যুদ্ধের প্রথম দিনে জন্ম তিন কন্যার; জীবন যেন ভয়ংকর চলচ্চিত্র

বিবিসি

ডিসেম্বর ২৬, ২০২৩, ০৯:৩৫ এএম

যুদ্ধের প্রথম দিনে জন্ম তিন কন্যার;  জীবন যেন ভয়ংকর চলচ্চিত্র

ছবি: সংগৃহীত

ইউক্রেনের দম্পতি হানা ও আন্দ্রি বেরেজাইনেটস প্রথম যেদিন জানতে পেরেছিলেন একসাথে তিন সন্তানের জন্ম দিতে যাচ্ছেন, সেদিন তাঁদের আনন্দের সীমা ছিল না। কিন্তু যেদিন সন্তানের জন্ম হলো, সেদিনই যুদ্ধ শুরু হলো। চারপাশে বোমা বিস্ফোরণের শব্দ। পৃথিবীতে এসেই প্রথম বোমার শব্দ শুনেছে হানা ও আন্দ্রির তিন কন্যাসন্তান।

হানা প্রথমবার আলট্রাসাউন্ডের পরেই জানতে পেরেছিলেন, তিনি সন্তানের মা হতে চলেছেন। কিন্তু দ্বিতীয় দফা পরীক্ষায় চিকিৎসক বলেছেন, তাঁরা যমজ সন্তানের মা-বাবা হচ্ছেন। এই আনন্দ নিয়ে তৃতীয় দফা চেকআপে গেলে চিকিৎসক তাঁদের অবাক করে দেন।

জানান, দুটি নয়, হানা আসলে একসাথে তিন সন্তানের জন্ম দিতে যাচ্ছেন।

ইউক্রেনকাস্ট পডকাস্টকে হানা রসিকতা করে বলেছেন, ‘এরপর আমরা চতুর্থ দফায় চিকিৎসকের কাছে যেতে ভয় পেয়েছিলাম। তবে খুব আনন্দিত ছিলাম। আমরা সত্যি সন্তান চেয়েছিলাম। সৃষ্টিকর্তা আমাদের কথা শুনেছেন, আমাদের একসাথে তিন সন্তান দিয়েছেন।’

গত বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি অস্ত্রোপচারের জন্য চেরনিহিভের একটি প্রসূতি হাসপাতালে যান হানা। পরের দিন সকালে অস্ত্রোপচারের জন্য দিন নির্ধারিত ছিল। এর মধ্যে রাশিয়ার হামলা সম্পর্কে খবর ছড়িয়ে পড়ে। হানার ভাই সামরিক স্কুলে পড়াশোনা করেন। ২৪ ফেব্রুয়ারি সকালে তিনিও হানাকে একই বার্তা দেন, কিন্তু হানা তা বিশ্বাস করেননি।

ভাই তাঁকে বলেছিলেন, যুদ্ধ শুরু হয়েছে। তাঁকে কোথায় পাঠানো হবে, তা তিনি জানেন না। তিনি হানাকে চেরনিহিভ ছেড়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন।

কিন্তু হানা চেরনিহিভ ছাড়তে পারেননি। তাঁর অস্ত্রোপচারের সময় ছিল সকাল ৯টায়। হাসপাতালের কর্মীরা গত তিন বছরের মধ্যে প্রথম অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে একসাথে তিন সন্তানের জন্মের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, যা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না হানা। তিনি বলেন, ‘আমি ভেবেছিলাম এটি দূরে কোথাও, অন্য কোনোখানে ঘটবে। কিন্তু আমাদের জীবনে ঘটবে, তা ভাবতে পারিনি।’

ওই দিন সকাল ছয়টায় পোশাক ও অন্যান্য জিনিসপত্রে ভরা স্যুটকেস নিয়ে আন্দ্রি হাসপাতালে পৌঁছে যান। তিনি হানাকে শান্ত করার চেষ্টা করেন। আন্দ্রি তাঁকে বলেছিলেন, ‘সব চিন্তা বাদ দাও। আমাদের মূল ভাবনা সন্তানদের এই মুহূর্তে পৃথিবীতে নিয়ে আসা।’

হানা বলেন, কয়েক মিনিটের ব্যবধানে তিন সন্তানের জন্ম হয়। ৯টা ৩৬ মিনিটে এমিলিয়া, ৯টা ৩৭ মিনিটে অলিভিয়া ও ৯টা ৩৮ মিনিটে মেলানিয়া প্রথমবারের মতো পৃথিবীর আলো দেখতে পায়। তিনি আরও বলেন, ‘তারা যে এত সুন্দর হবে, তা আমি কল্পনাও করিনি।’

মেলানিয়ার জন্মের ১০ মিনিট পর ৯টা ৪৮ মিনিটে ইউক্রেনের রাষ্ট্রীয় সীমান্ত পরিষেবা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করে, রাশিয়ার সামরিক যান চেরনিহিভ অঞ্চলে ঢুকে পড়েছে।

আশ্রয়কেন্দ্র থেকে আইসিইউ

চেরনিহিভ ইউক্রেনের উত্তরাঞ্চলীয় বেলারুশ সীমান্তে অবস্থিত। সেখান থেকেই রাশিয়ার সৈন্যরা হামলা শুরু করেছিল। অবিরাম গোলাবর্ষণ হয়েছিল। রাশিয়া শহরটি দখল করেনি। তবে শহরটি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

