গাজার প্রথম নারী সার্জনের বেঁচে থাকাই এখন একমাত্র স্বপ্ন

বিবিসি

ডিসেম্বর ১৫, ২০২৩, ০৬:৫৭ পিএম

গাজার প্রথম নারী সার্জনের বেঁচে থাকাই এখন একমাত্র স্বপ্ন

ছবি: সংগৃহীত

সারা আল–সাক্কা গত আগস্টে সার্জন হয়ে দেশে ইতিহাস গড়েছেন। কারণ, তিনি গাজার প্রথম নারী সার্জন। সেদিন ৩১ বছর বয়সী এই নারী বলেছিলেন, স্বাস্থ্যসেবা খাতের উন্নয়নে তিনি অনেক কিছু করতে চান। তাঁর অনেক স্বপ্ন। একদিন নিজের একটি ক্লিনিক হবে।

কিন্তু আট সপ্তাহ পরই যেন সারার জীবনের স্বপ্নগুলো হারিয়ে গেছে। জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়াল শুধু বেঁচে থাকা। সারা বলেন, ‘আমার এখন একটাই চাওয়া। সবারই পছন্দের অগ্রাধিকার তালিকা পরিবর্তন হয়। আমরাও তেমন অবস্থা। এখন আমি শুধু বেঁচে থাকার কথাই চিন্তা করি’।

সারা স্নাতক শেষ করার পর থেকে উপত্যকার উত্তরে সবচেয়ে বড় হাসপাতাল আল-শিফাতে কাজ করছেন। ৭ অক্টোবর ছিল তাঁর সাপ্তাহিক ছুটি। তাঁর মনে আছে, সেদিন ১৭ বছর বয়সী তাঁর ছোট বোন স্কুলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এরই মধ্যে চারপাশ থেকে শুধু বোমা হামলার তীব্র শব্দ আসছিল। আতঙ্কে বোনকে আর সেদিন স্কুলে যেতে দেননি।

এরপর সারা তাঁর মুঠোফোন হাতে নিতেই ইসরায়েলে হামাসের হামলার খবর দেখেন। তারা ১ হাজার ২০০ মানুষকে হত্যা করেছে ও ২৪০ জনকে বন্দী করে গাজায় নিয়ে এসেছে। এরপর থেকে ইসরায়েল অবিরাম গাজায় বিমান হামলা ও স্থলভাগে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। উপত্যকার বিশাল অংশকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে। ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, এরই মধ্যে গাজায় নিহত মানুষের সংখ্যা ১৮ হাজার ছাড়িয়েছে।

ইসরায়েল যখন বিমান হামলা শুরু করল, তখন তারা গাজাবাসীকে উত্তর থেকে দক্ষিণে গাজায় নিরাপদ স্থানে সরে যেতে বলে। কিন্তু সারা থেকে যান। তিনি বলেন, ‘কোনো ধরনের বিরতি না নিয়ে, বাড়ি না গিয়ে আমরা ৩৪ দিন টানা কাজ করে গেছি।’

পরিস্থিত কত দ্রুত খারাপ হয়ে গেল, সেই বর্ণনা দিতে গিয়ে সারা বলেন, প্রতিটি বোমা হামলার পর শত শত রোগীর ঢল নামত।  অথচ তাঁদের সবাইকে চিকিৎসা দেওয়া ছিল অসম্ভব। অনেকেই হাসপাতালে থাকাটাকে বেশি নিরাপদ মনে করতেন। হাসপাতালে যেখানে জায়গা পেয়েছেন, সেখানেই লোকজন ঠাঁই নিয়েছিলেন। বারান্দায় রান্না করে খাচ্ছিলেন, মেঝেতে ও আলমারিতে ঘুমাচ্ছিলেন। বাচ্চাদের খেলাধুলার মাধ্যমে ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করছিলেন।

রোগীদের ওষুধ ও জীবাণুমুক্ত গ্লাভসের মতো মৌলিক জিনিসগুলো জোগাতে হাসপাতালটিকে বেশ বেগ পেতে হয়। কোন রোগীর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বেশি, তার ভিত্তিতে সেই রোগীকে অগ্রাধিকার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল সারাকে। তিনি বলেন, ‘আমাদের হাতে যা ছিল, তা দিয়ে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। তারপরও এত নিরপরাধ জীবন বাঁচাতে পারিনি, এটি আমাকে কুড়ে কুড়ে খায়।’

এত দুঃখ–বেদনার মধ্যেও টুকরা টুকরা সুখের ঘটনা ঘটেছে সারার জীবনে। এই পরিস্থিতিতে সারার হাত দিয়ে প্রথমবারের মতো এক নবজাতক পৃথিবীতে আসে। তবে তার আগে সেই প্রসূতি মা ও সারা অস্ত্রোপচার কক্ষে এক রাত আটকা পড়েছিলেন। কারণ বাইরে তখন বোমা পড়ছিল।  

সারা একজন গাইনোকোলিজস্টকে অস্ত্রোপচার কক্ষে রাখতে মরিয়া হয়ে চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু কেউ আসেনি। এরপর আর অপেক্ষার সময় ছিল না তাঁর হাতে। তিনি বলেন, ‘আমি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলাম। বললাম, হে আল্লাহ আমাকে সাহায্য করুন। মা ও সন্তানকে রক্ষা করুন।’

শিশুটির নাভির সাথে যুক্ত নাড়িটি গলায় পেঁচিয়ে ছিল। কিন্তু সারা সেটি সরাতে পেরেছিলেন। সদ্যোজাত শিশুটিকে নিরাপদে পৃথিবীতে নিয়ে আসেন। পরে ওই মা নিজের মেয়ের নাম রাখেন চিকিৎসক সারার নামেই।

