ করার কথা থাকলেও ফাওজুল কবির খান রয়টার্সকে বলেছেন, আদালতের নির্দেশে যে তদন্ত চলছে তার ওপরও বাংলাদেশের পরবর্তী পদক্ষেপ নির্ভর করছে।
“যদি ঘুষ বা অনিয়মের প্রমাণ মেলে, তাহলে চুক্তি বাতিল প্রশ্নে আদালতের আদেশ আমাদের মানতে হবে।”