হানা বলেন, সন্তান জন্মের পর সন্ধ্যায় একটু বিছানা থেকে উঠতে সক্ষম হন তিনি। এ সময় তাঁকে সন্তানদের নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে বলা হয়। তাপমাত্রা শূন্যের কাছাকাছি। এই পরিস্থিতিতে বাইরে যেতে হয়েছিল। নার্স বাচ্চাদের উষ্ণ কম্বলে জড়িয়ে দিয়েছিল। ওই আশ্রয়কেন্দ্রে নবজাতকের সাথে শতাধিক মানুষ ছিল। হাসপাতালের কর্মীরা সেখানে ২০টি নবজাতকের প্রসব করিয়েছেন।

হানার মেয়েরা অপরিণত ছিল। তাদের বিশেষ ইনকিউবেটরে রাখতে হতো, কিন্তু আশ্রয়কেন্দ্রে তা ছিল না। তাই নার্স তাদের উষ্ণ রাখতে জড়িয়ে ধরে রেখেছিলেন। তিন সন্তানই অনেক ছোট ছিল। এমিলিয়ার ওজন ছিল ১ দশমিক ৬ কেজি আর মেলানিয়ার ১ দশমিক ৪ কেজি। অলিভিয়ার ওজন ছিল একেবারেই কম—১ দশমিক ১ কেজি। তার অবস্থা কিছুটা সংকটাপন্ন ছিল। তাকে বাঁচাতে হলে নিবিড় পরিচর্যা ইউনিটে স্থানান্তরিত করতে হবে। কিন্তু হানা ও আন্দ্রি অলিভিয়াকে সেখানে একা পাঠাতে রাজি হননি। তাই আশ্রয়কেন্দ্রে এক সপ্তাহ কাটিয়ে পুরো পরিবার আবার হাসপাতালে চলে যায়।

ওই হাসপাতালে প্রায় দুই সপ্তাহ নিবিড় পরিচর্যায় রাখা হয় অলিভিয়াকে। হানা বলেন, ‘আমরা হাসপাতালের বারান্দায় অন্য দুই মেয়েকে সাথে নিয়ে ছিলাম। যখন বোমা বিস্ফোরণের বিকট শব্দ হতো, কেবল তখন বেসমেন্টে গিয়েছিলাম।’

একদিন এমিলিয়া ও মেলানিয়াকে কোলে নিয়ে বারান্দায় বসেছিলেন হানা। হঠাৎ বিশাল আলোর ঝলকানি। এরপর চারদিক অন্ধকার আর ধোঁয়ায় ছেয়ে যায়। হানা বলেন, ‘আমি লাফিয়ে উঠে বাচ্চাদের আঁকড়ে ধরেছিলাম। তখন জানা ছিল না, মরে গেছি নাকি বেঁচে আছি।’

হানাকে সাহস দিয়েছিলেন বাবা
অবশেষে ২০ মার্চ হানার পুরো পরিবার হাসপাতাল ত্যাগ করে। স্বেচ্ছাসেবকদের সহায়তায় তাঁদের কিয়েভে সরিয়ে নেওয়া হয়।

রাশিয়ার সৈন্যদের নজর এড়াতে দুই ঘণ্টার পথ তাঁরা অনেক দিনে পাড়ি দিয়েছিলেন। নিজ শহরে ফিরে যাওয়ার আগে স্লোভাকিয়ায় কয়েক মাস কাটাতে হয়েছিল তাঁদের। এ সময় হানা তাঁর বাবা আনাতোলির সাথে দেখা করার জন্য অস্থির হয়েছিলেন। তাঁর বাবা ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীতে যুদ্ধ করছিলেন। বাবার পাঠানো বার্তাই মূলত ছিল আনার শক্তির মূল উৎস। হানা বলেন, ‘বাবা প্রায়ই বলতেন, দাঁড়াও, আমি তোমাকে রক্ষা করছি। আমরা রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব।’

গত বছরের এপ্রিলে চেরনিহিভ অঞ্চল থেকে রাশিয়া সেনা প্রত্যাহার করার পর হানার ৫১ বছর বয়সী বাবা আনাতোলিকে পূর্ব ইউক্রেনে পাঠানো হয়।

পরিবারটি আশা করেছিল, মেয়েদের প্রথম জন্মদিনে বাড়ি আসবেন নানা আনাতোলি। কিন্তু তা হয়নি। আর কোনো দিন হবে না। চলতি বছরের ১১ জানুয়ারি দোনেস্কের টার্নি গ্রামের কাছে যুদ্ধে নিহত হন তিনি।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে হানা বলেন, ‘আমি ভেবেছিলাম, যুদ্ধ শেষ হলে বাবা বাড়ি ফিরে আসবেন। বিশ্বাস করতে পারছি না যে আমরা পুরো পরিবার আর একসাথে থাকব না।’

হানা ও অ্যান্ড্রি সন্তানদের জীবনের প্রথম বছরকে ‘একটি ভয়ংকর চলচ্চিত্রের’ সাথে তুলনা করেছেন। তবে মেয়েদের ধন্যবাদ দিয়ে তাঁরা বলেছেন, এখানেও তিন গুণ বেশি ভালোবাসা ও সুখ রয়েছে।

Link copied!