আগস্ট ৬, ২০২৫, ০৫:৪৭ পিএম
ছবি: সংগৃহীত
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাঁচ দফা বাণিজ্য আলোচনার পর ভারতীয় কর্মকর্তারা এতটাই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে তারা গণমাধ্যমকে এমন ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, চুক্তি অনুযায়ী শুল্ক সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ হতে পারে।
ভারতীয় কর্মকর্তাদের আশা ছিল, ১ আগস্টের নির্ধারিত সময়সীমার আগেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেই চুক্তির ঘোষণা দেবেন। কিন্তু সেই ঘোষণা আর এল না।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়।
এতে বলা হয়, ভারতকে বিস্মিত করে দিয়েই ২৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। আগামী শুক্রবার থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ঢুকতে যাওয়া ভারতীয় পণ্যে ২৫ শতাংশ শুল্ক দিতে হবে। তা ছাড়া রাশিয়া থেকে তেল আমদানির জন্য বাড়তি ‘জরিমানার’ মুখে পড়তে যাচ্ছে ভারত। অবশ্য সেই পরিমাণটা কত, তা এখনো ঘোষণা দেননি ট্রাম্প। তিনি ইতিমধ্যে জাপান ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সঙ্গে বড় চুক্তি করে ফেলেছেন। এমনকি পাকিস্তানকেও তুলনামূলকভাবে কম পাল্টা শুল্ক দিয়েছেন।
আলোচনার প্রায় সব বিষয়ের ওপর কারিগরি সমঝোতা হলেও কীভাবে আলোচনাটি ভেঙে পড়ল, সে বিষয়ে চারজন ভারতীয় ও দুজন মার্কিন কর্মকর্তা বিস্তারিত তথ্য জানিয়েছেন বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে।
দুই পক্ষের কর্মকর্তারাই বলছেন, রাজনৈতিক ভুল সিদ্ধান্ত, ভুল–বোঝাবুঝি এবং পারস্পরিক তিক্ততার কারণে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ও পঞ্চম বৃহৎ অর্থনীতির মধ্যে ১ হাজার ৯০০ কোটি ডলারের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি ভেঙে যায়।
হোয়াইট হাউস, ইউএস ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভ, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, পররাষ্ট্র ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে এ বিষয়ে জানতে ই–মেইল করা হলেও কেউই জবাব দেয়নি।
ভারতের ধারণা ছিল, দেশটির বাণিজ্যমন্ত্রী পীযূষ গোয়েল ও মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স যখন একে অন্যের দেশ সফর করেছেন আর ভারত বেশ কিছু বড় ছাড় দিয়েছে, সে ক্ষেত্রে চুক্তি নিশ্চিত হয়ে গেছে।
দুজন ভারতীয় কর্মকর্তা জানান, যুক্তরাষ্ট্রের শিল্পজাত পণ্যের (যা তাদের রপ্তানির প্রায় ৪০ শতাংশ) ওপর শুল্ক শূন্য করতে চেয়েছিল নয়াদিল্লি।
ঘরোয়া চাপ থাকা সত্ত্বেও ভারত ধীরে ধীরে মার্কিন গাড়ি ও অ্যালকোহলের ওপর শুল্ক কমাতে এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে জ্বালানি ও প্রতিরক্ষা পণ্যের আমদানি বাড়াতে রাজি হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান দাবির মধ্যে ছিল জ্বালানি ও প্রতিরক্ষা পণ্য রপ্তানির।
ভারতের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ওয়াশিংটনে পঞ্চম দফা আলোচনার পর বেশির ভাগ বিষয়েই সমঝোতা হয়েছিল। আমরা আশা করেছিলাম, একটি চুক্তি হবে। আমরা ভেবেছিলাম, যুক্তরাষ্ট্র কৃষি ও দুগ্ধজাত পণ্যর ক্ষেত্রে ভারতের আপত্তি মেনে নেবে।’
কিন্তু এটি ছিল একটি ভুল হিসাব। ট্রাম্প বিষয়টি অন্যভাবে দেখেছিলেন, তিনি আরও ছাড় ও প্রতিশ্রুতি চাচ্ছিলেন।
হোয়াইট হাউসের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা অনেক অগ্রগতি করেছি, কিন্তু তেমন কোনো চুক্তি হয়নি, যাকে আমরা ভালো বলতে পারি। আমরা সেই পর্যায়ে যেতে পারিনি, যেখানে আমরা সত্যিই চুক্তি করতে পারতাম।’
অতি আত্মবিশ্বাস ও ভুল হিসাব
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ফেব্রুয়ারিতে ওয়াশিংটন সফরে গিয়ে চুক্তির লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেন ২০২৫ সালের শরৎকাল পর্যন্ত এবং ২০৩০ সালের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য দ্বিগুণের বেশি করে ৫০ হাজার কোটি ডলারে পৌঁছানোর কথা বলেন।
৪ হাজার ৭০০ কোটি ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে ভারত প্রতিশ্রুতি দেয়, ২ হাজার ৫০০ কোটি ডলার পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র থেকে জ্বালানি কেনা হবে এবং প্রতিরক্ষা খাতের আমদানি বৃদ্ধি করা হবে।