রোগীর সেবা করতে করতে সারার ব্যক্তিজীবনে কঠিন সময় আসে। পরিবারের সাথে তাঁর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। যখন ফোন লাইন ও ইন্টারনেট সেবা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তখন তাঁর মা, দাদি, চার ভাই-বোন সর্ব দক্ষিণের মিসর সীমান্তবর্তী শহর রাফার পথে। অথচ তিনি জানতেও পারছিলেন না, তারা বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে। সারা বলেন,  ‘আমি কিছুই করতে পারছিলাম না। ভয় হচ্ছিল তারা হয়তো বোমা হামলার শিকার হতে পারেন।’

সংঘর্ষ তীব্র হতে শুরু করল। এর মধ্যে তিনি খবর পেলেন, তাঁর পরিবারের সদস্যরা নিরাপদে আছেন। তখন সারার সামনে অন্য ধরনের চ্যালেঞ্জ। সারা বলেন, ‘খাবার ও পানি ফুরিয়ে গেছে। গত সপ্তাহে সেখানে বিদ্যুৎও ছিল না...সেখানে আমরা কোনোরকমে টিকে ছিলাম। সেখানে খাবার হিসেবে ছোট্ট এক টুকরো রুটি পাওয়াও হয়ে ওঠে আনন্দের উৎস।’

বিদ্যুৎহীন অবস্থায় টর্চবাতির সাহায্যে সারা অস্ত্রোপচার করেছেন। সেই সময়টাকে তিনি তাঁর জীবনের সবচেয়ে বাজে সময় বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, এটি দোজখে থাকার মতো।

হাসপাতালে কাছাকাছি এলাকায় বোমা হামলা শুরু হলে এবং ইসরায়েল এই হাসপাতালে অভিযান চালাতে পারে নিশ্চিত হওয়ার পর সারা বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। তিনি বলেন, তাঁর মনে হচ্ছিল এখানে থাকলেই তাঁর মৃত্যু হবে। তাই তিনি এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়া সিদ্ধান্ত নেন। এবং দক্ষিণে রাফায় পরিবারের কাছে চলে যান। তারা এখন সেখানে তাঁর চাচার কাছে আছেন।

তবে সারা হাসপাতাল ছাড়ার সময় একা যাননি। তাঁর সাথে ছিলেন সহকর্মীরা ও সেই মা ও নবজাতক।

‘হামাসের কথা বলে’ ইসরায়েল উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এই হাসপাতালে হামলা করে। ইসরায়েলের ভাষ্য, হামাস  হাসপাতালটিকে নিজেদের কর্মকাণ্ড পরিচালানায় ব্যবহার করছিল। তবে হামাস সেই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

নিজের মতো বাস্তুচ্যুস্ত লাখো গাজাবাসীর জীবনের দুর্বিষহ দিনগুলোর কথা স্মরণ করে সারা বলেন, ‘আমাদের খাবার নেই, পানি নেই । থাকার ঘরও নেই। আমরা পরিত্যক্ত। আমরা রাস্তায়, স্কুলে ও স্কয়ারে বসে আছি। শীত এসেছে। কিন্তু আমাদের শীতের কাপড় নেই, কম্বল নেই।’

তবে সারা এখনো সুযোগ পেলেই চিকিৎসা সেবা চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা প্রতিদিন বাইরে যাই। চারপাশে ঘুরে ঘুরে যতটা পারি মানুষকে সাহায্য করি। কারণ, আশ্রয় কেন্দ্র ও স্কুলগুলোতে ঠাঁই নেওয়া মানুষের আমাদের বড় প্রয়োজন।’

সারা ও তাঁর পরিবারের জন্য কী ধরনের ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে, সেটা ভেবে উদ্বিগ্ন তিনি। সারা বলেন, অন্যদের মতো তাদের আশা ও স্বপ্নগুলোর জায়গা এখন দখল করে নিয়েছে শুধু বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা।

২০২৩ সালে বিশ্বজুড়ে নানা কাজে আলোচিত ১০০ প্রভাবশালী ও অনুপ্রেরণাদায়ী নারীর তালিকা প্রকাশ করেছে ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসি। ‘বিবিসি ১০০ নারী ২০২৩’ শীর্ষক এই তালিকায় নারীদের গল্প, নারীর এগিয়ে যাওয়া, পৃথিবীর নানা সমস্যা-সংকটে তাঁদের আলোচিত ভূমিকার বিষয়টি তুলে ধরা হয়। তাঁদের একজন সারা। বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস ল্যাঙ্গুয়েজ টিম ও বিবিসি মিডিয়া অ্যাকশন এই তালিকার আলোচিত নারীদের তথ্য সংগ্রহ করে।

বিবিসির তথ্যমতে, গাজার প্রথম ফিলিস্তিনি নারী শল্যবিদ (সার্জন) ডা. সারা আল-সাক্কা সেখানকার বৃহত্তম হাসপাতাল আল-শিফাতে কাজ করেন। যুদ্ধের মাঝামাঝি থেকে তাঁর অভিজ্ঞতা নথিভুক্ত করতে তিনি ইনস্টাগ্রাম ব্যবহার করছেন। ইসরায়েল হামাসের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালালে আল-শিফা হাসপাতাল মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সারা বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পানি ও খাবারের অভাব নিয়ে পোস্ট করেন। সারা গাজার ইসলামিক ইউনিভার্সিটিতে মেডিসিন ও লন্ডনের কুইন মেরি ইউনিভার্সিটিতে সার্জারি নিয়ে পড়াশোনা করেছেন।

Link copied!