যে কারণে ১৪ জন টিভি উপস্থাপককে একসাথে বয়কট করল ভারত

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

সেপ্টেম্বর ১৬, ২০২৩, ০৩:০৬ পিএম

যে কারণে ১৪ জন টিভি উপস্থাপককে একসাথে বয়কট করল ভারত

ছবি: বিবিসি

ভারতের বিরোধী দলীয় জোট ‘ইন্ডিয়া’ জানিয়েছে যে তারা জাতীয় টেলিভিশনের ১৪জন অ্যাঙ্করের অনুষ্ঠান এখন থেকে বয়কট করবে। ওই ১৪ জনের মধ্যে অর্ণব গোস্বামীর নামও রয়েছে।

কোনও রাজনৈতিক গোষ্ঠী একসঙ্গে এতজন সংবাদ উপস্থাপকের অনুষ্ঠান বয়কট করছে এবং সেই সিদ্ধান্ত আনুষ্ঠানিক ভাবে জানাচ্ছে, এরকম ঘটনা ভারতে বিরল।

‘ইন্ডিয়া’ জোট বলছে ওই ১৪ জন উপস্থাপক তাদের সংবাদ-ভিত্তিক বিতর্ক অনুষ্ঠানগুলির মাধ্যমে আসলে ‘ঘৃণা’ ছড়ান।

যেসব উপস্থাপককে বয়কট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ‘ইন্ডিয়া’ জোট, তাদের সাধারণভাবে ‘গোদী মিডিয়া’ বলে চিহ্নিত করে বিরোধীদলগুলি, কারণ, তারা মনে করে ওইসব উপস্থাপকরা এবং তাদের চ্যানেলগুলি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সমর্থক।

বিজেপি এবং সাংবাদিকদের সংগঠনগুলি বিরোধী জোটের এধরনের সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। যেসব উপস্থাপকদের বয়কট করার কথা জানিয়েছে ‘ইন্ডিয়া’ জোট, তাদের অনেকেও সামাজিক মাধ্যমে এই ঘোষণার প্রতিবাদ করছেন।

আবার কয়েকজন উপস্থাপক এবং সিনিয়র সাংবাদিক নাম উল্লেখ না করার শর্তে এটা স্বীকার করছেন ওই ১৪ জন সংবাদ উপস্থাপকদের অনুষ্ঠানগুলি দেখলে এটা মনে হয় যে তারা ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ নিয়েই কথা বলেন এবং বিরোধীদলের প্রতিনিধিদের হেনস্থা করার জন্যই যেন ডাকা হয়, তা সত্ত্বেও এভাবে আনুষ্ঠানিক বয়কট করা কোনও রাজনৈতিক গোষ্ঠীর পক্ষেই অনুচিত এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপরে হস্তক্ষেপ।

কেন উপস্থাপকদের বয়কট?

‘ইন্ডিয়া’ জোটের পক্ষ থেকে ১৪ জন উপস্থাপকের অনুষ্ঠান বয়কট করার কথা ঘোষণা করে কংগ্রেস নেতা পবন খেরা বলেন, “প্রতি সন্ধ্যায় পাঁচটা বাজলেই কয়েকটি চ্যানেলে ঘৃণা ছড়ানোর বাজার বসে যায়। বিগত নয় বছর ধরে এটাই চলছে। বিভিন্ন দলের কয়েকজন মুখপাত্র ওই বাজারে যান, কয়েকজন বিশেষজ্ঞ, কয়েকজন বিশ্লেষক থাকেন... কিন্তু সত্যটা হল এটাই যে আমরা সবাই ওই ঘৃণার বাজারের ক্রেতা হয়ে হাজির হই।”

তার কথায়, “আমরা এই ঘৃণার ন্যারেটিভ চালানোর অনুমোদন দিতে পারি না। এই ন্যারেটিভ সমাজকে দুর্বল করছে। আপনি যদি সমাজে ঘৃণা ছড়ান, সেটা হিংসায় পরিণত হয়। আমরা এর অংশ হব না।”

ভারতের টিভি চ্যানেলগুলির সংগঠন নিউজ ব্রডকাস্টার্স অ্যান্ড ডিজিটাল এসোসিয়েশন এনবিডিএর সভাপতি ও এবিপি নেটওয়ার্কের মুখ্য কার্যনির্বাহী অবিনাশ পাণ্ডে বলছেন, “এই সিদ্ধান্ত সংবাদমাধ্যমের গলা টিপে ধরার মতো। যে জোট গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলে, দেখা যাচ্ছে তারাই তো সেগুলি ধ্বংস করছে। তবে আমরা সব অনুষ্ঠানে সবাইকে আমন্ত্রণ জানাবো।“

