আরাকান আর্মির হামলায় নাফ নদে শত শত রোহিঙ্গা নিহত

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

সেপ্টেম্বর ৩, ২০২৫, ০২:৫৮ পিএম

আরাকান আর্মির হামলায় নাফ নদে শত শত রোহিঙ্গা নিহত

ছবি: সংগৃহীত

মিয়ানমারে থাকা অবশিষ্ট রোহিঙ্গাদের ওপর আবারও ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে নির্যাতন শুরু হয়। এবার মিয়ানমার সেনাবাহিনীর পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের নির্যাতনকারী দলে যোগ দেয় আরাকান আর্মিও। উভয়ের নির্যাতন থেকে রক্ষা পেতে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট নাফ নদ পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করে হাজারো রোহিঙ্গা। তবে ড্রোন ও আর্টিলারি হামলায় সেদিন শত শত রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন। 

গতকাল মঙ্গলবার জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের মিয়ানমার নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে এমন তথ্য ওঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, রাখাইন রাজ্যে ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে সংঘাত বাড়তে থাকে, যা সেখানে বসবাসরত রোহিঙ্গাসহ সব জাতিগোষ্ঠীর নিরাপত্তার উদ্বেগ সৃষ্টি করে। উন্মুক্ত সূত্র অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত রাখাইনে ৪০৯টি বিমান এবং ২৭৪টি আর্টিলারি হামলাসহ কমপক্ষে এক হাজার ৬৩৩টি সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে। নির্ভরযোগ্য তথ্য অনুযায়ী, কমপক্ষে ৩৭৪ বেসামরিক নাগরিক হতাহত হয়েছেন। রাখাইনে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে পশ্চিমা সামরিক কমান্ড দখলে নেয় আরাকান আর্মি। একাধিক সূত্র মংডু শহরে গত বছরের ৫ আগস্টের ঘটনাগুলোর ধারাবাহিক বিবরণ দিয়েছে। যুদ্ধ থেকে বাঁচতে এবং বাংলাদেশে পালানোর আশায় সেই সময় হাজারো রোহিঙ্গা শহরটির পশ্চিমে নাফ নদের তীরে জড়ো হয়েছিলেন। সেদিন বিকেলে শুরু হওয়া ড্রোন ও আর্টিলারি হামলায় সম্ভবত শত শত রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়।

এক প্রত্যক্ষদর্শী রোহিঙ্গা বলেছেন, যারা পথে ও গ্রামে ছিলেন, তারা আটকা পড়েছিলেন। আর যারা নদের তীরে ছিলেন, তারাও আটকা পড়েছিলেন। সে সময় নদের তীরে ১০ থেকে ১২ হাজার মানুষ ছিলেন। সেখানে অনেকেই মারা গেছেন। আমরা যেখানে লুকিয়ে ছিলাম, সেখান থেকে সর্বত্র মৃতদেহ দেখতে পাচ্ছিলাম।

একজন বেঁচে যাওয়া ব্যক্তি জানিয়েছেন, তারা যে নৌকা করে বাংলাদেশের দিকে যাচ্ছিলেন, সেটি ড্রোন হামলার শিকার হয়েছিল। তিন শিশুসহ ৪৬ বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছিলেন। যদিও আরাকান আর্মি ‘চরমপন্থি মুসলিম সশস্ত্র গোষ্ঠী’কে এ হামলার জন্য দায়ী করেছে। তবে বেঁচে ফেরা রোহিঙ্গারা আরাকান আর্মিকে দায়ী করে।

তারা জানিয়েছেন, হামলাকারী ড্রোনগুলো আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রিত এলাকা থেকে এসেছিল, যেখানে সামরিক বাহিনী উপস্থিত ছিল না। ৬ আগস্টও পালিয়ে যাওয়াদের ওপর ড্রোন হামলা অব্যাহত ছিল। একজন বর্ণনা করেছেন, তিনি ৫০ জন নিয়ে একটি নৌকায় ছিলেন। যখন এটিতে হামলা চালানো হয়, এতে চার শিশুসহ ৩৮ জন নিহত হন।

গত মের আগের ১৪ মাসে সামরিক বাহিনীর বিমান হামলার কারণে কমপক্ষে ৮৩৮ বেসামরিক নাগরিক মারা যান। এ সময় নিহতের সংখ্যা এক হাজার ৮১১। এ সময় দুটি উদ্বেগজনক নতুন ধরনের হামলার ধরন চিহ্নিত করা হয়েছে। একটি হচ্ছে, ছয়টি রাজ্যে বিস্ফোরকের সঙ্গে সার মিশিয়ে রাসায়নিক অস্ত্র তৈরি করে মিয়ানমারের নাগরিকদের ওপর ব্যবহারের ২৬টি অভিযোগ উঠেছে। আরেকটি হলো, নিচ দিয়ে উড়তে সক্ষম বিমানের সাহায্যে বেসামরিক এলাকায় বোমা হামলা করা হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থান এবং গত ২০ আগস্টের মধ্যে বিশ্বাসযোগ্য সূত্র অনুযায়ী সামরিক বাহিনীর হাতে প্রায় সাত হাজার ১০০ জন নিহত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত। যার মধ্যে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ নারী ও শিশু। রাজনৈতিক কারণে অন্তত ২৯ হাজার ৫৬০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং সামরিক নিয়ন্ত্রিত আদালতের মাধ্যমে ২২ হাজারেরও বেশি মানুষ এখনও আটক রয়েছেন।

রাখাইনে সংঘাত তীব্র হওয়ার পর আরও কয়েক লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। জাতিসংঘ অনুমান করে, ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে প্রায় দেড় লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।

জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক বলেন, রোহিঙ্গা এবং জাতিগত রাখাইন উভয় সম্প্রদায়ের বেসামরিক নাগরিকরা শত্রুতার পরিণতি ভোগ করে চলেছে। বেসামরিক মানুষ এবং সুরক্ষিত স্থানগুলোতে নির্বিচারে হামলা, জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি, গুম, নির্বিচারে গ্রেপ্তার, অগ্নিসংযোগ ও সম্পত্তি ধ্বংস, মানবিক সহায়তা দিতে অস্বীকার এবং জনগণকে ভয় দেখানোর লক্ষ্যে নৃশংসতা অব্যাহত রেখেছে মিয়ানমার সামরিক বাহিনী। 

তিনি বলেন, সামরিক বাহিনী এবং আরাকান আর্মি প্রায় সম্পূর্ণ দায়মুক্তি নিয়ে কাজ করেছে। ফলে বেসামরিক জনগণের জন্য দুর্ভোগের এক অন্তহীন চক্রে লঙ্ঘনগুলো পুনরাবৃত্ত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন এবং প্রচলিত দায়মুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে নিরাপত্তা পরিষদে মিয়ানমার পরিস্থিতিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে সম্পূর্ণভাবে প্রস্তাব করার জন্য পূর্বের আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেছেন হাইকমিশনার।

Link copied!