তবে ট্রাম্প যখন ‘একটি বড় চুক্তি আসছে’ বলে মন্তব্য করলেন, ভারত তখন ভেবে বসল চুক্তি চূড়ান্ত। এরপর তারা নিজেদের অবস্থান কঠোর করে তোলে, বিশেষ করে কৃষি ও দুগ্ধজাত পণ্য খাতে ভারত শক্ত অবস্থান নেয়, যা তাদের জন্য বেশ সংবেদনশীল।
গত জুলাইয়ের মাঝামাঝি একজন ভারতীয় কর্মকর্তা বলেছিলেন, ‘আমরা সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতি, ১৪০ কোটি ডলারের বাজার-যুক্তরাষ্ট্র চাইলেও এটি উপেক্ষা করতে পারবে না।’
ভারত এমনকি এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত ১০ শতাংশ গড় শুল্ক থেকে ছাড় এবং ইস্পাত, অ্যালুমিনিয়াম ও গাড়ির শুল্ক প্রত্যাহারের চেষ্টা করেছিল।
পরে যখন যুক্তরাষ্ট্র জাপান ও ইইউর সঙ্গে চুক্তি করল, তখন ভারত নিজের প্রত্যাশা কমিয়ে ১৫ শতাংশ পাল্টা শুল্কে চুক্তি করতে চেয়েছিল। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ভারত কম ছাড় দিতে চেয়েছে।
হোয়াইট হাউসের কাছে সেটা ছিল অগ্রহণযোগ্য। ওয়াশিংটনের একটি সূত্র জানায়, ট্রাম্প এমন এক ঘোষণা চাচ্ছিলেন, যে বড় খবর হবে। যেমন ভারতের বাজার উন্মুক্ত করা, বিনিয়োগ ও বড় কেনাকাটার প্রতিশ্রুতি।
ভারতের এক কর্মকর্তা স্বীকার করেন, ভারত তেমন ছাড় দিতে প্রস্তুত ছিল না।
উদাহরণস্বরূপ, দক্ষিণ কোরিয়া চুক্তির আগে ৩৫ হাজার কোটি ডলারের বিনিয়োগ, জ্বালানি আমদানি এবং চাল ও গরুর মাংসে ছাড় দিয়ে ১৫ শতাংশ শুল্ক আদায় করে।
যোগাযোগের ঘাটতি
সাবেক মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধি মার্ক লিন্সকট বলেন, একসময় দুই পক্ষই চুক্তি স্বাক্ষরের খুব কাছাকাছি ছিল। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও প্রধানমন্ত্রী মোদীর মধ্যে সরাসরি যোগাযোগের অভাবই বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
তবে হোয়াইট হাউসের একজন কর্মকর্তা বলেন, অন্যান্য দেশের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে এমন কোনো সরাসরি ফোন ছাড়াই।
ভারতের এক কর্মকর্তা বলেন, মোদী ফোন করতে চাননি। কারণ, তিনি একতরফা কথোপকথনের মধ্যে পড়তে পারেন বলে আশঙ্কায় ছিলেন।
আবার অন্য তিন ভারতীয় কর্মকর্তা বলেন, ট্রাম্প বারবার ভারত-পাকিস্তান সংঘাত বন্ধে মধ্যস্থতার কথা বলায় মোদীর মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হয়েছিল। তাই তিনি ফোন করা থেকে বিরত থাকেন।
ভারতের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘পাকিস্তান নিয়ে ট্রাম্পের মন্তব্য ভালো লাগেনি। আসলে ভারতকে বলা উচিত ছিল, আমরা যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার বিষয়টি মেনে নিচ্ছি, তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আমাদেরই।’
ভারতের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের কূটনৈতিক প্রস্তুতির অভাব ছিল। ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, জাপান এবং ইইউর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের চুক্তির পর আমাদের কৌশল পাল্টানো উচিত ছিল। এখন আমরা এমন এক সংকটে পড়েছি, যা এড়ানো যেত।’
গতকাল মঙ্গলবার আবার ট্রাম্প বলে বসেছেন, ভারত থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক ‘খুব শিগগির’ আরও বৃদ্ধি করা হবে। তিনি এও অভিযোগ করেন, রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কেনার মাধ্যমে ভারত ‘ইউক্রেন যুদ্ধে’ মস্কোকে অর্থ সহায়তা দিচ্ছে।
এখন করণীয় কী
আলোচনা এখনো চলছে। এই মাসেই একটি মার্কিন প্রতিনিধিদল দিল্লি সফরে যাচ্ছে। ভারতীয় কর্মকর্তারা মনে করছেন, আলোচনা এবং একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর সম্ভাবনা এখনো শেষ হয়ে যায়নি।
হোয়াইট হাউসের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘এখনো সম্ভব।’
ভারতের চতুর্থ এক কর্মকর্তা বলেন, ভারত সরকার কৃষি ও দুগ্ধজাত খাতে কিছু ছাড় দেওয়ার জায়গা খতিয়ে দেখছে। আর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দামে মিললে রাশিয়া থেকে কিছু তেল আমদানি কমিয়ে সেটা যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা হবে।
লিন্সকট বলেন, ‘সম্ভবত ট্রাম্প ও মোদীর মধ্যে সরাসরি ফোনে আলোচনার মধ্যেই এখন সমাধান লুকিয়ে আছে। ফোন তুলুন। এখন আমরা দুই পক্ষই হারের পরিস্থিতিতে। অথচ দুই পক্ষের জন্যই দারুণ এক জয়ের চুক্তির সম্ভাবনা আছে।’