‘ইন্ডিয়া’ জোটের এই সিদ্ধান্ত একটি বিপজ্জনক নজির সৃষ্টি করছে বলেও মন্তব্য করেছে এনবিডিএ।

তারা বলছে বিরোধী জোট “নিজেদের বহুত্ববাদ এবং মুক্ত সংবাদপত্রের সমর্থক হিসাবে বর্ণনা করে কিন্তু তার এই সিদ্ধান্ত গণতন্ত্রের মৌলিক নীতিকেই আঘাত করে।“

যেসব উপস্থাপকদের বয়কট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ‘ইন্ডিয়া’ জোট, তাদের মধ্যে রয়েছেন ‘আজ তক’ চ্যানেলের জনপ্রিয় উপস্থাপক সুধীর চৌধুরী। এই তালিকা প্রকাশিত হওয়ার পরে তিনি সামাজিক মাধ্যম এক্স-এ (পূর্বতন টুইটার) লিখেছেন, “ইন্ডিয়া জোটের সামনে যে সাংবাদিক ও উপস্থাপকরা নির্ভয়ে মোকাবিলা করেছেন, যারা পায়ে চুম্বন করতে অস্বীকার করেছেন, এখন তাদের বয়কট করা হবে। প্রায় অর্ধেক ভারতে এই জোটের সরকার রয়েছে। যখন লোভ, পুরস্কার আর এফআইআর করেও কাজ হল না তখন বয়কট। এখন সর্বশক্তি দিয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এর জবাব দেওয়া উচিত ভারতের সংবাদমাধ্যমের। এটা খুব বিপজ্জনক পরিস্থিতি।“

বয়কটের তালিকায় থাকা আরও একাধিক উপস্থাপকও একই সুরে ‘ইন্ডিয়া’ জোটের এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়েছেন। অর্ণব গোস্বামী, অমিশ দেভগন এবং নাভিকা কুমারের মতো উপস্থাপক, যাদের নামও রয়েছে ওই তালিকায়, তারা নিজের সংবাদ অনুষ্ঠানে এই সিদ্ধান্তের সমালোচনাও করেছেন।

তারা অবশ্য কেউ পৃথকভাবে প্রতিক্রিয়া দিতে চান নি।

কিন্তু নাম উল্লেখ না করার শর্তে কলকাতার একটি বাংলা চ্যানেলের এক সিনিয়র সংবাদ উপস্থাপক বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, “এটা ঠিকই যে জাতীয় স্তরের টিভি চ্যানেলের কয়েকজন এমন ভাবে সংবাদ উপস্থাপন করেন বা সান্ধ্য বিতর্ক পরিচালনা করেন, যাতে মনেই হয় যে তারা একটি নির্দিষ্ট অ্যাজেন্ডা নিয়ে অনুষ্ঠান করতে এসেছেন। ওই সব অনুষ্ঠানের শুরু থেকেই এমন ভাবে কথা বলা হয়, যেন বিরোধী দলের মুখপাত্ররা কোনও অপরাধী।

“তবে এটাও ঠিক যে, সব রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীরই সমালোচনার মুখোমুখি হওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকা উচিত। যতই প্রতিকুল পরিস্থিতি তৈরি হোক কোনও টিভি বিতর্ক অনুষ্ঠানে, সেটা তো রাজনৈতিক দলগুলির কাছে একটা মঞ্চ, সেখানে তো তারা জোর গলায় তারা নিজেদের বক্তব্য রাখতেই পারে,” বলছিলেন ওই সিনিয়র উপস্থাপক।

দলের সভাপতি জেপি নাড্ডা ‘ইন্ডিয়া’ জোটের এই সিদ্ধান্তকে নাৎসিদের সঙ্গে তুলনা করেছেন।

তার কথায়, “সংবাদ উপস্থাপকদের এরকম একটা তালিকা প্রকাশ নাৎসিদের মতো কাজ, যেখানে ঠিক করা হয় যে কাদের নিশানা করা হবে। এইসব দলগুলোর মধ্যে এখনও জরুরী অবস্থার মানসিকতা কাজ করছে।“

বিজেপির এই প্রতিক্রিয়া দিয়েছে তাদেরই একসময়ের সহযোগী দল ও বর্তমানে ‘ইন্ডিয়া’ জোটের অংশ শিবসেনা (উদ্ভব ঠাকরে গোষ্ঠী)-র নেত্র প্রিয়াঙ্কা চতুর্বেদী।

তিনি সামাজিক মাধ্যমে লিখেছেন যে আদানি গোষ্ঠী এনডিটিভি অধিগ্রহণ করার আগে পর্যন্ত বিজেপিও তো ওই চ্যানেলটিকে বয়কট করত।

সূত্র: বিবিসি বাংলা

Link copied!